X
বুধবার, ০২ জুলাই ২০২৫
১৮ আষাঢ় ১৪৩২
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

চেতনার বাতিঘর

দীপংকর গৌতম
২৩ জুন ২০২২, ১৫:২৪আপডেট : ২৩ জুন ২০২২, ১৫:২৪

[অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর আজ ৮৬তম জন্মদিন। তিনি ২৩ জুন, ১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার বিক্রমপুর উপজেলার বাড়ৈখালীতে। তিনি বাগস্বাধীনতা, মানবাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং সামাজিক ন্যায়বিচারবিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা। দীর্ঘকাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা প্রবন্ধসাহিত্য যাদের নিরলস অবদানে সমৃদ্ধ তিনি তাদের অন্যতম। তিনি মার্কসবাদী চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ, প্রগতিশীল ও মুক্তমনা। নতুন দিগন্ত  পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক।]

 

শিক্ষার যেমন শেষ নেই, একজন প্রকৃত শিক্ষকও কখনো অবসরে যান না। জীবনকে অতিক্রম করে তিনি হয়ে ওঠেন অনুসরণীয় ও দৃষ্টান্ত। তেমনি একজন আমাদের সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার।
এ ধরনের প্রাগ্রসর মানুষের কোনো নাম হয় না। এক সময় তাঁর নাম তাঁর চেয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। চেতনাশৈলীর মধ্যদিয়ে সামাজিক দায়বদ্ধ এসব আলোকিত মানুষেরা নামের চেয়ে অনেক উপরে বাস করেন। তিনি হন স্যার, পিতা—এমন অবলম্বন, আশ্রয়ের একটি প্রতিষ্ঠান। ছাত্র নয় যে, তিনি তারও স্যার। এমন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত যারা হন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার তাদের একজন। একইসঙ্গে তিনি অনেক, ভিন্নধারার মানুষের প্রতিকৃতি। ছাত্র-অছাত্র, পরিচিত-অপরিচিতজন সবার তিনি স্যার। সবার স্যার হওয়ার যোগ্যতা তিনি অর্জন করেছেন নিজ গুণে। একদা প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, 'শুধু মুখের কথাই জীবন্ত। যত দূর পারা যায়, যে ভাষায় কথা কই সে ভাষায় লিখতে পারলেই লেখা প্রাণ পায়। আমাদের প্রধান চেষ্টার বিষয় হওয়া উচিত কথায় ও লেখায় ঐক্য রক্ষা করা, ঐক্য নষ্ট করা নয়। ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।' (কথার কথা : প্রবন্ধ সংগ্রহ)। একথা স্যারের নিজের জন্যই পুরোপুরি প্রযোজ্য। এই বাঙালি মনীষী একাধারে শিক্ষাবিদ, লেখক, প্রাবন্ধিক, পরিবেশ সুরক্ষা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারবিষয়ক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব।

দীর্ঘকাল তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপনা করেছেন। কিন্তু তাঁর জানাশোনার বৃত্ত শুধু ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি তারও অধিক বিস্তৃত। তাঁর সমাজ বিশ্লেষণ সবার চেয়ে আলাদা। সবাইকে আপন করে নেওয়ার শক্তি তাঁর এতটাই প্রবল যে, তাঁর স্নেহ-ভালোবাসার সান্নিধ্য পেতে অসংখ্যজন ব্যাকুল। সবচেয়ে অবাক করা দিক—একবার স্যারকে একটা সমস্যার কথা বললে তিনি সহজে তা ভোলেন না। পরিচয়ের পর স্যার কারো নাম ভুলে যান এমন ঘটনা আমার জানা নেই। দেশের কোনো আন্দোলন-গণসংগ্রাম থেকে স্যার নিজেকে কখনো দূরে রাখেননি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে তিনি কখনো সামান্য দূরেও সরে যাননি বা জেগে থেকে ঘুমাননি। এভাবেই তিনি নিজের মধ্যে একটি বিপ্লব করে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। স্যারের লেখা বই ‘আপনজনের মুখ’ কখনো একবারে পড়তে পারিনি। একটা লেখা কত শক্তিশালী হতে পারে তা তাঁর লেখা পড়ে সহজেই বোঝা যায়। ‘বাঙালির জাতীয়তাবাদ’, শরৎচন্দ্র ও সামন্তবাদ (১৯৭৫), আমার পিতার মুখ (১৯৭৬), বঙ্কিমচন্দ্রের জমিদার ও কৃষক (১৯৭৬), বেকনের মৌমাছিরা (১৯৭৮), ‘বাঙালিকে কে বাঁচাবে?’, ‘কুমুর বন্ধন’ (১৯৭৭), শ্রেণী সময় ও সাহিত্য (১৯৯০) এসব বইয়ের মধ্যে তথ্য, উপাত্ত আর সঞ্চয় করে রাখার মতো সম্পদ রয়েছে অজস্র।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর লেখায় মূল যে বক্তব্য তা হলো সমাজে শ্রেণিবৈষম্য থাকলে কায়েমি স্বার্থ থাকবেই। তাতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ দিয়ে কোনো লাভ হবে না। দুই বাঙালির লাহোর যাত্রা সম্পর্কেও তাঁর যে বিশ্লেষণ তা যুক্তির আদলে গড়া। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রামমোহন, বিদ্যাসাগর, শিবরাম চক্রবর্তী ও আরজ আলী মাতুব্বর সম্পর্কে তাঁর বিশ্লেষণ খুবই উঁচু ও সাহিত্যরসে পরিপূর্ণ। প্রবন্ধ-সাহিত্যকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। সহজ ভাষায় ছোট ছোট পদবিন্যাসে তাঁর লেখা খুবই ছন্দময়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সম্বন্ধে বিশিষ্ট বাম রাজনীতিক ও তাত্ত্বিক হায়দার আকবর খান রনো একটি বিশ্লেষণাত্মক লেখা লিখেছিলেন ‘আমাদের বুধবার’ নামের একটা অনলাইন পত্রিকায় (২৪ জুন, ১৯১৪)  অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : একজন বিপ্লবী বুদ্ধিজীবীর নাম—শিরোনামের এই লেখায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর জীবনের মননশীলতার যে বহুমাত্রিকতা এবং মার্কসবাদী লেখক ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী হিসেবে সমাজ পরিবর্তনের লড়াইয়ে তাঁর মননশীল সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি লিখেছেন—১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত ‘দ্বিতীয় ভূবন’ সাহিত্য বিষয়ক কয়েকটি অসাধারণ প্রবন্ধের সংকলন। অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা। এরিস্টটল, শেক্সপীয়র, টলস্টয়, ইয়েটস, বার্ট্রান্ড রাসেল, এলিয়ট, ফ্রানৎজ ফানন প্রভৃতি বিশ্ব ইতিহাস ও সাহিত্যের দিকপালের পাশাপাশি আছেন বাংলা ভাষার কবি সাহিত্যিকদের অনেকেই- রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মীর মশাররফ হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, জীবনানন্দ, সুকান্ত প্রমুখ। এই সংকলনের নামটি কেনো ‘দ্বিতীয় ভূবন’? এই নামকরণের মধ্যদিয়ে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে। তিনি মনে করেন, সাহিত্য জীবন বিচ্ছিন্ন নয়। জীবনকে কেন্দ্র করে প্রথম যে ভূবন, তারই ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সাহিত্যের উপরিকাঠামো, যাকে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন দ্বিতীয় ভূবন।
এ কথা ঠিক যে সাহিত্য সংস্কৃতির ভিত্তিকে প্রভাবিত করে। সেটাকে অস্বীকার করা হবে একপেশে ও ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি। এমনকি স্বয়ং ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস ঐতিহাসিক বস্তুবাদ প্রসঙ্গে এমন একপেশে ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেছিলেন। যাই হোক, সেই প্রসঙ্গ এখনকার আলোচ্য বিষয় নয়। আমি যেটা দেখাতে চাই তা হলো, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আধিবিদ্যকের মতো সাহিত্য-সংস্কৃতিকে সমাজ এবং সমাজের শ্রেণী দ্বন্দ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে কখনই বিচার করেননি। Art for art’s sake যারা বলেন, তাদেরও তিনি বিপরীত শিবিরে অবস্থান করেন। সেই জন্য তিনি সাহিত্যের সামাজিক উৎসভূমি সন্ধান করেন। শ্রেণী বিশ্লেষণের মাইক্রোসকোপের তলায় ফেলে সাহিত্য সংস্কৃতিকে বিচার করেন। তাঁর একটি বইয়ের নাম ‘ঊনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যকরণ’। নামটির মধ্যেই ভিন্নতার সুর আছে, লেখকের দৃষ্টিভঙ্গির বিশিষ্টতাও তাতে ধরা পড়ে। এটা হলো মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো এই যে, কিছু কিছু তাত্ত্বিকের মতো তিনি এই ভাবে শুরু করেন না- ‘মার্কস ইহা বলিয়াছেন, অতএব ইহা সত্য’। সেটা হলো মুখস্ত বিদ্যা, মার্কসবাদের যথাযথ প্রয়োগ নয়। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মার্কসবাদের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিকে ভিত্তি করে বিশেষ সময় ও যুগের সাহিত্য ও সাহিত্যিকের সঙ্গে সমাজের ও শ্রেণীর সম্পর্ক নির্ণয় করেছেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা গদ্য সাহিত্যের সূচনা, বিদ্যাসাগর থেকে যার যাত্রারম্ভ (রাজা রামমোহন রায় গদ্য লিখলেও ওটাকে ঠিক গদ্য সাহিত্য বলা যায় না) এবং ঊনিশ শতকের শেষভাগে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত যার বিস্তার, সেই গদ্য সাহিত্য যে সমাজ বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত তা চোখে আঙুল দিয়ে প্রথম দেখিয়েছেন একজনই। তিনি হচ্ছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। এটি একটি মহান আবিষ্কারও বলা যেতে পারে।
উনিশ শতকের সাহিত্য এবং সমাজ-সংস্কৃতি নিয়ে অনেক গবেষণামূলক রচনা ছিল। কিন্তু এইভাবে গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ আর কেউ তুলে ধরেছেন বলে আমার মনে হয় না। এর জন্য যে বৈজ্ঞানিক, দ্বান্দ্বিক দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং একই সঙ্গে অসাধারণ মেধা লাগে তা অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ছিল এবং আছে। মেধার জন্য আমরা অবাক হয়ে তাঁর প্রশংসা করি। আর দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আমরা অন্তর থেকে শ্রদ্ধা জানাই। ওই যে আরও ‘বড় কিছু’র কথা বলেছিলাম সেটা হলো এই দৃষ্টিভঙ্গি। সমাজ ও সাহিত্য বিশ্লেষণে শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি।
তিনি যে সাহিত্য সমালোচনা করেছেন- সেখানে তিনি শ্রেণীগতভাবে নিরপেক্ষ থাকেননি। বস্তুত কেউই শ্রেণীগতভাবে নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না। তবে অনেকে নিরপেক্ষতার ভান করেন, অথবা নিজের শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কেও অজ্ঞ থাকেন। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সজ্ঞানে এবং সোচ্চারে শ্রেণী অবস্থান নিয়েছেন। সেটা শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষে, পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে। আরও স্পষ্ট করে বললে, সরাসরি সমাজতন্ত্রের পক্ষে। তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মহান সাহিত্যিকদের শ্রেণী অবস্থান ধরা পড়েছে। মহান ব্যক্তি ও সাহিত্যিকদের ইতিবাচক ও মহান অবদানকে তিনি তুচ্ছ করেননি। কিন্তু বুর্জোয়া ও পেটি-বুর্জোয়া দুর্বলতাকে নির্মমভাবে প্রকাশ করতেও দ্বিধান্বিত হননি। কারণ, প্রকৃত শিক্ষকের মতোই তিনি আগামী প্রজন্মকে শ্রেণী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে চেয়েছেন। ইংরেজির জ্ঞানী শিক্ষকের চেয়ে এই শিক্ষক কিন্তু অনেক বড়, অনেক মহান এবং ব্যতিক্রমী।

দুই
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পাণ্ডিত্যের বিশেষ অর্জন হলো, তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যেও শিক্ষক হয়েও একমুখীনতায় আবিষ্ট নয়। শেকসপীয়ারের নারীরা যেমন তাঁর লেখার উপজীব্য, যেমন তিনি লিখেন, দুই বাঙালীর লাহোরযাত্রা তেমনি লিখেছেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য নিয়ে। বিশেষত যোগাযোগ উপন্যাসকে নতুন দৃষ্টিতে দেখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। বইটির নাম ‘কুমুর বন্ধন’। এই কুমু হল যোগাযোগ  উপন্যাসের নায়িকা কুমুদিনী। এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ সামন্ত চিন্তার বিরোধী প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি এনেছেন।
মেয়েদের দাসীর হাটে বিক্রি হওয়া যে ‘হাটে মাছ-মাংসের দরে মেয়ে বিক্রি হয়’- এমন কথা বলার মধ্যদিয়ে রবীন্দ্রনাথ সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তাঁর কুমুই অনেক সীমাবদ্ধতা নিয়েও বিদ্রোহ করেছে, যে মনে করে, বৈবাহিক সম্পর্ক থাকলেও মনের মিল না থাকলে দৈহিক সম্পর্ক অসুচিতার পর্যায়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথের কুমু মনে করে ‘জীবনে অনেক আসে যায়, তবু কিছু বাকি থাকে’। সেটা হলো আত্মমর্যাদাবোধ ও ব্যক্তিত্ব। নারীত্বের ও সতীত্বের নতুন ব্যাখ্যা এনেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই সকল ইতিবাচক দিককে (যা আমার বিবেচনায় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ) ছোট করে না দেখেও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শ্রেণীর জায়গাটা তীক্ষ্ণভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি উপন্যাসটি সম্পর্কে সঠিকভাবেই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ মুৎসুদ্দি পুঁজির বর্বরতা দেখাচ্ছেন, কিন্তু সামন্ত শক্তির বর্বরতা দেখাচ্ছেন না। কারণ তিনি অসাধারণ হয়েও এক জায়গায় সাধারণ- সে তার শ্রেণী চরিত্র।’ মধুসূদন মুৎসুদ্দি এবং বিপ্রদাস ক্ষয়িষ্ণু সামন্ত প্রতিনিধি। গোটা উপন্যাস জুড়ে দুজনের মধ্যে দ্বন্দ্ব। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন : ‘দ্বন্দ্ব বুঝি ষড়যন্ত্র- এই বিশেষ ক্ষেত্রে। প্রজারা ও শ্রমজীবীরা কিন্তু নীরব, তারা যে আদৌ আসে না এই সমস্ত উপন্যাসে তাতে বোঝা যায় এ সমস্তের মধ্যে মহাকাব্যিকতা নেই, এদের সামাজিকতাটা খর্বিত, শ্রেণী বিভাজন দ্বারা পরিবেষ্টিত। দ্বন্দ্ব যে ষড়যন্ত্র সেটা আরো স্পষ্ট হতো যদি ওই দুই শক্তিকে স্থাপন করা যেতো সাধারণ মানুষের সঙ্গে তাদের যে সম্পর্ক তারই পটভূমিতে। দেখা যেতো অভিন্ন তারা শ্রমশোষণে।’
আরও অনেক বই ও প্রবন্ধ থেকে অনেক উদাহরণ দেয়া যায়, যেখানে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি।
শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি মানে ‘শ্রেণী শ্রেণী’ বলে চিৎকার করাও নয়, অথবা তত্ত্ব কথা আওড়ানোও নয়। যে কোন রচনা, যা যতোই বিপ্লবী অথবা শ্রমিক শ্রেণীর পক্ষের হোক না কেনো, তাকে হৃদয়গ্রাহী রূপে পরিবেশন করতে হবে। আমরা দেখেছি শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ও দার্শনিক কার্ল মার্কসের ভাষাও ছিল অসাধারণ সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ। মাও সে-তুঙ এক বক্তৃতায় (ইউনানে শিল্প-সংস্কৃতি সম্পর্কিত বক্তৃতা, ১৯৪২ সাল) বলেছেন, সাহিত্যকে স্লোগান ও পোস্টারের স্তরে নামিয়ে আনলে চলবে না।’
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রতিটি রচনা অসাধারণ সাহিত্যগুণে সমৃদ্ধ। তাঁর ভাষায় কী যেন একটা মাধুর্য আছে যা পাঠককে আকর্ষণ করে। খুব সরল শব্দ প্রয়োগের মধ্য দিয়ে কাব্যরসে সমৃদ্ধ গদ্য রচনায় তাঁর বিশেষ দক্ষতা আছে। তাঁর মধ্যে জটিল তত্ত্বও আছে। তত্ত্বের নির্দিষ্ট উদাহরণ আছে। কখনো কখনো তীর্যক মন্তব্য বা ব্যাঙাত্মক ভাষা আছে। বেশ কিছু রচনায় তিনি Dialectical approach রাখতে পেরেছেন শব্দ চয়ন ও বাক্য রচনার অসামান্য পারদর্শিতার সাথে। একটা ছোট উদাহরণ দিই। আমাদের পরিচিত ‘কুমুর বন্ধন’ থেকেই দেয়া যাক:
‘কুমুর বন্ধন একটি সামাজিক দলিল। এবং সেই সঙ্গে একটি নীরব চিৎকার। আর্তচিৎকার। সেই সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে যা দুর্বলকে কেবলি পীড়ন করে। কুমু পীড়িত হয় নারী বলে নয়, দুর্বল বলেই। নিপীড়ন-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা দুর্বলকে পেলেই সবল হয়, কেননা প্রবলের কাছে সে দুর্বল।’
মনে হয় যেন সাহিত্য সমালোচনা করতে গিয়ে লেখক নিজেই সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর রচনায় অজস্র ব্যাঙ্গাত্মক ভাষার সন্ধান পাবো, যার মধ্য দিয়ে কঠিন সত্য স্বচ্ছ হয়ে পরিস্ফুট হয়। সেই রকম ব্যাঙ্গাত্মক রচনায় একটি দুটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যাক। এবার উদাহরণ টানবো আমাদের পরিচিত বই ‘উনিশ শতকের বাংলা গদ্যের সামাজিক ব্যাকরণ’ থেকে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কুফল
জেনেও বঙ্কিম তার পক্ষে মতামত প্রকাশ করেছেন। বঙ্কিমের কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলছেন, ‘স্বদেশী কৃষকের প্রাণ রক্ষার চেয়ে বেশী জরুরি বিদেশী ইংরেজের মান রক্ষা করা’। কী তীক্ষ্ণ তীর্যক, ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য।
একই বইয়ে আরেক জায়গায় তিনি প্যারীচাদ মিত্র আর মাইকেল মধুসূদনের দুইটি গদ্য রচনার মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করতে গিয়ে সমালোচক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী লিখেছেন, ‘কিন্তু দুটি রচনার ভেতর প্রাথমিক ব্যবধানটুকুও উপেক্ষণীয় নয়। প্যারীচাদ চিন্তিত ‘জাত’ নিয়ে, ওদিকে মাইকেলের যেহেতু ‘জাত’ নেই, বিজাতীয় তিনি, তাই তার উদ্বেগ ‘জাত’ নয়, সভ্যতা নিয়ে। একজনের মুখ যদি হয় সামন্তবাদের দিকে, তবে অন্যজনের মুখ পুঁজিবাদ মুখো।’
কী চমৎকার অভিব্যক্তি। শব্দের কী চমৎকার খেলা। আবার তত্ত্বের গভীরতাও কম নয়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাহিত্য সমালোচনামূলক বই ও প্রবন্ধ অনেক লিখেছেন। সেগুলো কেবল সমালোচনা নয়, নিজেই হয়ে উঠেছে উচ্চস্তরের সাহিত্য। তেমনই সমাজ ও রাজনীতি সংক্রান্ত অসংখ্য রচনা প্রায় প্রত্যেকটিই উৎকৃষ্ট সাহিত্যের মর্যাদা পেতে পারে।
তিনি সবসময় দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন। ওসমানী উদ্যানে গাছ কেটে ফেলার সর্বনাশী উদ্যোগ যখন নিয়েছিল সরকার, তখন তিনি তাঁর ছাত্র ও বাম সংগঠনসমূহকে সঙ্গে নিয়ে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। এটিকে কেবল পেটি-বুর্জোয়া আন্দোলন বলে তুচ্ছ করা যায় না। কারণ, যে রিকশা চালক, মুটে-মজুর, ফেরিওয়ালা, ঠেলাগাড়িওয়ালা প্রমুখ কড়ারৌদ্রে পরিশ্রম করেন, তাদের ঢাকা শহরে সামান্য জায়গাও নেই বিশ্রাম নেবার। অথচ বিশ্রামটা তার জন্য জরুরি। গাছ দেয় সেই বিশ্রামের জায়গা। ধনীর সরকার গাছ কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী যে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তার গুরুত্ব যথেষ্ট ছিল।
একইভাবে তিনি আড়িয়ল বিলের কৃষকের জমি কেড়ে নিয়ে অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিমান বন্দর করার সরকার যে অপচেষ্টা চালিয়েছিল, তার বিরুদ্ধেও তিনি আন্দোলন গড়ে তোলেন। সরকার তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিও করতে চেয়েছিল।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কখনো সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দল করেননি। কিন্তু সমাজতন্ত্র অভিমুখী বাম ধারার সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে থেকেছেন। তরুণ প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করেছেন, তাঁর বক্তব্য ও উপস্থিতি দ্বারা। তিনি হচ্ছেন সচেতন মাকর্সবাদী বিজ্ঞানে আস্থাশীল সত্যিকার অর্থে বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী। যে ধরনের মানুষের আমাদের দেশে বড় অভাব। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেই শূন্যতার মাঝে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলছেন।
নিজেই শুধু লিখছেন না, প্রগতির ধারায় মতাদর্শিক সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন। ‘নতুন দিগন্ত’ পত্রিকাটির তিনিই প্রাণ-পুরুষ। পত্রিকার সাংগঠনিক কাজটিও তাঁর নেতৃত্বেই পরিচালিত হয়।
আশির দশকে তাঁর লেখা কলাম ‘গাছপাথর’ ও সন্তোষগুপ্তের ছদ্মনামে অনিরুদ্ধের কলাম আমাদের দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা পরিক্রমা, সাহিত্যপত্র, সচিত্র সময়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা, ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্টাডিস উল্লেখযোগ্য। তাঁর কাছে আমরা তাঁর জন্যই চিরঋণী। ৮৬তম জন্মদিনে স্যারকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (২ জুলাই, ২০২৫)
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
ক্লাব বিশ্বকাপে এমবাপ্পের অভিষেক, জুভেন্টাসকে হারিয়ে শেষ আটে রিয়াল
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
জুলাই নিয়ে পুলিশ সদস্যের ‘আপত্তিকর’ পোস্ট, প্রতিবাদে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
রংপুরে নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বে এনসিপির বিশাল পদযাত্রা
সর্বাধিক পঠিত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন কমিটি
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
যারা ফেসবুক লাল করেছিল, তাদের জীবন লাল করে দেবে আ.লীগ: পার্থ
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
বেসরকারি শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যোগদানের দিন থেকে শুরু করতে হাইকোর্টের রুল
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
যশোরে নির্মাণাধীন ভবনের বারান্দা ভেঙে দুই প্রকৌশলীসহ ৩ জনের মৃত্যু
এনবিআরের আরও ৫ শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের আরও ৫ শীর্ষ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক