X
শনিবার, ১০ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২

গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি: অভিযুক্তদের তালিকা ও নীতিমালা নেই

উদিসা ইসলাম
০৮ জুন ২০২১, ১৬:৩৭আপডেট : ০৯ জুন ২০২১, ১৯:০১

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার মান নিয়ে সমালোচনার পাশাপাশি ‘প্ল্যাজিয়ারিজমের’ অভিযোগ বাড়ছে। কেবল পদোন্নতির শর্ত পূরণে শিক্ষকরা গবেষণার নামে যা করছেন তা ‘দায়সারা’ ও ‘অনাকর্ষণীয়’। কিন্তু কারা সেই শিক্ষক যাদের গবেষণা নিয়ে অভিযোগ উঠছে সে নিয়ে নেই কোনও সুনির্দিষ্ট তালিকা নেই।

বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে এই চুরি ধরার আদর্শ সফটওয়ার ব্যবহারের রীতি না থাকায় কত গবেষণা এ ধরনের অভিযোগের আওতায় পড়তে পারে তারও কোনও আন্দাজ নেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে।

এমনকি ঠিক কী কী করলে চুরি হয়েছে ধরা হবে এবং সেটার সমাধান কীভাবে করা হবে সে বিষয়ে কেন্দ্রীয় কোনও নীতিমালা নেই। সব মিলিয়ে উন্মুক্ত পরিবেশে প্লেজারিজম চলছে বলে মন্তব্য করেছেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রবন্ধ প্রকাশকারী শিক্ষকরা। তবে  ইউজিসি বলছে, নীতিমালা তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন তারা। একইসঙ্গে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে অ্যান্টি-প্লেজারিজম সফটওয়্যার ‘টার্নিটিন’ কিনে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কোনটা চৌর্যবৃত্তি

আমাদের দেশে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে লিখিত গবেষণাপত্র যাচাইয়ের ব্যবস্থা থাকলেও, বাংলা লেখা যাচাইয়ের কোনও ব্যবস্থাই নেই। ফলে, এ ধরনের বহু দুষ্কর্ম আড়ালেই থেকে যায়। সহজ কথায় অন্যের কাজ বা ধারণা, তাদের অসম্মতিতে, কোনও স্বীকৃতি প্রদান ছাড়াই নিজের কাজে যুক্ত করার মাধ্যমে উপস্থাপনের নামই প্লেজারিজম।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য সাজ্জাদ হোসেন বলেন, কনসেপ্ট মিলে যেতে পারে সেটা চৌর্যবৃত্তি নয়। একই বিষয়ে একাধিক গবেষণাও হতে পারে। দেখতে হবে, হুবহু কপি যেন না হয়। একজনের কাজ আরেকজন এগিয়ে নিতে পারেন। গবেষণায় কপি করাটা একেবারেই নিষিদ্ধ। যারা সেই বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করেন তাদের বিরুদ্ধে বিভাগ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বলা হয়ে থাকে ২০ পারসেন্ট পর্যন্ত কপি করা যায়। তবে অবশ্যই সেটা সিঙ্গেল সোর্স থেকে না। যেখান থেকেই নেন সেটার যথাযথ পন্থায় উল্লেখ করতে হবে।

কোনও তালিকা নেই

কতগুলো গবেষণায় আসলে অন্যের ধারণা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বিনা অনুমতি বা রেফারেন্স উল্লেখ না করে এ বিষয়ে কোথাও কোনও তালিকা নেই। কেবল একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলেই নজরে আসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই অভিযোগগুলো নিয়েও কথা বলতে চান না তারা। কোথাও তালিকা আছে বলে জানা নেই উল্লেখ করে মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. মো. আবু তাহের বলেন, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে তাদের তালিকা প্রকাশ করা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব। এরকম অন্যের লেখা নিজের বলে চালালে তার শাস্তি হয় এই উদাহরণ থাকাটাও জরুরি। যে কয়টি ধরা পড়ছে বা যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে কেবল তারাই এই দোষে দুষ্ট, অন্যদের ক্ষেত্রে তেমন কিছু ঘটে না বিষয়টি এমন না। প্রত্যেকের গবেষণা বা প্রবন্ধের ক্ষেত্রে এটা চেক করা হয় না বলে বড় অংশ ওইভাবেই পার পেয়ে যায়।

নেই কোনও নীতিমালা

এ বিষয়ে ইউজিসি সদস্য প্রফেসর সাজ্জাদ হোসেন বলেন, দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গবেষণাক্ষেত্রে চৌর্যবৃত্তির ঘটনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই সংক্রান্ত নীতিমালা না থাকায় গবেষণা কার্যক্রমে চৌর্যবৃত্তির বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। তাই চৌর্যবৃত্তি শনাক্ত করতে একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন।

অ্যাকাডেমিক কাউন্সিল, উপাচার্য সেখানেই এসব অভিযোগ সমাধান হওয়া দরকার উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আমাদের কাছে পর্যন্ত অভিযোগ এলে বিশ্ববিদ্যালয়কে জানাই। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তারা ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। নীতিমালা আলাদা করে লাগবে কেন? একজন শিক্ষক কী করবেন বা করবেন না তার নির্দেশনা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিধিসম্মত নয় এমন কিছু তারা করবেন না।

কেনা হচ্ছে সফটওয়্যার

এদিকে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে এবার অ্যান্টি-প্লেজারিজম সফটওয়্যার ‘টার্নিটিন’ কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউজিসি। ৩০ মে ভাচুর্য়াল প্লাটফর্মে অনুষ্ঠিত প্লেজারিজম চেকার ওয়েব সার্ভিস ক্রয় সংক্রান্ত কমিটির এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সফটওয়্যার দিয়ে গবেষক এবং শিক্ষকদের গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি বিষয়টি নির্ধারণ করা যাবে।

এ বিষয়ে ইউজিসি সদস্য প্রফেসর ড. আবু তাহের বলেন, প্রাথমিকভাবে ৩০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এই সফটওয়্যারের সেবা সরবরাহ করা হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এর ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। এটি কেনার প্রয়োজনীয়তা ও ব্যবহার নিয়ে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে কাজ চলছে।

ইউজিসি সদস্য ড. মো সাজ্জাদ হোসেন বলেন, কপি করার বিষয়ে জিরো টলারেন্স। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে সফটওয়্যার কেনা হচ্ছে। যদিও অনেকে ব্যবহার শুরু করেছেন। আমরা চাই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা হোক। কত শতাংশ কপি করা যাবে বা যাবে না, ‍সুনির্দিষ্ট করে গাইডলাইনের প্রক্রিয়া শুরু করেছি।

গবেষণা পদ্ধতি না জানাই মূল কারণ?

যে গবেষক বা প্রাবন্ধিক শিক্ষক অন্যের লেখা নিজের বলে চালান তিনি বিষয়টি সম্পর্কে অবহিত নন বা গবেষণা পদ্ধতি জানেন না বলে করেন এমন ভাবতে নারাজ ইউজিসির সদস্য ড. তাহের। তিনি বলেন, মানসিকভাবে নৈতিকভাবে যদি সৎ না হন তাহলে এ ধরনের ঘটনা ঘটবে এবং কেবল টেকনোলজি ব্যবহারে তা বন্ধ হবে না। রেফারেন্স কীভাবে দিতে হবে, অন্যের লেখা থেকে কতটুকু অংশ নেওয়া যাবে বা নিলে কীভাবে সেটা উপস্থাপন করতে হবে তার আন্তর্জাতিক নিয়ম ও মান নির্ধারণ করা আছে। সেটা যেন মানা হয় সেইটা নিশ্চিত করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। হুবহু একটানা কপি যে করা যায় না এটা তো প্রাথমিক শিক্ষা।

সফটওয়্যার ব্যবহারকারীদের অভিজ্ঞতা

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের এখানে আর কোন নতুন বিভাগ বা নতুন শিক্ষক নেওয়ার সুযোগ নেই। আমরা এখন গুণগত মানের দিকে খেয়াল করছি। একের পর এর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ দেখে আমরা সফটওয়্যারের মাধ্যমে গবেষণা চেক করে জমা দিতে উৎসাহিত করি। ফলে গত চার বছরে আমাদের এখানে এ ধরনের অভিযোগ আসার সুযোগ নেই।

এধরনের অসততা নিয়োগের প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। কোথাও আপস না করে ভালো নিয়োগ দেওয়া গেলে এসব সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যাবে। বীজ ভালো না হলে ফসল ভালো হবে না। একাধিক লেখকের প্রবন্ধের ক্ষেত্রে বেশ কিছু জটিলতা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বেশিরভাগ সহ-লেখকরা জানেনই না লেখার মধ্যে কী আছে। পাঁচ জন লেখক থাকলে সেই লেখায় প্রত্যেকে ভাগে ২০ শতাংশের দাবিদার হতে পারেন। কিন্তু আমাদের এখানে পাঁচ জনই তাদের একটি লেখা হিসেবে এটি জমা দিয়ে থাকেন। অনেক ছোট ছোট বিষয় ধরে কাজ করার আছে। আমাদের এখানে আমরা সফটওয়্যারের ব্যবহার শুরু করেছি এবং তাতেই সতর্কতা বেড়েছে।

শিক্ষক বাছাই সমস্যা ও নৈতিক অবক্ষয়

গবেষণার নামে কেন দায়সারা কিছু করার প্রবণতা তৈরি হলো প্রশ্নে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মির্জা তাসলিমা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গবেষণার প্রণোদনা নেই, কিন্তু চান ভালো গবেষণা হবে, সেটা কীভাবে হবে। আমাদের এখানে মৌলিক রিসার্চকে উৎসাহিতই করা হয় না। কেবল বছর বছর প্রমোশনের জন্য গবেষণা লাগে। নবীন শিক্ষকরা পদোন্নতির জন্য করেন, ফলে তাদের কাজকে যেন কড়াকড়িভাবে মূল্যায়ন না করা হয় সেই ভাবনা কাজ করে। এমনকি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, যারা গবেষণা করেন তারা আসলে প্রকৃত নিয়মগুলো জানেনও না।

কেউ অভিযুক্ত হলে বা এতদিন কতজনের কাজ ‘চুরির’ অভিযোগ এলো তার তালিকা কেন প্রকাশ করে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সংখ্যাটা এত বিশাল হবে সেই শঙ্কা থেকেই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয় না। চৌর্যবৃত্তি ধরতে যে সফটওয়্যারের কথা বলা হচ্ছে সেটি কেবল ইংরেজিতে টেক্সট ধরবে, এত এত গবেষণা বাংলায় হয় সেসব ধরার সফটওয়্যার নেই।

/এফএএন/এমওএফ/
সম্পর্কিত
রিসার্চে ‘ইয়াবা সিনড্রোম’ আর অনলাইন-নীলক্ষেতের প্রভাব
বছরে এক শিক্ষকের ১০২টি গবেষণাপত্র: অসম্ভব বলছেন গবেষকরা, হচ্ছে তদন্ত কমিটি
গবেষণায় চুরি ধরার উপায় চালু বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে
সর্বশেষ খবর
আ.লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে বিরতি ঘোষণা, শাহবাগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন হাসনাত
আ.লীগ নিষিদ্ধের আন্দোলনে বিরতি ঘোষণা, শাহবাগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন হাসনাত
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবরোধ তুলে নিলেন শিক্ষার্থীরা
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের অবরোধ তুলে নিলেন শিক্ষার্থীরা
শাহবাগে মধ্যরাতেও উপচেপড়া ভিড়, চলছে ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী
শাহবাগে মধ্যরাতেও উপচেপড়া ভিড়, চলছে ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ, ২০ কিলোমিটার যানজট
আ.লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ, ২০ কিলোমিটার যানজট
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
সাবেক শিবির নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
কলকাতায় যুদ্ধের প্রস্তুতি মমতা সরকারের
কলকাতায় যুদ্ধের প্রস্তুতি মমতা সরকারের