লেবাননে পেজার এবং ওয়াকি-টকি ব্যবহার করে সংঘটিত বিস্ফোরণগুলো বৈশ্বিক প্রযুক্তি পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এ বিষয়ে সরকার বা অন্যান্য পক্ষের হস্তক্ষেপের ঝুঁকি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। এই ধরনের প্রযুক্তি পণ্যের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা ভবিষ্যতের জন্য একটি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এই ঘটনাকে তারদের সরবরাহ নেটওয়ার্ক সুরক্ষার গুরুত্বের ওপর বড় ধরনের হুমকি হিসেবে দেখছে। এই হামলা সাধারণ জনগণের প্রযুক্তির প্রতি আস্থা কমাতে পারে বলেও মনে করছেন তারা।
যেকোনও কোম্পানি যারা ফিজিক্যাল ডিভাইস তৈরি বা বিক্রি করে, তারা এখন তাদের সরবরাহ নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত থাকবে, বলেছেন কর্নেল টেক এবং কর্নেল ল স্কুলের ডিজিটাল ও তথ্য আইনের অধ্যাপক জেমস গ্রিমেলম্যান।
‘তারা সম্ভবত অতিরিক্ত সুরক্ষা এবং যাচাই করার কথা ভাববে, যাতে ভবিষ্যতে এমন পদক্ষেপগুলোকে সনাক্ত এবং প্রতিরোধ করা যায়।’
ইসরায়েল এর আগেও এই ধরনের হামলায় জড়িত ছিল। ১৯৯৬ সালে হামাস বোমা প্রস্তুতকারক ইয়াহিয়া আয়্যাশকে একটি বিস্ফোরক যুক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করে হত্যা করা হয়েছিল। তবে, লেবাননে সম্প্রতি সংঘটিত হাজার হাজার ডিভাইসের বিস্ফোরণ ছিল নজিরবিহীন।
লেবানন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মঙ্গলবার এবং বুধবারের বিস্ফোরণগুলোতে কমপক্ষে ৩২ জন নিহত এবং ৩ হাজার ১০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছে, যার মধ্যে হিজবুল্লাহর সদস্য এবং সাধারণ নাগরিকও রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সান্তা ক্লারা ইউনিভার্সিটির মার্ককুলা সেন্টার ফর অ্যাপ্লাইড এথিক্স-এর প্রযুক্তি নীতিশাস্ত্রের পরিচালক ব্রায়ান প্যাট্রিক গ্রীন বলেন, ‘কীভাবে হাজার হাজার ডিভাইস অস্ত্রে রূপান্তরিত হলো, তা কেউই টের পেল না। এই বিস্ফোরক ডিভাইসগুলো কতটা ছড়িয়ে আছে? কীভাবে এই বিস্ফোরকগুলো ডিভাইস বা সরবরাহ নেটওয়ার্কে ঢুকে গেল? এই আক্রমণ ভীতিকর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে যা আগে কখনও বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।’
পেজার এবং ওয়াকি-টকিগুলোকে কীভাবে বিস্ফোরক ডিভাইসে পরিণত করা হয়েছিল তা স্পষ্ট না হলেও, লেবানিজ এবং মার্কিন কর্মকর্তারা বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা এই ডিভাইসগুলোতে বিস্ফোরক পদার্থ বসিয়েছিল।
অবশ্য ইসরায়েল এই ঘটনার দায় স্বীকার বা অস্বীকার করার বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি।
তাইওয়ানের কোম্পানি গোল্ড অ্যাপোলো ব্র্যান্ডের পেজারগুলো এই আক্রমণে ব্যবহৃত হয়েছিল বলে জানা গেছে। তবে বুধবার কোম্পানিটি এই মারাত্মক ডিভাইস তৈরির অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
কোম্পানিটি জানিয়েছে,পেজারগুলো বিএসি নামের হাঙ্গেরির বুদাপেস্টভিত্তিক একটি কোম্পানি তৈরি করেছে। অ্যাপোলো গোল্ডের লাইসেন্স ব্যবহারের অনুমতি আছে কোম্পানিটির।
অবশ্য এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি বিএসি কোম্পানি।
বৃহস্পতিবার নিউ ইয়র্ক টাইমস তিনজন অজ্ঞাত গোয়েন্দা কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে, বিএসি একটি ইসরায়েল ভিত্তিক কোম্পানি ছিল, যা বিস্ফোরক পেজার তৈরি করতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
এদিকে, জাপানভিত্তিক রেডিও সরঞ্জাম নির্মাতা আইকম জানিয়েছে, তারা প্রায় ১০ বছর আগে হামলায় ব্যবহৃত রেডিওগুলোর উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিল। তাই এটি আমাদের কোম্পানি থেকে পাঠানো হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
ক্যালিফোর্নিয়া পলিটেকনিক স্টেট ইউনিভার্সিটির ইথিক্স ও ইমার্জিং সায়েন্সেস গ্রুপের পরিচালক প্যাট্রিক লিন বলেছেন, ডিভাইসগুলো সরবরাহ নেটওয়ার্কের কোন পর্যায়ে ভেঙে গেছে তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে।
তিনি বলেন,এটা কি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময় হয়েছে, নাকি পরিবহনকালে বা সিস্টেম অপারেটরের স্তরে?
যদি এটি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সময় ঘটে থাকে, তাহলে অন্যান্য প্রযুক্তি নির্মাতাদের আরও বেশি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত, কারণ অন্য উপায়গুলো তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মেনার্ড বলেছেন, অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলি এমন কৌশলগুলোকে ‘ভয় সৃষ্টির এবং তাদের অ্যাজেন্ডা এগিয়ে নেওয়ার একটি সম্ভাব্য উপায়’ হিসেবে বিবেচনা করতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ‘এর মাধ্যমে এক নতুন ধরনের সন্ত্রাসী অভিযানের দরজা খুলে গেল– যেখানে ব্যক্তিরা এই শঙ্কায় পড়তে পারে যে তাদের পকেটের ডিভাইসটি বা তাদের সন্তানের হাতে থাকা ডিভাইসটি ধ্বংসের অস্ত্র হিসেবে পরিণত হতে পারে।’
অবশ্য পালটা যুক্তিও দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, এখন পর্যন্ত এ ধরনের আক্রমণ অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং চ্যালেঞ্জিং হবে। কারণ বাজারের প্রচলিত মোবাইল ফোন বা অন্যান্য ডিভাইসকে অস্ত্র হিসেবে রূপান্তর করা সহজ নয়।কিন্তু যেহেতু এখন এই ধারণাটি সামনে এসেছে তাই এই সম্ভাবনা হয়ত আরও বৃদ্ধি পাবে।