X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
ফিল্ম রিভিউ

ওরা ৭ জন: যুদ্ধ আর আত্মত্যাগের ছবি

আহসান কবির
০৪ মার্চ ২০২৩, ১৪:১৯আপডেট : ০৪ মার্চ ২০২৩, ১৭:৪৬

মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়কার এক রক্তক্ষয়ী অপারেশনের ছবি ‘ওরা সাত জন’। ভিন্ন ভিন্ন পেশা থেকে আসা সাত বীর মুক্তিযোদ্ধার বীরত্ব গাঁথা এক ছবি ‘ওরা সাতজন’। সাতজনের ভেতর বেঁচে থাকা একমাত্র যোদ্ধার কাছে এক যুদ্ধশিশুর মা সম্পর্কে জানতে চাওয়ার ছবি ‘ওরা সাতজন’। 

স্বাধীনতার পর তুমুল আলোচিত ছবি ‘ওরা এগার জন’-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত এক ছবি ‘ওরা সাত জন’। প্রতিবেশী দেশের এক নারী চিকিৎসক যিনি জানবাজি রেখে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিয়ে আসছিলেন তাকে উদ্ধার করে আনার এক সিনেমা ‘ওরা সাতজন’। ‘নিহত নদীর মতো সাহসী পুরুষ মাঝরাতে একা কাঁদে!’-এই কবিতার লাইনের মতো সহযোদ্ধা হারানো এক কমান্ডারের বুকভাঙা কান্নার ছবি ‘ওরা সাতজন’!

সেই এক দিন ছিল আমাদের। প্রাণের টানে, দেশের টানে যুদ্ধ আমাদের এক করেছিল। সাত মুক্তিযোদ্ধা এক হয়েছিল একটি অপারেশনে। এই সাতজনের একজন মসজিদের মুয়াজ্জিন, একজন ডাক্তার, একজন পুলিশ, দুজন আর্মি, একজন মননে কুস্তিগির আর একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেক্টর পাঁচের অধীনে মেজর লুৎফরের নেতৃত্বে এক সফল অপারেশন শেষে এই সাতজনকে দায়িত্ব দেয়া হয় একজন ভারতীয় নারী চিকিৎসককে উদ্ধার করে আনার। দেশ মাতৃকার তরে যুদ্ধের সময়ে কমান্ডারের নির্দেশ মানতে যেয়ে এই সাতজন জড়িয়ে যায় এক রক্তক্ষয়ী অপারেশনে।

সিনেমায় এই চিকিৎসক নারীর নাম অপর্ণা সেন। সীমান্ত সংলগ্ন হাসপাতালের যে ম্যাপ দেয়া হয় সেখানে যেয়ে জানা যায় এই ক্যাম্প হাসপাতাল সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। খুব কাছে হওয়ায় সুমিত তার মামা বাড়ি যেতে চায়। সবাই মিলে সেখানে গেলে অনেকদিন পর ভালো মন্দ খায় তারা। ফিরে এসে কয়েক ঘণ্টা পর সুমিত আবারও মামা বাড়ি যেয়ে দেখতে পায় মামাকে মেরে ফেলেছে রাজাকার বাহিনীর সহযোগী চেয়ারম্যান আর তার মামাতো বোনকে পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। মেজর লুৎফর অপর্ণা সেনকে নিয়ে আসার পথে সুমিতকে ফিরিয়ে আনার সময়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অ্যামবুশের ভেতর পড়ে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শেষে সেখানে পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে ডাক্তার।

একটি দৃশ্যে ওরা ৭ জন সুমিতের মামাতো বোন যার নাম স্নিগ্ধা, যাকে রাজাকাররা পাশবিক নির্যাতন করে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, তাকে  ভালোবাসতো সুমিত। স্নিগ্ধার মৃত্যুর সময়ে তাকে একটু শান্তি দিতে মসজিদের মুয়াজ্জিন সোলায়মানকে তাদের বিয়ে পড়াতে অনুরোধ করে সুমিত। সোলায়মান যখন জানতে চায় কিভাবে সম্ভব, তখন সুমিত উত্তর দেয়- আমাদের ধর্ম আলাদা হতে পারে উপরওয়ালা কিন্তু এক! স্নিগ্ধার মুখাগ্নি করে সুমিত আবার সাত মুক্তিযোদ্ধার একজন সোলায়মান পড়ায় ডাক্তার সাহেবের জানাজা। ডাক্তার নিহত হবার পর মধ্যরাতে মেজর লুৎফরের একাকী কান্নার দৃশ্যটা মনে রাখার মতো, যা সেই কবিতার লাইন মনে করিয়ে দেয়- ‘নিহত নদীর মতো সাহসী পুরুষ মাঝরাতে একা কাঁদে’!
 
এই ছবির ভালো দিক অভিনয়। মসজিদের মুয়াজ্জিন সোলায়মান কাজীর চরিত্রে ইমতিয়াজ বর্ষণ এবং অপর্ণা সেনের চরিত্রে জাকিয়া বারী মম সাবলীল ছিলেন। ডাক্তারের চরিত্রে ইন্তেখাব দিনার, মেজর লুৎফরের চরিত্রে খিজির হায়াত খান, সুমিতের চরিত্রে নাফিস আহমেদ, শাফি চরিত্রে সাইফ খান, মুক্তাদির চরিত্রে শাহরিয়ার ফেরদৌস সজীব, নজরুল চরিত্রে খালিদ মাহবুব তুর্যও ভালো অভিনয় করেছেন। এছাড়া রাজাকার চেয়ারম্যান চরিত্রে জয়রাজ, মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার চরিত্রে শিবা শানু, স্নিগ্ধা চরিত্রে তাসফি ও পাকিস্তানী মেজরের চরিত্রে হামিদুর রহমানও ভালো করেছেন। সাইফ খান ও শিবা শানুকে ক্রেডিট দেয়া যেতেই পারে। খল চরিত্রের বাইরে এসে শিবা শানু কমান্ডারের চরিত্রে ছিলেন স্মার্ট। আর সিলেটি ভাষায় সাইফ খানের অভিনয়ে মজা ছিল। অতিথি চরিত্রে (যুদ্ধশিশুর পরিণত বয়সের চরিত্র) নাজিয়া হক অর্ষাও ভালো অভিনয় করেছেন।

পরিচালক হিসেবে ‘ওরা সাতজন’ খিজির হায়াত খানের তৃতীয় ছবি। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে নিয়ে তিনি তার প্রথম ছবিটি বানিয়েছিলেন যার নাম ছিল ‘অস্তিত্বে আমার দেশ’। ফুটবল কেন্দ্রিক তার দ্বিতীয় ছবি ছিল ‘জাগো’। ‘ওরা সাত জন’ ছবিতে মেজর লুৎফরের চরিত্রে অভিনয় করার পাশাপাশি তিনি গানও লিখেছেন। ‘মন নৌকাতে ছেদ হয়েছে ভাই’ শিরোনামের গানটি লিখেছেন তিনি ও রাজিব হোসেন। গানটির সুর করেছেন নাজমুল আবেদীন আবির ও কণ্ঠ দিয়েছেন ছয় জন। ‘যাও দিলাম যেতে’ গানটিও লিখেছেন খিজির হায়াত খান, সুর ও সংগীতায়োজন এবং কণ্ঠ দিয়েছেন নাজমুল আবেদীন আবির। এই দুই গান আলোচনায় থাকতে পারে।

আহসান কবির মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোতে সরাসরি যুদ্ধের দৃশ্য নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে। ‘ওরা ১১ জন’ এর পরে এমন আয়োজনের ছবি খুব একটা নেই। সেই হিসেবে এই ছবির যুদ্ধ দৃশ্যগুলো তুলনামূলক স্মার্ট। রাতের দৃশ্যগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়, কালার গ্রেডিংও এই সময়ের তুলনায় পিছিয়ে। ছবির দৈর্ঘ্য কমানো যেত সহজেই, সামনাসামনি মারপিটের দৃশ্যগুলো না রাখলেও চলতো। মেজর লুৎফরের চরিত্রে খিজির হায়াত খানের লুক এন্ড ফিল ‘ওরা ১১ জন’-এর নায়ক খসরুর কথা মনে করিয়ে দেয়। সিলেটের চা বাগান ও মনোরম লোকেশনে এই ছবির শুটিং হয়েছে। 

‘ওরা ১১ জন’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর। আর ‘ওরা সাত জন’ শুটিং করতে সময় লেগেছে ঠিক নয় মাস, যা মুক্তি পায় ২০২৩ এর তিন মার্চ। ১৯৭১ বার বার ফিরে আসুক চলচ্চিত্রে, গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে আর সার্বিক চেতনায়। 

জয় হোক বাংলা ছবির!

সমালোচক: রম্যলেখক, সাংবাদিক ও কবি

/এমএম/
সম্পর্কিত
দেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
সিনেমা সমালোচনাদেয়ালের দেশ: মন খারাপ করা সিনেমা
ওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
সিনেমা সমালোচনাওমর: ‘নায়িকাবিহীন’ এক থ্রিলার
রাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
সিনেমা সমালোচনারাজকুমার: ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ এক বিয়োগান্তক ছবি
কাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
সিনেমা সমালোচনাকাজলরেখা: ঘোড়া, গরু, হাতিগুলো স্বাস্থ্যবান নয়
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
প্রেম নাকি বিয়ে, মুখ খুললেন ইলিয়ানা
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
এফডিসিতে মারামারি: যৌথ বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত হলো
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!
সেন্সর বোর্ডের সিদ্ধান্ত, রাফীর সিনেমাটি প্রদর্শনের অযোগ্য!