গ্রামীণ বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতির কারণে একুশের বিধানসভার মতো একচেটিয়াভাবে মুসলিম ভোট এবার তৃণমূলে যাবে না। তাই মুসলিম অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গের মুশির্দাবাদের সাগরদিঘি বিধানসভার উপনির্বাচনে ভোট ভাগ হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে বলেই মনে করছিল গেরুয়া শিবির। সেই আশঙ্কাই সত্যি হলো, তৃণমূল প্রার্থীকে হারিয়ে আসনটি জিতে নিলেন কংগ্রেসের বাইরন বিশ্বাস। বিজেপির মতে, এটা তৃণমূলের পক্ষে অশনি সংকেত। এতদিন বিজেপির ভূত দেখিয়ে মুসলিম সমাজের একচেটিয়া ভোট নিয়ে নবান্ন দখলের লড়াইয়ে এবার প্রশ্ন উঠে গেলো। অপরদিকে, এভাবে মুসলিম ভোট ব্যাংক ভাঙতে থাকলে আসন্ন পঞ্চায়েত ও পরবর্তীতে চব্বিশের লোকসভা ভোটে তৃণমূলকে ব্যাপক ধাক্কা দেওয়া সম্ভব বলেই মনে করছেন মুরুলিধর সেন লেনের কর্তারা।
সাগরদিঘি বিধানসভা কেন্দ্রে মুসলিম ভোটারই বেশি। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, সাগরদিঘিতে মুসলিম জনসংখ্যার হার ৬৪.৬৭ শতাংশ। আর হিন্দু জনসংখ্যার হার ৩১.৫৫ শতাংশ। ১.৮৫ শতাংশ রয়েছেন খ্রিস্টান। একুশের বিধানসভা ভোটের নিরিখে দেখা যাচ্ছে, এখানে মুসলিম ভোটের বেশিরভাগ গিয়েছিল তৃণমূলের দিকে। তৃণমূল প্রার্থী প্রয়াত সুব্রত সাহা পেয়েছিলেন মোট ভোটের ৫০.৯৫ শতাংশ। অপরদিকে, বিজেপি প্রার্থী মাফুজা খাতুন দ্বিতীয় স্থানে থেকে পেয়েছিলেন ২৪.০৮ শতাংশ, কংগ্রেস প্রার্থী শেখ এম হাসানুজ্জামান ১৯.৪৫ শতাংশ ও ওয়েসির দল মিমের প্রার্থী নুরে আলমের জামানত জব্দ হয়েছিল। তিনি পেয়েছিলেন মাত্র ১.৮৫ শতাংশ ভোট। এই ফলে এটা পরিষ্কার একুশের ভোটে কংগ্রেস বা মিম কেউই মুসলিম ভোটে বিভাজন করতে সক্ষম হননি। একচেটিয়াভাবে মুসলিম ভোট পেয়ে তৃণমূল এখানে জয় সুনিশ্চিত করেছিল একুশের বিধানসভায়। কিন্তু দু’বছরের মাথায় ফল উল্টে গেলো। কংগ্রেসের প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস ভোট বাড়িয়ে পেলেন ৮৭,৬৬৭ ( ৪৭.৩৫ শতাংশ), তৃণমূলের দেবাশিষ বন্দ্যোপাধ্যায় ৬৪,৬৮১ (৩৪.৯৩ শতাংশ) আর বিজেপির দিলীপ সাহা ২৫,৮১৫ (১৩.৯৪ শতাংশ) ভোট।
সাধারণত উপনির্বাচনে শাসক দলই জেতে। কিন্তু সাগরদিঘিতে সব হিসাব উল্টে দিলেন বাইরন বিশ্বাস। কীভাবে এই জয় এলো? তা বলতে গিয়ে বিজেপির মুশির্দাবাদ উত্তর সাংগঠনিক জেলার সংখ্যালঘু মোর্চার সভাপতি সাগরদিঘির বাসিন্দা বদিউর জামান বলেন, ‘এখানে তৃণমূল ভালো অবস্থায় ছিল না। আবাস যোজনার কেলেঙ্কারি সাগরদিঘিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই বিধানসভার ১১টি গ্রামপঞ্চায়েতের প্রধান তাদের পরিবার, আত্মীয়স্বজনের নামে দুর্নীতি করে ঘর নিয়েছেন। খাতায়-কলমে ঘর পেলেও দেখা গেছে ব্যাংক অ্যাকউন্টের নাম পরিবর্তন করে অন্যকে ঘর দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে গরিব মুসলিমদের মধ্যে। এর ফল ভোট বাক্সে এসেছে। পাশাপাশি বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকীর জেলে যাওয়াটাও এখনকার মুসলিমরা ভালোভাবে নেননি। সেটাও তারা বলছিলেন। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে সভা করতে এসে বলেছিলেন, মুসলিমরা তৃণমূলকে ভোট দেবেন না, তারা বেইমান। এই কথায় মুসলিমদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। তাছাড়া ওই সভায় এখানকার তৃণমূলের সাংসদ প্রবীণ খলিলুর রহমানকে মঞ্চে ব্যানার ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখাটা এখানকার মুসলিম সমাজ ভালোভাবে নেয়নি। এতে মুসলিমরা আঘাত পেয়েছিলেন। একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে তৃণমূলের হাতে মুসলিমদের ভবিষৎ কী হতে পারে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। বিজেপির এনআরসি জুজু দেখানো এবার আর কাজে আসেনি তৃণমূলের। মুসলিমরা স্থানীয় ইস্যুকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। কংগ্রেস সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলেও, প্রচারে প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস প্রচারে এগিয়ে ছিলেন। তৃণমূলের ভোট এবার নিশ্চিত ভাবেই কেটে দেবে কংগ্রেস এটা বোঝাই যাচ্ছিল। ’
তাহলে বিজেপির ভোট কমলো কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে বিজেপির সংখ্যালঘু মোর্চার সাবেক সভাপতি আলি হাসান বলেন, ‘কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থী দেওয়াটা একটা বড় ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। যার ফলে মুসলিম ভোট আমরা সেভাবে পাইনি। গতবার যেটা পেয়েছিলাম। কিন্তু মুসলিম ভোট যে তৃণমূলের হাত ছাড়া হতে শুরু করেছে এটা তার প্রমাণ। এর প্রভাব পঞ্চায়েত আর লোকসভায় পড়তে বাধ্য।’
পদ্মশ্রী কাজি মাসুম আখতারের দাবি, ‘এটা মুসলিমদের বিলম্বিত বোধদয়। এটা গোটা রাজ্যে যত দ্রুত ছড়ায় ততই মঙ্গল। যেটা আমার মতো কয়েকজন দীর্ঘদিন ধরে মুসলিম সমাজকে বলে আসছিলেন। তৃণমূলের এই হার জানাই ছিল। এই বিজেপি আসছে, মুসলিমদের তাড়িয়ে দেবে! বলে যে চক্রান্ত এতদিন চালানো হচ্ছিল এটা তার বিরুদ্ধে ভোট। এদিন হাইকোর্টে নওশাদ জিতল আর সাগরদিঘিতে বাইরন জিতলো। রাজ্যে মুসলিমদের কোনও উন্নয়ন হয়নি। ভোট নেওয়ার জন্য বারবার এনআরসির জুজু দেখানো হয়েছে। ফুরফুরাকে অপমানের জবাবও দিল সাগরদিঘি।’
এই জয়ের ফলে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় একুশের পর প্রথম খাতা খুললো কংগ্রেস। এই আসনটি কংগ্রেসকে সমর্থন করেছিল সিপিএম। তাই বাম সমর্থকরা ব্যাপক উল্লসিত। কিন্তু এতে সিপিএমের কতটা লাভ হলো? এমন প্রশ্নের উত্তরে সাবেক সিপিএম নেতা বর্তমানে পিডিএসের সহ-সভাপতি সমীর পুততু বলেন, ‘আলাদা করে ধরতে গেলে কোনও লাভই হবে না। যৌথ লড়াই করলে লাভ হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই নয়, সিপিএম আবার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসবে। একই দিনে ত্রিপুরায় এত আশা জাগিয়ে ভরাডুবিটাও বলতে হবে। যেখানে আসনও কমেছে, ভোট শতাংশও কমেছে সিপিএমের। তৃণমূলের থেকে মুসলিম ভোট সরে গিয়েছে নওশাদ ইস্যুতে। আর এ নিয়ে বেশি হিন্দু-মুসলিম করলে বিজেপিরই লাভ হবে আখেরে। এটা সিপিএমকে বুঝতে হবে।’