X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বাসমতি চাল নিয়ে ভারত-পাকিস্তানের লড়াই

বিদেশ ডেস্ক
০৭ জুন ২০২১, ১৯:৩০আপডেট : ০৭ জুন ২০২১, ২২:২৯

স্বাদে ও গন্ধে অতুলনীয় বাসমতি চাল নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশ পাকিস্তান ও ভারত। দুই দেশেরই বিশেষ কিছু অঞ্চলে এই চাল উৎপাদন হয়। তবে বিপত্তি বেধেছে দিল্লির পক্ষ থেকে এটিকে ‘ভারতীয় পণ্য’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর কাছে আবেদনের পর। ওই আবেদনে ভারতকে চালটির প্রটেক্টেড জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন (পিজিআই) দিতে ইইউ-এর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। অন্যদিকে এর বিরুদ্ধে জোরালো আপত্তি জানিয়েছে পাকিস্তান। দেশটি বলছে, শুধু ভারতে নয়, এই একই চাল পাকিস্তানেও উৎপাদিত হয়। ফলে এটিকে শুধু ভারতীয় পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া উচিত হবে না।

পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই চালকে শুধু ভারতীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হলে তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এজন্য পাল্টা ব্যবস্থা নিতে নিজ দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা। পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লাহোর। সেখানকার আল বারকাত রাইস মিলসের অন্যতম মালিক গুলাম মুর্তাজা। তিনি বলেন, ভারতের ওই আবেদন যেন আমাদের ওপর পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের মতো ঘটনা। ভারতীয় কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, ভারতের এই আবেদনে পাকিস্তানের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনও কারণ নেই। পাকিস্তান চাইলে ভারতের মতো তারাও এই পণ্যটিকে নিজেদের দাবি করে আবেদন করতে পারে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাসমতি চালের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক এবং পাকিস্তান ও ভারত এই দুটো দেশই এই জোটের দেশগুলোর কাছে প্রচুর পরিমাণে বাসমতি চাল রফতানি করে থাকে।

জাতিসংঘের হিসাবে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় চাল রফতানিকারক দেশ ভারত। এ থেকে দেশটির বার্ষিক আয় ৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। এ তালিকায় পাকিস্তানের অবস্থান চতুর্থ। বছরে ২ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের চাল রফতানি করে দেশটি। তবে বাসমতি চাল শুধু এই দুটি দেশই রফতানি করে। লাহোরের আল বারকাত রাইস মিলসের অবস্থান ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে। মিলটির অন্যতম মালিক গুলাম মুর্তাজা বলেন, ‘ভারত এসব গোলমাল করছে যাতে তারা যেকোনোভাবে আমাদের টার্গেট মার্কেটের দখল নিতে পারে। আমাদের পুরো চাল শিল্পে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।’ 

ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেই এই চালের বেশ কদর রয়েছে। বিরিয়ানি তৈরিতে বা বিয়েসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের রান্নায় এটি ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে।

অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাজার

ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে গত তিন বছর ধরে বাসমতি চাল রফতানি করছে পাকিস্তান। চাল উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইইউ-এর বেঁধে দেওয়া কঠোর নীতিমালা পূরণে ভারতের দুর্বলতা এক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সুযোগ এনে দিয়েছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, ইইউ-তে বছরে এই চালের যে তিন লাখ টনের চাহিদা রয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশই পূরণ করে পাকিস্তান। পাকিস্তানি বাসমতি অধিক অর্গানিক এবং মানসম্মত বলে মনে করেন পাকিস্তান রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মালিক ফয়সাল জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বাজার।’

পাকিস্তানের উদ্বেগ

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির, বেলুচিস্তান ও পাঞ্জাবে উৎপাদিত বাসমতি চালের খ্যাতি রয়েছে ইউরোপের বাজারে। করাচিভিত্তিক সংবাদপত্র বিজনেস রেকর্ডারের সাংবাদিক তানভীর মালিক বলেন, ‘পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে দিল্লিকে এই ট্যাগ দেওয়া হলে ইউরোপীয় ইউনিয়নে পাকিস্তানের বাসমতি চাল রফতানির বাজারে বড় ধরনের ধস নামবে।’ ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশের পর পাকিস্তান সরকারও ভারতীয় আবেদনের জবাবে ইইউ-এর কাছে পাল্টা আবেদন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশটির কর্মকর্তাদের আশা, ভারতের এই আবেদন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হবে। তারা বলছেন, সফল কূটনীতির মাধ্যমে তারা দিল্লির এই পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেবেন।

পিজিআই আইন কী

পণ্যটির উৎস, উৎপত্তি, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি এই আইনটিতে নিশ্চিত করা হয়। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলোকে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই আইনটি গ্রহণ করতে হয়। এর আওতায় যে পণ্যটির গায়ে পিজিআই ট্যাগ থাকবে সেটি যে অঞ্চলে উৎপন্ন হয় সেই এলাকা ছাড়া ওই পণ্যের নাম আর কেউ ব্যবহার করতে পারবে না। ভারতের যে পণ্যটিতে সর্বপ্রথম এই জিআই ট্যাগ লাগানো হয় সেটি হচ্ছে দার্জিলিং চা। এরপর এই তালিকায় আরও তিন শতাধিক পণ্য যুক্ত হয়েছে। এখন তাদের টার্গেট বাসমতি চাল।

পাকিস্তানের আপত্তি

পাকিস্তানের একজন চাল রফতানিকারক এবং চাল রফতানিকারক সমিতির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান তৌফিক আহমেদ খান বিবিসি উর্দু সার্ভিসকে বলেছেন, বাসমতি চালকে ভারতীয় পণ্য হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার জন্য দিল্লি কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হওয়ার আগের দলিলপত্রের ওপর ভিত্তি করে তারা যুক্তি দিতে চাইছে যে বাসমতি চাল তাদের নিজেদের পণ্য। তৌফিক আহমেদ খান বলেন, ‘পাকিস্তানের যেসব অঞ্চলে বাসমতি চাল উৎপন্ন হয় সেগুলো একসময় ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল এবং ভারত এখন এই কৌশলের আশ্রয় নিয়ে বাসমতি চালকে নিজেদের পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করছে।’

কী বলছে ভারত

ভারত বলছে, এ নিয়ে পাকিস্তানের উদ্বেগের কিছু নেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘ভারত ও পাকিস্তানের সরকারি পর্যায়ে এ নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে। বাসমতি চাল এই দুটো দেশেই উৎপাদিত হয়। দুটো দেশেরই পণ্য এই চাল। ভারত স্বীকৃতি চেয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আবেদন করেছে। পাকিস্তান চাইলে তারাও সেটা করতে পারে। এখানে তো বিরোধের কিছু নেই।’

ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, চীন ও কেনিয়ায় সবচেয়ে বেশি চাল রফতানি করে পাকিস্তান। তার মধ্যে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন বাসমতি চাল, চীন সব ধরনের চাল আমদানি করে থাকে। পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে বাসমতি চাল রফতানি করে ভারত। কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে ভারতের বাসমতি চাল রফতানি হয় খুবই কম। ভারতের বাসমতি চাল বিশেষজ্ঞ এবং ভারতের কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান অশোক কুমার সিং বলেন, ‘ভারত সারা বিশ্বে যত বাসমতি চাল রফতানি করে তার ৭৫ শতাংশই করা হয় মধ্যপ্রাচ্যে। ভারতের জন্য বাসমতি চালের সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব ও ইরান।’

পাকিস্তানের উদ্বেগের কারণ কী

পাকিস্তানের চাল রফতানিকারক তৌফিক আহমেদ খান মনে করেন, অসৎ উদ্দেশ্য থেকেই ভারত বাসমতি চালকে নিজেদের পণ্য বলে দাবি করছে। তিনি বলেন, ভারত যদি এতে সফল হয় তাহলে সবচেয়ে খারাপ যেটা হতে পারে তা হলো ভারত হয়তো পাকিস্তানকে বাসমতি নাম ব্যবহার করতে বাধা দিতে পারে। তখন হয়তো পাকিস্তান তার চালের ব্যাগ কিংবা প্যাকেটের গায়ে বাসমতি নামটি ব্যবহার করতে পারবে না। বাসমতি নামটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হলেও এই নামের জন্য ভারতকে হয়তো রয়্যালটি দেওয়া লাগতে পারে। ইন্ডিয়ান রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি বিজয় সেতিয়া। তিনি বলেন, ‘ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই প্রায় ৪০ বছর ধরে বিভিন্ন বাজারে রফতানি ও প্রতিযোগিতা করে আসছে। আমার মনে হয় না, পিজিআই-এর ফলে এর কোনও পরিবর্তন ঘটবে।’

যৌথ ঐতিহ্য

ইউরোপীয় কমিশনের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়ম অনুযায়ী ভারত তিন মাসের মেয়াদ বাড়ানোর কথা বলার পর সেপ্টেম্বরের মধ্যে দুই দেশকে একটি সমাধানে পৌঁছানোর জন্য আলোচনার চেষ্টা করতে হবে। আইনজীবী ও গবেষক ডেলফাইন মেরি-ভিভিয়েন বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে, খ্যাতি ও ভৌগোলিক এলাকা বিচারে বাসমতি ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেই প্রচলিত। ইতোমধ্যে ইউরোপে ভৌগোলিক ইঙ্গিত প্রয়োগের বিরোধিতার বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে এবং প্রতিবারই কোনও সমঝোতা হয়েছে।

পাকিস্তান রাইস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট মালিক ফয়সাল জাহাঙ্গীর বলেন, পাকিস্তানের প্রত্যাশা তারা ভারতকে একটি ‘যৌথ আবেদনের’ ব্যাপারে রাজি করাতে পারবে, যেখানে বাসমতিকে দুই দেশের যৌথ ঐতিহ্য হিসেবে উল্লেখ করা হবে। তার ভাষায়, ‘আমি বিশ্বাস করি যে আমরা খুব শিগগিরই একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবো। পুরো দুনিয়া জানে যে, বাসমতি চাল উভয় দেশ থেকেই আসে।’

পাকিস্তান ও ভারত যদি শেষ পর্যন্ত কোনও সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভারতের পক্ষে রায় দেয়, সেক্ষেত্রে পাকিস্তান ইউরোপিয়ান কোর্টে আপিলের সুযোগ পাবে। তবে সেখানকার দীর্ঘ পর্যালোচনা প্রক্রিয়া পাকিস্তানের বাসমতি শিল্পকে বিপাকে ফেলে দিতে পারে। সূত্র: আল জাজিরা, বিবিসি।

/এমপি/এমওএফ/
সম্পর্কিত
কলকাতা স্টেশনে অর্থ পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার বাংলাদেশি
ভারতের মসলা নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র
হেলিকপ্টারের সিটে বসতে গিয়ে পড়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সর্বশেষ খবর
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু