X
বুধবার, ১৮ জুন ২০২৫
৪ আষাঢ় ১৪৩২

মধ্যপ্রাচ্য কি না ফেরার অবস্থায় পৌঁছে যাচ্ছে? 

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
১৮ জুন ২০২৫, ২০:০০আপডেট : ১৮ জুন ২০২৫, ২২:০৫

ইসরায়েল যখন ইরানের ওপর হামলার মাত্রা ক্রমেই বাড়াচ্ছে, তখন একে এক মহাবিপর্যয়ের শুরু বলে আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা। পারমাণবিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি রাষ্ট্র যদি উন্মুক্ত যুদ্ধের পথে যায়, তবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যই ঢুকে পড়তে পারে এক অনির্দিষ্ট, ধ্বংসাত্মক ভবিষ্যতের ভেতর। আন্তর্জাতিক কূটনীতি যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে এই অঞ্চলের জন্য অপেক্ষা করছে অন্ধকার ভবিষ্যৎ। তুরস্কের সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ড এ খবর জানিয়েছে।

ইসরায়েলের দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গাজা থেকে লেবানন পর্যন্ত যুদ্ধে জড়ানোর আগে বারবার সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকরা, এমনকি সাবেক ইসরায়েলি কর্মকর্তারাও। তাদের মতে, নেতানিয়াহুর কোনও স্পষ্ট পরিকল্পনা নেই। 

গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ বাড়ার পর এখন ইসরায়েলের লক্ষ্য ইরান। এক বিশেষজ্ঞ দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে বলেছেন, ইরানই এখন শেষ শত্রু। তবে অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েলের এই হামলা সফল হতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ প্রয়োজন। এটি আবার নেতানিয়াহু সরকারের কোনও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল নয়। 

ইস্তাম্বুল মেদেনিয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ওরসামের প্রেসিডেন্ট কাদির তেমিজ বলেন, এখানে এক ধরনের দোলাচল চলছে। তিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে কূটনৈতিক আলোচনা এবং নেতানিয়াহু ও তার মিত্রদের ‘রেজিম চেঞ্জ’ এজেন্ডার মধ্যে এই দোলাচলের কথা উল্লেখ করেন। 

নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষমতা ধ্বংস থেকে শুরু করে সরাসরি তেহরানে সরকার পরিবর্তনের কথা বলেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট সমর্থন ছাড়া এই লক্ষ্য দুটোই অসম্ভব। আমেরিকার ডানপন্থি মহলে স্টিভ ব্যানন ও টাকার কার্লসনের মতো প্রভাবশালী কণ্ঠস্বর ইরানের বিরুদ্ধে আরেকটি যুদ্ধের বিরোধিতা করছেন। 

তেমিজ টিআরটি ওয়ার্ল্ডকে বলেন, ইরানের বর্তমান সরকারের কোনও স্পষ্ট বিকল্প নেই। এ নিয়ে উদ্বেগ আছে। ৯২ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ দেশে সরকার পরিবর্তন হলে অচলাবস্থা ও অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে।

ইরান-কানাডিয়ান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঘনছে তাজমিনি বলেন, এমকেও বা পাহলভি পুতুল সরকার চাপিয়ে দেওয়া হবে, এটা ইরানের সব মানুষ চায় না। তিনি এমকেও (মুজাহিদিন-ই-খাল্ক সংগঠন) ও ইসরায়েলের সমর্থক নির্বাসিত রাজপুত্র রেজা পাহলভির কথা উল্লেখ করেছেন। তারা ইরানে সরকার পরিবর্তনের ডাক দিয়েছেন। তবে ১৯৮০-এর ইরান-ইরাক যুদ্ধে সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে জোট বাঁধার পর এমকেও জনসমর্থন হারিয়েছে। 

তেমিজের মতে, সরকার পরিবর্তনের ঝুঁকি বিবেচনায় কূটনৈতিক সমাধানই সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত। তিনি বলেন, এই ইসরায়েলি এজেন্ডায় বিনিয়োগ করতে অনেকেই রাজি নন। আমার মনে হয়, আঞ্চলিক আরব দেশগুলোর মধ্যস্থতায় কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

সম্প্রতি কিছু আরব কূটনীতিক আমেরিকার সঙ্গে ইরানের পারমাণবিক আলোচনা পুনরায় শুরু করার ইচ্ছার কথা পৌঁছে দিচ্ছেন বলে খবর পাওয়া গেছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর ও তুরস্কসহ ২০টির বেশি আরব ও মুসলিম দেশ ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করেছে। 

তবে উত্তেজনা থেকেই যাচ্ছে। জি-৭ সম্মেলন থেকে হঠাৎ চলে যাওয়ার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরান-ইসরায়েল সংঘাতের একটি অস্পষ্ট যুদ্ধবিরতির কথা বলেন এবং তেহরানকে মূলত দায়ী করেন। তিনি ইঙ্গিত দেন যে যুদ্ধবিরতির চেয়ে ‘বড় কিছু’ আসছে। তার এই মন্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই হামলা করতে পারে বলে ধারণা বাড়ছে। 

ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, আমেরিকা ফার্স্ট মানে ইরান কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র পাবে না। আমেরিকাকে আবার মহান করুন!

জি৭-এর চূড়ান্ত বিবৃতিতে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের পাশাপাশি ইরানকে ‘আঞ্চলিক অস্থিরতা ও সন্ত্রাসের মূল উৎস’ বলা হয়েছে এবং তেহরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র না দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। 

তেমিজ বলেন, ইরান নিয়ে একটি সিদ্ধান্তমূলক মুহূর্ত আসছে। তবে তিনি মনে করেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত রাখাই ইসরায়েল, আমেরিকা ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জন্য ভালো হবে। 

তিনি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির পারমাণবিক অস্ত্রবিরোধী ফতোয়ার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যা পশ্চিমা বিশ্ব ও ইরানের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী এই ইস্যুকে সমাধান করতে পারে। খামেনি আগেই গণবিধ্বংসী অস্ত্রকে ‘মানবতার জন্য হুমকি’ বলে উল্লেখ করে তা হারাম (নিষিদ্ধ) ঘোষণা করেছেন। 

২০১২ সালে ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি বলেছিলেন যে খামেনি পারমাণবিক বোমা তৈরির বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়েছেন। তেমিজ বলেন, যদি খামেনি স্পষ্ট ফতোয়া দেন, তাহলে ইরানের বর্তমান সরকার স্থিতিশীল, এই ধারণা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। 

বিশ্লেষকরা ইরানের কৌশল নিয়ে ভিন্নমত দিলেও অনেকেই একমত যে এটি দেশটির অভ্যন্তরীণ সমর্থন ও অর্থনৈতিক-সামরিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতার ওপর নির্ভর করবে। 

মূল প্রশ্ন হলো, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরান কতদিন জবাব দিতে পারবে? মার্কিন সামরিক বিশ্লেষক এডওয়ার্ড এরিকসন বলেন, আমি ভবিষ্যদ্বাণী করা ছেড়ে দিয়েছি। তবে ৯২ মিলিয়ন মানুষের দেশ (ইরান) ১০ মিলিয়ন মানুষের দেশের (ইসরায়েল) বিরুদ্ধে ক্লান্তিকর যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। 

তিনি সতর্ক করে বলেন, ইরানের সহনশীলতা অবমূল্যায়ন করা উচিত নয়। রাশিয়া ও চীনের সমর্থন পেলে ইরান ইসরায়েলকে ক্লান্ত করে দিতে পারে। 

তাজমিনিও ইরান-ইরাক যুদ্ধে ইরানের সহনশীলতার উদাহরণ টানেন। তবে সিরিয়া ও লেবাননে ইরানের প্রভাব কমেছে এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও উল্লেখ করেছেন তিনি। 

অবশ্য ইসরায়েলের ভেতরে ইরানের হামলা প্রমাণ করে যে তেহরান ইসরায়েলের দুর্বলতা প্রকাশ করে দিতে পারে। ইরান সম্প্রতি ইসরায়েলের তেল শোধনাগার ও জ্বালানি স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে। 

এরিকসনের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের ইরাক আক্রমণের মতো স্থলযুদ্ধ ছাড়া ইরানকে বোমা বানানো থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। ইরানিরা ইসরায়েলের হামলায় অবাক হলেও তারা বছরের পর বছর সম্পদ ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। 

তাজমিনি বলেন, পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাবনা খুবই কম। তবে নেতানিয়াহুর সময়ে অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতিই তৈরি হয়েছে। 

আন্তর্জাতিক অর্থনীতিবিদ ড্যান স্টেইনবক ২০২৩ সালের একটি আমেরিকান যুদ্ধ-গেমের কথা উল্লেখ করেন, যেখানে ইরানের ২৫টি প্রধান সামরিক লক্ষ্যে ইসরায়েল ৫০টি পারমাণবিক হামলা চালায়। তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন ও নেতানিয়াহু সরকার ইরানের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক কাঠামো ধ্বংসের পরিকল্পনা করছে। এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।

 

/এএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কে, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সাত দশকের শত্রুতার দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাস
‘বাড়ির ছবি’ শেয়ার করে কেন তেহরান ছাড়ছেন ইরানিরা?
সর্বশেষ খবর
গান বাংলার তাপস জামিনে কারামুক্ত
গান বাংলার তাপস জামিনে কারামুক্ত
কেএনএফের ইউনিফর্ম তৈরি, গ্রেফতার ৮ জন রিমান্ডে
কেএনএফের ইউনিফর্ম তৈরি, গ্রেফতার ৮ জন রিমান্ডে
লিচু খাওয়ার ১০ উপকারিতা
লিচু খাওয়ার ১০ উপকারিতা
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কে, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি কে, কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
সর্বাধিক পঠিত
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে হট্টগোল
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে হট্টগোল
আরও একমাসের ছুটিতে ২ বিচারপতি
আরও একমাসের ছুটিতে ২ বিচারপতি
সিরিয়ার আকাশ দিয়ে ইরানে বোমা ফেলছে ইসরায়েল: নীরব সরকার, বাড়ছে ক্ষোভ
সিরিয়ার আকাশ দিয়ে ইরানে বোমা ফেলছে ইসরায়েল: নীরব সরকার, বাড়ছে ক্ষোভ
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে রাশিয়ার লাভ-লোকসানের সমীকরণ
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়ে রাশিয়ার লাভ-লোকসানের সমীকরণ
‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে সমালোচনার ঝড়
‘অঞ্জলি লহ মোর’ ভাস্কর্য ভাঙা নিয়ে সমালোচনার ঝড়