ভারত ও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সামরিক উত্তেজনা শুধু দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংঘর্ষ নয়; এর পেছনে স্পষ্ট হয়ে উঠছে বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৈশ্বিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। দক্ষিণ এশিয়ার এই সংঘাত এখন আরও জটিল হয়েছে দুই পরাশক্তির অস্ত্র এবং কৌশলগত সমর্থনের প্রতিযোগিতায়। দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি এখন শুধু আঞ্চলিক বিষয় নয়, বরং বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতকে আর কেবল সীমান্ত বিরোধ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই; এটি এখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রভাব বিস্তারের একটি প্রতিচ্ছবি। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এই চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯ সালের মতোই, এবারও কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলার জেরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে নতুন করে সংঘর্ষের সূচনা হয়েছে। তবে পার্থক্য হচ্ছে—এই উত্তেজনার ভেতরে ঢুকে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের অস্ত্র সরবরাহ এবং কৌশলগত সমর্থনের নতুন মাত্রা।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত ঘনিষ্ঠতা ও চীন-পাকিস্তান মিত্রতা
ঐতিহাসিকভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা জোটের ঘনিষ্ঠ সামরিক অংশীদার হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, আফগানিস্তান যুদ্ধ-পরবর্তী বাস্তবতায় পাকিস্তানের গুরুত্ব কমে যাওয়ায় তারা আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে চীনের ওপর।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, গত চার বছরে পাকিস্তানের প্রায় ৮০ শতাংশ অস্ত্র এসেছে চীন থেকে, যেখানে ২০০০-এর দশকে এই হার ছিল ৩৮ শতাংশ।
পারমাণবিক উদ্বেগ ও ২০১৯-এর অভিজ্ঞতা
২০১৯ সালে ভারতের বালাকোট বিমান হামলা ও পাকিস্তানের পাল্টা জবাবের সময় দুই দেশ তাদের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে সরব হলে, যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও মধ্যরাতে ফোন করে উভয়পক্ষকে শান্ত রাখার চেষ্টা করেন। এই ধরনের উত্তেজনার পুনরাবৃত্তি নিয়ে এবারও উদ্বেগ বাড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা লিন্ডসে ফোর্ড বলেন, যদি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ভবিষ্যতে সংঘর্ষ হয়, তবে সেটি হবে মূলত মার্কিন ও ইউরোপীয় প্রযুক্তির ভারত এবং চীনা প্রযুক্তির পাকিস্তানের মধ্যে লড়াই।
অস্ত্রের পালাবদল ও ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তন
একসময় রাশিয়া ছিল ভারতের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী। ২০০৬-১০ সাল পর্যন্ত ভারতীয় অস্ত্রের ৮০ শতাংশই এসেছিল রাশিয়া থেকে। তবে সাম্প্রতিক চার বছরে এই হার নেমে এসেছে ৩৮ শতাংশে। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েল থেকে অস্ত্র আমদানি বেড়েছে। অন্যদিকে, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র থেকে মুখ ফিরিয়ে চীনের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। শুধু একটি ব্যতিক্রম—এফ-১৬ যুদ্ধবিমান।
২০২২ সালে বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের জন্য প্রায় ৪০০ মিলিয়ন ডলারের এফ-১৬ রক্ষণাবেক্ষণ চুক্তি অনুমোদন করে। যদিও ২০১৯ সালে পাকিস্তান এফ-১৬ দিয়ে একটি রুশ-নির্মিত ভারতীয় জেট গুলি করে নামানোর পর ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রতিবাদ জানায়।
নতুন জোট, পুরনো শত্রুতা
যুক্তরাষ্ট্র এখন ভারতকে চীনের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা দিয়ে শক্তিশালী করছে। অপরদিকে, চীন পাকিস্তানকে ‘অবিচল মিত্র’ হিসেবে অভিহিত করে কৌশলগত সহায়তা বাড়িয়ে চলেছে।
সম্প্রতি কাশ্মীরে হামলার পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একাধিক আন্তর্জাতিক নেতার সঙ্গে কথা বললেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয় দেরিতে। এটি রাশিয়ার প্রভাব কমে যাওয়ার ইঙ্গিত বলে মনে করছে কূটনৈতিক মহল।
অস্থিতিশীল বাস্তবতা
দুই পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তান—প্রতিনিয়ত সীমান্ত উত্তেজনার মধ্যে থাকে। সামরিক ভুল, ভুল বার্তা বা হঠাৎ কোন উসকানিতে সংঘাত সহজেই সর্বাত্মক যুদ্ধে রূপ নিতে পারে। এই বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার অস্ত্র প্রতিযোগিতা এই অঞ্চলের নিরাপত্তা আরও নাজুক করে তুলছে।
কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস-এর সিনিয়র ফেলো অ্যাশলে টেলিস বলেন, ভারতের নিরাপত্তা এখন যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক, আর পাকিস্তানের জন্য সেই ভূমিকাটি পালন করছে চীন।