যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি একটি নির্বাহী আদেশে মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তন করে ‘আমেরিকা উপসাগর’ করার ঘোষণা দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত মেক্সিকো ও কিউবায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। মেক্সিকোর মানুষ এই সিদ্ধান্তকে তাদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের প্রতি অবমাননা বলে মনে করছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস এ খবর জানিয়েছে।
ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত শুধু যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রাতিষ্ঠানিক নথিত প্রযোজ্য হবে, আন্তর্জাতিকভাবে নয়। তিনি অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, সরকারি ভৌগোলিক ডাটাবেস, মানচিত্র, চুক্তি ও অন্যান্য নথিপত্রে মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তন করে ‘আমেরিকা উপসাগর’ লেখার ব্যবস্থা করতে। গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয় এই পরিবর্তন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে।
মেক্সিকো উপসাগরের নাম পরিবর্তনের এই সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটি বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধু একটি নাম পরিবর্তনের চেয়ে বেশি কিছু, এটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রশ্ন। মেক্সিকো ও কিউবার মানুষের কাছে মেক্সিকো উপসাগর শুধু একটি ভৌগোলিক স্থান নয়, এটি তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ।
মেক্সিকোর প্রতিক্রিয়া: ঐতিহাসিক দাবি ও হাস্যরস
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাউম ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে হাস্যরসের সঙ্গে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের এবং সারা বিশ্বের কাছে এটি এখনও মেক্সিকো উপসাগরই থাকবে। তিনি ১৬০৭ সালের একটি বিশ্ব মানচিত্রের উদাহরণ টেনে বলেন, উত্তর আমেরিকাকে তখন ‘মেক্সিকান আমেরিকা’ বলা হতো। তাহলে আমরা কি এটাকে মেক্সিকান আমেরিকা বলব? শুনতে ভালো লাগে না?
মেক্সিকোর ভেরাক্রুজ রাজ্যের গভর্নর রোসিও নাহলে টুইটারে লিখেছেন, ‘৫০০ বছর ধরে এটি আমাদের সমৃদ্ধ ও মহান মেক্সিকো উপসাগর হিসেবেই পরিচিত। এটি কোনও আদেশের বিষয় নয়, এটি বাস্তবতা!’ মেক্সিকোর জাতীয় পর্যটন মন্ত্রণালয়ও সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্টে লিখেছে, ‘মেক্সিকো উপসাগর দীর্ঘজীবী হোক! আমাদের মেক্সিকোর সৌন্দর্য বিশ্বের কাছে অনন্য, যেমনটি ১৬০৭ সাল থেকে বিশ্ব মানচিত্রে এটি পরিচিত।’
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মেক্সিকো উপসাগরের নামকরণের ইতিহাস বেশ পুরনো। নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক স্যামুয়েল ট্রুয়েট বলেছেন, মেক্সিকো উপসাগর নামটি প্রথম ১৫৫২ সালে স্প্যানিশ ইতিহাসবিদদের লেখায় পাওয়া যায়। তখনও মেক্সিকো নামের কোনও দেশ গঠিত হয়নি। এই নামের উৎপত্তি অ্যাজটেক সভ্যতা থেকে, যারা মেক্সিকো সিটির ভিত্তি স্থাপন করেছিল।
ট্রুয়েট আরও উল্লেখ করেন, ‘আমেরিকা’ শব্দটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনেরও আগে থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে এবং এটি মূলত পুরো হেমিস্ফিয়ারকে বোঝাত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এই শব্দটি শুধু তাদের দেশের জন্য ব্যবহার করে, যা অনেক লাতিন আমেরিকানদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
কিউবার প্রতিক্রিয়া: উদাসীনতা
কিউবায় ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত নিয়ে তেমন কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। সান্তা লুসিয়া শহরে একটি হোটেল চালান এডেল পেরেজ বলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, কীভাবে একজন ব্যক্তির ইচ্ছায় একটি উপসাগরের নাম পরিবর্তন করা যায়। আমাদের অংশটি মেক্সিকো উপসাগর হিসেবেই থাকবে’। তিনি আরও বলেন, ‘কিউবানরা এই বিষয়ে তেমন মাথা ঘামায় না।’
নাম পরিবর্তনের প্রভাব
ফ্লোরিডাভিত্তিক সামুদ্রিক পরামর্শক পল ফোরান বলেছেন, নাম পরিবর্তনের ফলে নাবিকদের জন্য তেমন কোনও সমস্যা হবে না। তারা নেভিগেশন চার্ট ও রেডিওতে সঠিক স্থানাঙ্ক ও গতিবেগ জানালেই চলবে। তার কথায়, যদি কেউ রেডিওতে ‘আমেরিকা উপসাগর’ বলে, তাহলে অন্য নাবিকরা তাদের চার্টে মেক্সিকো উপসাগর দেখবে। তারা শুধু এটাই নিশ্চিত করবে যে তাদের জাহাজগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ না হয়।
ভবিষ্যৎ কী হতে পারে?
নিউ মেক্সিকো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ট্রুয়েট বলেছেন, ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হলে আবারও এই উপসাগরের নাম পরিবর্তন হতে পারে। তবে তিনি মজা করে বলেন, ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি যদি পুরো দেশে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে নিউ মেক্সিকো রাজ্যের নামও কি ‘নিউ আমেরিকা’ করা হবে? আমি এটা নিয়ে তেমন চিন্তিত নই।