চব্বিশেই লোকসভার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা ভোটের দাবি বেশ কয়েক মাস ধরে করে আসছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। এবার লোকসভার আগেই বিধানসভা ভোট হতে পারে, এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। এর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি পাঠিয়ে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদল, কেন্দ্রীয় অনুদানে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়েছেন তিনি। শুভেন্দুর এই ইঙ্গিত আর চিঠি ঘিরে রাজ্য রাজনীতি শুরু হয়েছে নয়া জল্পনা।
বিজেপির বিভিন্ন কর্মসূচিতে শুভেন্দু বলছিলেন, লোকসভার সঙ্গে বিধানসভার ভোট একসঙ্গে হবে চব্বিশে। তার পাশাপাশি একই বক্তব্য রাখছিলেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারসহ গেরুয়া শিবিরের নেতারা। কিন্তু শিক্ষা দফতরের দুর্নীতি নিয়োগ মামলায় শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এই মুহুর্তে ব্যাকফুটে। ঠিক সেই সময়ে শুভেন্দুর এই মন্তব্য যথেষ্ট তাপর্যৎপূর্ণ বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্জায়েত ভোট। তারপর চব্বিশে লোকসভা নির্বাচন। তার দুই বছর পর ২০২৬-এ বিধানসভা ভোট হওয়ার কথা।
একুশের বিধানসভা ভোটের পরাজয়ের ক্ষত খুব দ্রুত সারিয়ে বাংলার রাজনীতিতে ফিরে আসতে মরিয়া গেরুয়া শিবির। এরইমধ্যে শিক্ষা দফতরের দুর্নীতি নিয়োগ মামলায় পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ইডির হাতে গ্রেফতার, বিপুল রুপি উদ্ধারের ঘটনা বিজেপির মরা গাঙে জোয়ার তুলছে। প্রায় প্রতিদিনই দুর্নীতি ইস্যুতে সুর চড়া করে রাজ্যজুড়ে আন্দোলন শুরু করে দিয়েছে গেরুয়া শিবির।
এ সপ্তাহে শুভেন্দু অধিকারী দিল্লিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ করেছেন। এ সময় শিক্ষা দফতরের দুর্নীতিতে যুক্ত ১০০ জন তৃণমূল নেতার তথ্যপ্রমাণ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছেন বলে জানান শুভেন্দু।
এরইমধ্যে শুভেন্দু বলেছেন, ‘চব্বিশে লোকসভা এবং বিধানসভা ভোট একসঙ্গে তো হচ্ছেই। কিন্তু যা পরিস্থিতি তাতে বিধানসভা ভোট কি ওতদিন (লোকসভা ভোট) পর্যন্ত যাবে? দেখতে থাকুন। শুধু পার্থই নন, আসন্ন দুর্গা পূজার সময় তৃণমূলের অনেককেই জেলে থাকতে হবে।’
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠকে দাবি করেছেন, ৩১ জুলাই পর্যন্ত ১০০ দিনের কাজ, গ্রামীণ সড়ক, আবাস যোজনার মতো বিভিন্ন খাতে কেন্দ্রের কাছে রাজ্যের বকেয়া এক লাখ ৯৬৮ কোটি টাকা। মুখ্যমন্ত্রীর সেই দাবির ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে রাজ্যের বিরুদ্ধে একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদল, কেন্দ্রীয় অনুদানে আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তার দাবি, ভবিষ্যতে কেন্দ্রীয় অনুদান বরাদ্দ করার আগে যেন ভালোভাবে খতিয়ে দেখা হয়। কারণ নাগরিকদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক প্রকল্প কার্যকর করার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হয়েছে। ১০০ দিনের কাজ থেকে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার মতো প্রকল্পে কেন্দ্রের বরাদ্দ তহবিল তছরুপ হয়েছে।
কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদলের একটি তালিকা পাঠিয়েছেন শুভেন্দু। নন্দীগ্রামের বিধায়ক পরিবর্তিত নামের যে তালিকা দিয়েছেন তাতে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা, প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা, প্রধানমন্ত্রী জল যোজনা মিশন, স্বচ্ছ ভারত অভিযান, ওয়াটার শেড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ও ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশন - ৭টি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের কথা বলা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার নাম বদলে হয়েছে বাংলা আবাস যোজনা, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা হয়েছে বাংলা গ্রাম সড়ক যোজনা। প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা হয়েছে খাদ্যসাথী, প্রধানমন্ত্রী জল যোজনা মিশন হয়েছে জলস্বপ্ন।
স্বচ্ছ ভারত অভিযান হয়েছে নির্মল বাংলা, ওয়াটার শেড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম হয়েছে জল ধরো জল ভরো, ন্যাশনাল রুরাল লাইভলিহুড মিশন হয়েছে আনন্দধারা।
প্রধানমন্ত্রীকে চিঠিতে শুভেন্দু লিখেছেন, ‘দিনের পর দিন এই দুর্নীতি হয়ে চলেছে। ১০০ দিনের কাজ দিয়ে গরিব মানুষকে রুপি দেওয়ার কথা ছিল। অথচ কোনও কাজ না দিয়েই রুপি খরচ করা হয়েছে। আর তা প্রমাণ করতে ভুল প্রশংসাপত্রও দেওয়া হয়েছে।’
১০০ দিনের কাজের আওতায় বৃক্ষরোপণের প্রসঙ্গ টেনে এনে শুভেন্দুর অভিযোগ, ‘নথিতে রাজ্য সরকার দেখিয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে ম্যানগ্রোভ ও অন্য চারাগাছ রোপণ করা হয়েছে। কর্মকর্তারা যখন পরিদর্শনে যান, তখন রাজ্যের তরফে বলা হয় ইয়াস, আমপান এবং অন্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে চারাগাছ নষ্ট হয়ে গেছে। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা গাছ দেখিয়ে দাবি করা হয়, ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পের অধীনে এসব গাছ রোপণ করা হয়েছে।’ উদাহরণস্বরূপ তিনি উল্লেখ করেন, ‘জয়নগর-২ ব্লক, কুলতলি বিধানসভা কেন্দ্র এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার বেশকিছু এলাকায় এই ঘটনা হয়েছে।’
প্রশ্ন উঠছে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরদিনই কেন শুভেন্দু চিঠি লিখলেন মোদিকে? কারণটা রাজনৈতিক বলেই মনে করছে অভিজ্ঞ মহল। এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি কাণ্ডে গ্রেফতার হয়েছেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। বিপুল রুপি উদ্ধার হয়েছে পার্থ ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের ফ্ল্যাট থেকে। রাজ্যজুড়ে বিজেপি যখন এই ইস্যুতে তৃণমূলকে কোণঠাসা করতে ব্যস্ত তখন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠক যাতে অন্য সমীকরণের ইঙ্গিত না দেয়, সেই জন্যই শুভেন্দুর এই পদক্ষেপ।