গত বছর নির্বাচনি প্রচারণায় ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকানদের কাছে নতুন এক সমৃদ্ধির যুগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাস পরই তিনি একটু ভিন্ন চিত্র তুলে ধরছেন। তিনি সতর্ক করেছেন যে, মূল্যস্ফীতি কমানো কঠিন হবে এবং জনগণকে কিছুটা ‘অস্থিরতা’ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে, যতক্ষণ না তিনি দেশে সম্পদ ফিরিয়ে আনতে পারেন। এদিকে, বিশ্লেষকরা বলছেন, ট্রাম্পের নীতির কারণে মন্দার শঙ্কা বাড়ছে। তাহলে কি বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিতে ট্রাম্প মন্দা ডেকে আনতে যাচ্ছেন?
বাজারে ধস, মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে
যুক্তরাষ্ট্রে মন্দাকে সাধারণত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের দীর্ঘস্থায়ী ও ব্যাপক পতন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যেখানে বেকারত্ব ও আয় হ্রাসের প্রবণতা দেখা যায়। সম্প্রতি একদল অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সতর্ক করেছেন যে, এমন পরিস্থিতির ঝুঁকি বাড়ছে। জেপি মরগানের এক প্রতিবেদনে মন্দার শঙ্কা ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪০ শতাংশ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সতর্ক করা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ‘অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে সরে যাচ্ছে’। মুডি’স অ্যানালিটিক্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ মার্ক জ্যান্ডি ট্যারিফের কথা উল্লেখ করে মন্দার আশঙ্কা ১৫ শতাংশ থেকে ৩৫ শতাংশে বাড়িয়েছেন।
এই পূর্বাভাসগুলো এসেছে এমন সময়ে যখন যুক্তরাষ্ট্রের ৫০০ বৃহত্তম কোম্পানির সূচক পর্যালোচনাকারী সংস্থা এসঅ্যান্ডপি ৫০০-এর রেটিং তীব্রভাবে নিম্নমুখী হয়েছে। এটি এখন সেপ্টেম্বরের পর থেকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাজার অস্থিরতার পেছনে আংশিকভাবে ট্যারিফ বা আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির উদ্বেগ কাজ করছে, যা ট্রাম্প তার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে চালু করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তিন বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদারের পণ্যে নতুন শুল্ক আরোপ করেছেন এবং আরও ব্যাপকভাবে শুল্ক বাড়ানোর হুমকি দিয়েছেন। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এতে দাম বাড়বে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হবে।
ট্রাম্প ও তার অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা জনগণকে কিছু অর্থনৈতিক দুর্ভোগের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন। পাশাপাশি বাজার নিয়ে উদ্বেগকে খাটো করে দেখছেন। এটি তার প্রথম মেয়াদের চেয়ে স্পষ্ট পরিবর্তন। আগের শাসনামলে তিনি প্রায়শই শেয়ার বাজারকে তার সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে উল্লেখ করতেন। গত সপ্তাহে তিনি বলেছেন, সবসময় পরিবর্তন ও সমন্বয় থাকবে।
এই অবস্থান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে তার পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। গোল্ডম্যান স্যাক্স গত সপ্তাহে মন্দার শঙ্কা ১৫ থেকে ২০ শতাংশে বাড়িয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, নীতি পরিবর্তন অর্থনীতির জন্য ‘মূল ঝুঁকি’। তবে এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, হোয়াইট হাউজের এখনও ‘পিছু হটার সুযোগ রয়েছে, যদি নেতিবাচক ঝুঁকি আরও গুরুতর দেখায়’।
শুঙ্ক, অনিশ্চয়তা ও প্রবৃদ্ধি হ্রাস
অনেক কোম্পানির জন্য সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো ট্যারিফ, যা আমদানির ওপর শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক খরচ বাড়ায়। ট্রাম্প ট্যারিফ পরিকল্পনা উন্মোচন করায় অনেক কোম্পানি এখন কম মুনাফার মুখোমুখি হচ্ছে। পাশাপাশি বিনিয়োগ ও নিয়োগ স্থগিত করছে, কারণ তারা ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করছে।
বিনিয়োগকারীরা সরকারি কর্মীসংখ্যা ও সরকারি ব্যয় কমানো নিয়েও উদ্বিগ্ন। স্টিফেল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ওয়াশিংটন নীতি কৌশল প্রধান ব্রায়ান গার্ডনার বলেছেন, ব্যবসা ও বিনিয়োগকারীরা ভেবেছিলেন ট্রাম্প ট্যারিফকে আলোচনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ও তার মন্ত্রিসভা যা সংকেত দিচ্ছেন, তা আসলে আরও বড় কিছু। এটি আমেরিকান অর্থনীতির পুনর্গঠন। আর গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এটিই বাজারকে প্রভাবিত করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ইতোমধ্যেই কিছুটা মন্দার মুখোমুখি ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কারণে। সুদের হার বাড়িয়ে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ঠান্ডা করতে ও মূল্য স্থিতিশীল রাখতে চেষ্টা করা হয়েছে। সম্প্রতি কিছু তথ্য আরও দ্রুত দুর্বলতার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ফেব্রুয়ারিতে খুচরা বিক্রয় কমেছে, ভোক্তা ও ব্যবসায়িক জরিপে ট্রাম্পের নির্বাচনের পর যে আস্থা বেড়েছিল, তা আবার কমেছে। ওয়ালমার্ট ও টার্গেটের মতো খুচরা বিক্রেতা এবং উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো পিছু হটার সতর্কতা জানাচ্ছে।
কিছু বিশ্লেষক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন যে, শেয়ার বাজারে পতন উচ্চ আয়ের পরিবারগুলোর মধ্যে ব্যয় আরও কমিয়ে দিতে পারে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত হানতে পারে, যা ভোক্তা ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল এবং ধনী পরিবারগুলোর ওপর ক্রমবর্ধমানভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, কারণ নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান জেরোম পাউয়েল গত সপ্তাহে এক বক্তৃতায় আশ্বস্ত করেছেন যে, উচ্চ মাত্রার অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি এখনও ভালো অবস্থানে রয়েছে।
তবে এক্সটিবি’র গবেষণা পরিচালক ক্যাথলিন ব্রুকস সতর্ক করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বর্তমানে বিশ্বের অন্যান্য অংশের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তিনি বলেছেন, ট্যারিফ এই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারে, একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে... এটি সত্যিই মন্দার ভয় বাড়াচ্ছে।
শেয়ার বাজারের এই অস্থিরতা শুধু ট্রাম্পের কারণে নয়। গত দুই বছরে প্রযুক্তি শেয়ারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগকারীরা ইতোমধ্যেই সংশোধনের আশঙ্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, চিপ প্রস্তুতকারক কোম্পানি এনভিডিয়ার শেয়ারের দাম ২০২৩ সালের শুরুতে ১৫ ডলারের কম থেকে গত নভেম্বরে ১৫০ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছেছিল। এই ধরনের উত্থান ‘এআই বুদ্বুদ’ নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল, যা ফেটে যাওয়ার লক্ষণ দেখলেই বিনিয়োগকারীরা সতর্ক হয়ে যান। যা বৃহত্তর অর্থনীতির গতিশীলতা নির্বিশেষে শেয়ার বাজারে বড় প্রভাব ফেলবে।
এখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নিয়ে আশাবাদ ধরে রাখা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। ডিপওয়াটার অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের প্রযুক্তি বিশ্লেষক জিন মুনস্টার এই সপ্তাহে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন যে, গত এক মাসে মন্দার শঙ্কা ‘পরিমাপযোগ্যভাবে’ বেড়ে যাওয়ায় তার আশাবাদ ‘এক ধাপ পিছিয়ে গেছে’। তিনি বলেছেন, ‘মূল কথা হলো, যদি আমরা মন্দায় প্রবেশ করি, তাহলে এআই ট্রেড চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কঠিন হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি মন্দার দিকে যাচ্ছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি, ট্যারিফ, বাজার অস্থিরতা এবং বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সংযোগ মন্দার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের মধ্যে এখনও মতভেদ রয়েছে। আগামী দিনগুলোতে ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
সূত্র: বিবিসি