প্রশ্ন: আমার বয়স ৩০ বছর। আমার আত্নবিশ্বাস খুব কম। কেউ আমার সঙ্গে অন্যায় করলেও আমি প্রতিবাদ করতে পারি না। পরে বিষয়টি নিয়ে খুব হীনমন্যতায় ভুগি। প্রায় সময়েই আমি কল্পনা করি যে আমি অনেক সাহসী কোনও কাজ করছি। আমি স্টেজে উঠে সবার সামনে কিছু বলছি। কিন্তু সত্যিকারে কখনও স্টেজে উঠলে আমি খেই হারিয়ে ফেলি। আমি কীভাবে আত্নবিশ্বাসী হতে পারি?
উত্তর: কৃতিত্বের তালিকা তৈরি করুন: আপনার জীবনের ছোট-বড় সব অর্জন একটি খাতায় লিখে ফেলুন। এটি হতে পারে পড়াশোনায় ভালো ফল, নতুন কিছু শেখা, কাউকে সাহায্য করা বা কর্মক্ষেত্রে কোনো সাফল্য। নিয়মিত এই তালিকাটি দেখুন। এটি আপনাকে নিজের সক্ষমতা সম্পর্কে সচেতন করবে।
নিজের শক্তির উপর জোর দিন: কোন কোন ক্ষেত্রে আপনি ভালো, সেগুলোকে আরও উন্নত করার চেষ্টা করুন। যে কাজগুলো করতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন বা প্রশংসা পান, সেগুলোর চর্চা বাড়িয়ে দিন।
নিজের যত্ন নিন: পরিমিত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাবার এবং নিয়মিত ব্যায়াম আপনার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখবে। নিজের জন্য সময় বের করুন, পছন্দের কাজ করুন। নিজেকে ভালোবাসতে শিখলে আত্মবিশ্বাস এমনিতেই বাড়বে।
নেতিবাচক চিন্তা প্রতিস্থাপন করুন: ‘আমি এটা পারব না, আমাকে দিয়ে কিছু হবে না’– যখনই এই ধরনের চিন্তা মাথায় আসবে, সেটিকে একটি ইতিবাচক বা বাস্তবসম্মত চিন্তা দিয়ে প্রতিস্থাপন করার চেষ্টা করুন। যেমন, ‘আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি, একবারে না হলেও ধীরে ধীরে শিখব, এটা আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করাটা রোমাঞ্চকর।’
পারফেকশনিজম পরিহার করুন: সব সময় সবকিছু নিখুঁত হতে হবে এমন কোনও কথা নেই। ভুল হওয়া স্বাভাবিক। ভুল হবেই। আপনি সচেতনভাবে না চাইলেও ভুল থেকেই আপনার মস্তিষ্ক শিক্ষা নেবে।
তুলনা করা বন্ধ করুন: অন্যের চোখে নিজেকে বিচার করা বন্ধ করুন। আপনার নিজের কাছে আপনি কেমন, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অন্যের সাথে নিজেকে তুলনা করলে হীনমন্যতা বাড়ে। প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র এবং প্রত্যেকের নিজস্ব পথ রয়েছে। নিজের উন্নতির দিকে মনোযোগ দিন।
ধীরে ধীরে সাহসের চর্চা করুন: আত্মবিশ্বাস রাতারাতি তৈরি হয় না। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। অন্যায়ের প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে প্রথমেই খুব বড় কোনও পদক্ষেপ নিতে হবে এমন নয়। ছোটখাটো বিষয়ে নিজের মত প্রকাশ করতে শিখুন। যেমন দোকানে কোনও জিনিস নিয়ে আপনার আপত্তি থাকলে সেটা বলুন বা বন্ধু মহলে কোনও আলোচনায় আপনার ভিন্নমত থাকলে সেটা শান্তভাবে প্রকাশ করুন।
‘না’ বলতে শিখুন: অনেক সময় আমরা চক্ষুলজ্জা বা সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ভয়ে অনেক কিছু মেনে নিই যা আমরা আসলে চাই না। নিজের সীমানা নির্ধারণ করতে শিখুন এবং প্রয়োজনে ‘না’ বলুন।
ছোট ছোট চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করুন: এমন কিছু কাজ হাতে নিন যা করতে আপনি কিছুটা ভয় পান কিন্তু অসম্ভব নয়। সফলভাবে সেই কাজগুলো করতে পারলে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
যোগাযোগের দক্ষতা বাড়ান: যখন কথা বলবেন, ধীরে ও স্পষ্টভাবে বলুন। চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার অভ্যাস করুন। সোজা হয়ে দাঁড়ান বা বসুন। কথা বলার সময় হাত এমনভাবে রাখুন যাতে আপনাকে আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। ভালো বক্তা হওয়ার আগে ভালো শ্রোতা হওয়া জরুরি। অন্যের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, তারপর নিজের বক্তব্য তুলে ধরুন।
মঞ্চভীতি কাটানোর উপায়: যে বিষয়ে কথা বলতে চান, সে বিষয়ে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিন। তথ্য সংগ্রহ করুন, নিজের বক্তব্য গুছিয়ে নিন। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বা পরিচিতদের সামনে অনুশীলন করুন। সম্ভব হলে নিজের বক্তব্য রেকর্ড করে শুনুন এবং প্রয়োজনীয় উন্নতি করুন। প্রথমেই অনেক মানুষের সামনে কথা বলার দরকার নেই। পরিচিত কয়েকজন বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সামনে কথা বলার অভ্যাস করুন। ধীরে ধীরে শ্রোতার সংখ্যা বাড়ান। মঞ্চে ওঠার আগে বা কথা বলার সময় নার্ভাস লাগলে深 শ্বাস নিন। এটি আপনাকে শান্ত থাকতে সাহায্য করবে। ভুলকে ভয় পাবেন না, কথা বলার সময় ভুল হওয়া স্বাভাবিক। ভুল হলে ঘাবড়ে না গিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার শুরু করুন। মনে রাখবেন, শ্রোতারা সাধারণত বক্তার ছোটখাটো ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন।
কল্পনার শক্তি ব্যবহার করুন (ইতিবাচক অর্থে): আপনি যেমন কল্পনা করেন যে আপনি সাহসের সাথে স্টেজে কথা বলছেন, সেই কল্পনাকে আরও স্পষ্ট করুন। নিজেকে সফলভাবে বক্তব্য রাখতে দেখুন। এটি আপনার অবচেতন মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন: যদি মনে হয় আপনি একা এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না, তাহলে একজন কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে পারেন। তারা আপনার সমস্যার কারণগুলো খুঁজে বের করতে এবং সেগুলো থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করবেন।
প্রশ্ন: আমার বয়স ২৪ বছর। বাবা-মায়ের উপর অনেক অভিমান আমার। আমি বলেছিলাম পড়াশোনা শেষ করে বিয়ে করতে চাই, আরও কিছুটা সময় চায়। কিন্তু তারা তাড়াহুড়ো করে এবং আমাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে দিয়ে দেয় আমার। বিয়ের পর জানতে পারি স্বামীর অন্যত্র সম্পর্ক, পরে ডিভোর্স দিয়ে দিই। এই বিষয়টি নিয়ে বাবা-মায়ের উপর অনেক অভিমান কাজ করে। আমি কোনও অপরাধ না করেও সমাজের চোখে ডিভোর্সি হয়ে গেছি। বাবা-মাও অনুতপ্ত, আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। কিন্তু আমি কোনোভাবেই তাদের ক্ষমা করতে পারছি না। দুই বছর হয় তাদের সাথে ঠিক মতো কথাও বলি না। আমারও ভীষণ কষ্ট হয়, কিন্তু স্বাভাবিক আচরণ আর করতে পারি না।
উত্তর: নিজের অনুভূতিগুলোকে গুরুত্ব দিন: আপনার রাগ, কষ্ট, অভিমান– এই সবগুলো অনুভূতিই স্বাভাবিক। এগুলোকে চেপে না রেখে প্রকাশ করার স্বাস্থ্যকর উপায় খুঁজুন। সেটা হতে পারে বিশ্বস্ত কোনও বন্ধু বা আত্মীয়ের সাথে কথা বলা, ডায়েরি লেখা অথবা এমন কোনও কাজ করা যা আপনাকে মানসিক শান্তি দেয়। আপনি আপনার অনুভূতি আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন। এর মাধ্যমেই আপনার মস্তিষ্ক দ্রুত আপনার আবেগ-অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। কান্না পেলে কাঁদুন। কান্না দুর্বলতার লক্ষণ নয়, বরং এটা জমে থাকা কষ্ট বের করে দিতে সাহায্য করে।
ক্ষমা করার বিষয়টি বিবেচনা করুন (নিজের স্বার্থে): ক্ষমা করা মানে এই নয় যে আপনি যা ঘটেছে তা ভুলে গেছেন বা তাদের কাজকে সমর্থন করছেন। অন্যের প্রতি রাগ ও ঘৃণা পুষে রাখলে তা সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে নিজেরই। ক্ষমা করা হলো নিজের ভেতরের ক্ষোভ ও যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্তি দেওয়া; নিজেকে মানসিক চাপমুক্ত করা, তথা সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু অর্জনের লক্ষ্যে অটুট থাকা। ক্ষমা একটি প্রক্রিয়া, এটা একবারে হয়ে যায় না। ধীরে ধীরে চেষ্টা করতে পারেন। হয়তো এখনই পুরোপুরি ক্ষমা করতে পারবেন না, কিন্তু তাদের সাথে ন্যূনতম স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতে পারেন। বাবা-মা আপনার ভালোর জন্যই হয়তো তাড়াহুড়ো করে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদিও সেই পদ্ধতি ভুল ছিল এবং তার ফলস্বরূপ আপনাকে ভুগতে হয়েছে। তাদের অনুতাপকে আপনার মস্তিষ্ক আপনার অজান্তেই বিবেচনায় নিয়েছে।
বাবা-মায়ের সাথে যোগাযোগের একটি ভারসাম্যপূর্ণ পথ খুঁজুন: আপনি বলেছেন যে দুই বছর ধরে তাদের সাথে ঠিকমতো কথা বলেন না, এতে আপনার নিজেরও কষ্ট হয়। সম্পূর্ণভাবে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়তো দীর্ঘমেয়াদে আপনার মানসিক শান্তির জন্য সহায়ক নাও হতে পারে। ছোট ছোট পদক্ষেপে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে পারেন। হয়তো শুরুতে অল্প সময়ের জন্য কথা বললেন, ধীরে ধীরে সেটা বাড়াতে পারেন। তাদের সাথে কথা বলার সময় আপনার অনুভূতিগুলো শান্তভাবে প্রকাশ করতে পারেন। বলতে পারেন যে তাদের সিদ্ধান্তে আপনি কতটা আঘাত পেয়েছেন এবং আপনার জীবন কতটা প্রভাবিত হয়েছে।
সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অতিরিক্ত ভাববেন না: এটা খুবই দুঃখজনক যে আমাদের সমাজ এখনও বিবাহবিচ্ছেদের মতো একটি বিষয়কে সহজভাবে নিতে পারে না এবং প্রায়শই নারীদেরকেই এর জন্য দায়ী করে। মনে রাখবেন, যারা আপনাকে বিচার করছে, তারা আপনার জীবনের কষ্টকর অধ্যায়গুলো দেখেনি বা অনুভব করেনি। তাদের কথায় নিজের মানসিক শান্তি নষ্ট করবেন না। যারা আপনাকে বোঝে এবং আপনার পাশে থাকে, তাদের সাথে সম্পর্ক আরও মজবুত করুন।
নিজের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে মনোযোগ দিন: অতীতের কষ্টের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান ও ভবিষ্যতের দিকে মনোনিবেশ করুন। আপনার পড়াশোনা বা ক্যারিয়ারের যে স্বপ্ন ছিল, তা পূরণের জন্য নতুন করে উদ্যমী হোন।
নিজের যত্ন নিন। শখের কাজ করুন, নতুন কিছু শিখুন, নিজেকে ভালোবাসতে শিখুন। আত্মনির্ভরশীলতা আপনাকে মানসিক শক্তি যোগাবে।
প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন: যদি মনে হয় এই মানসিক যন্ত্রণা আপনি একা কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, তাহলে একজন কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সাহায্য নিতে পারেন। তারা আপনাকে আপনার অনুভূতিগুলো সঠিকভাবে বুঝতে এবং সেগুলো মোকাবিলার সঠিক পথ দেখাতে সাহায্য করবে। একজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বললে আপনি এই ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা পেতে পারেন।