বছরের পর বছর ধরে ইসরায়েল এবং ইরান সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে গেছে। ইসরায়েল গোপনে তেহরানের ক্ষতি করেছে। ইরানি কর্মকর্তা ইসরায়েলি গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছে। যদিও এসবের দায় স্বীকার করেনি ইসরায়েল। অন্যদিকে ইরান তার মিত্রদের দিয়ে ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ করিয়েছে। কিন্তু খুব কমই সরাসরি আক্রমণ করেছে।
আর এখন উভয় দেশ সরাসরি দীর্ঘস্থায়ী এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল সংঘাতে লিপ্ত হতে প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছে। ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর পাল্টা হামলার হুমকি দিয়েছে ইসরায়েল। আর এতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আসলেই কি ইরানের সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ইসরায়েল? এ নিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েল যখন ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র হিজবুল্লাহর স্থাপনা লক্ষ্য করে লেবাননে আক্রমণ চালায়, তখন ইসরায়েলের ওপর ছয় মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এর প্রতিক্রিয়ায় ইরানের ওপর সরাসরি এবং আরও বেশি শক্তিশালী আক্রমণ চালাতে ইসরায়েল প্রস্তুত বলেই মনে হচ্ছে। আবার ইরানও হুঁশিয়ারি দিয়েছে, ইসরায়েল আঘাত হানলে তারা ব্যাপক প্রতিশোধ নেবে।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে ইরানি কৌশলের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ইওয়েল গুজানস্কি বলেছেন, ‘ইসরায়েলের সেনাবাহিনী, প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ, বিশ্লেষক এবং রাজনীতিবিদরা ঐকমত্যে পৌঁছেছে যে ইরানের আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলের শক্তিশালী জবাব দেওয়া উচিত।’
ইরান এর আগে তেল আবিবের নাগরিক এলাকায় আঘাত হানেনি। এমনকি এপ্রিল মাসের আগের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সামরিক ঘাঁটিগুলোতে আঘাত হানা হয়েছিল। সম্প্রতি নাগরিক এলাকায় আঘাত হানায় ক্ষুব্ধ ইসরায়েলিদের কাছে হারানোর কিছু নেই উল্লেখ করে গুজানস্কি আরও বলেন, এখন বেশিরভাগ ইসরায়েলি মনে করেন ‘ইরানকে আরও বেশি ক্ষতি করার সুযোগ ইসরায়েলের নেওয়া উচিত।’
সমালোচকরা মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতার প্রধান কারণ হিসেবে ইসরায়েলকে দায়ী করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ইসরায়েলি নিজেদের ইরানের মিত্রদের দ্বারা চলমান আক্রমণের শিকার বলে মনে করেন। বিশেষ করে গাজা উপত্যকার হামাস, ইয়েমেনের হুথি ও লেবাননের হিজবুল্লাহর আক্রমণের নেপথ্যে ইরানকে দায়ী করার দাবি বাড়ছে ইসরায়েলে।
বর্তমানে ইসরায়েলের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের ফেলো গুজানস্কি বলেন, ইরান ও তার মিত্রদের থামাতে হবে বলে মনে করছেন ইসরায়েলিরা।
তবে ইসরায়েল কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবে সে বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ছয় ইসরায়েলি কর্মকর্তা এবং এক সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়ার মাত্রা নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাওয়া সমর্থনের ওপর। কারণ ইরানের নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ভূপাতিত করতে ইসরায়েলকে সাহায্য করেছে মার্কিন বাহিনী।
অবশ্য মার্কিন কর্মকর্তা বলেছেন, মঙ্গলবারের ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতিক্রিয়ায় হোয়াইট হাউজ ইসরায়েলকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এমন অনুরোধের খুব বেশি প্রভাব পড়বে না বলেও আশঙ্কা করছেন ওই কর্মকর্তা।
ইরানের প্রথম দফার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাবে ইসরায়েল যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, তার তুলনায় এবারের পাল্টা আক্রমণ অনেক বেশি শক্তিশালী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সেবার ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ইসরায়েল হামলা চালিয়েছিল এবং তা তারা স্বীকার করেনি।
ইসরায়েলি কর্মকর্তারা মনে করেন, তখন হোয়াইট হাউজের আহ্বান শুনে ইরানের ওপর স্বল্পমাত্রায় আক্রমণ চালিয়ে ভুল করেছিল ইসরায়েল।
এবার ইরানের তেল উৎপাদন কেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিতে ইসরায়েল আক্রমণ করতে পারে বলে জানিয়েছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। তেল শোধনাগারে আঘাত করলে ইরানের দুর্বল অর্থনীতি আরও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এছাড়া তা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এক মাস আগে বিশ্বব্যাপী তেলের বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
তবে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আঘাত হানার পরিকল্পনা করছে না বলে জানিয়েছেন ওই চার ইসরায়েলি কর্মকর্তা। যদিও ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির প্রচেষ্টাকে অস্তিত্বের জন্য হুমকি বলে মনে করে ইসরায়েল।
কারণ ইরানের অনেক পারমাণবিক স্থাপনা ভূগর্ভের গভীরে থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া সেগুলোতে আঘাত হানা কঠিন হবে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বুধবার বলেছেন, তিনি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলের আক্রমণ সমর্থন করবেন না। যদিও ইসরায়েল এটি চায় বলে জোর দিয়ে বলেছেন গুজানস্কি।
সিনিয়র গোয়েন্দা কর্মকর্তা সিমা শাইন মনে করছেন, ইসরায়েলিরা এখন দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা অর্জনের জন্য স্বল্পমেয়াদি বিপদের জন্য আরও বেশি সহনশীল হয়েছে। বিশেষ করে গত ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমণকে ইসরায়েলিদের জন্য ব্যাপক নিরাপত্তা ঝুঁকি বলে মনে করছেন তারা। ইসরায়েল ইহুদিদের জন্য নিরাপদ স্থান ধারণার ওপর আঘাত করেছে হামাস। ওই হামলা ইসরায়েলিদের ঝুঁকি নেওয়ার ইচ্ছাকেও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আর ইসরায়েলিদের কাছে ইরান এখন আগের চেয়ে দুর্বল। কারণ সম্প্রতি ইসরায়েল হিজবুল্লাহর বেশিরভাগ নেতাকে হত্যা করেছে। তাদের ক্ষেপণাস্ত্র মজুতের বড় অংশ ধ্বংস করেছে। এখন যদি ইসরায়েল তেহরানের ওপর শক্তিশালী আক্রমণও চালায়, মিত্র হিজবুল্লাহর কাছ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ সাহায্য ও সমর্থন আশা করতে পারবে না ইরান।
আর এ কারণেই গুজানস্কি বলেছেন, ‘যেহেতু ইরান এখন আগের চেয়ে অনেক দুর্বল, তাই ইসরায়েল এখন আরও বেশি স্বাধীনভাবে পদক্ষেপ নিতে পারবে।’