X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রণেশ মৈত্রর জেলজীবন, লেখালেখি ও ৯০তম জন্মদিন

এম আবদুল আলীম
০৪ অক্টোবর ২০২২, ১৬:২৪আপডেট : ০৪ অক্টোবর ২০২২, ১৬:২৪

“আজ পাবনার রণেশ মৈত্রের সঙ্গে হঠাৎ দেখা হলো। ল’ পরীক্ষা দিতে পাবনা থেকে আনা হয়েছিল। দু’ একদিনের মধ্যে চলে যাবেন এখান থেকে। বললাম, ‘আপনার ছেলেমেয়ের খবর?’ বললেন, ‘কি আর খবর, না খেয়েই বোধ হয় মারা যাবে। স্ত্রী ম্যাট্রিক পাশ, কাজকর্ম কিছু একটা পেলে বাঁচতে পারতো; কিন্তু উপায় কি! একে তো হিন্দু হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, তারপর রাজবন্দী, কাজ কেউ দিবে না। একটা বাচ্চা আছে। বন্ধু-বান্ধব সাহায্য করে কিছু কিছু, তাতেই চালাইয়া নিতে হয়। গ্রামের বাড়িতে থাকার উপায় নেই। মৈত্র কথাগুলো হাসতে হাসতে বললেন। মনে হলো তার মুখ দেখে এ হাসি বড় দুঃখের হাসি।”- কথাগুলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের, লিখেছেন তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’র ১৫৭ নং পৃষ্ঠায়। না, একবার নয়, দু-বার নয়; এই বইতে ছয়বার বঙ্গবন্ধু তাঁর কারাসঙ্গী রণেশ মৈত্রর কথা উল্লেখ করেছেন।

কে এই রণেশ মৈত্র? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের উল্টিয়ে দেখতে হবে ইতিহাসের পাতা। ফিরে যেতে হবে ঠিক নব্বই বছর আগের আজকের এই দিনে, ১৯৩৩ সালের ৪ অক্টোবরে। দেশে তখন চলছে ব্রিটিশ শাসনের স্টিমরোলার। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে দেশকে মুক্ত করতে বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রামে নেমে পড়েছে মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও তাঁদের সহযোদ্ধারা। সে উত্তাপ ভারতবর্ষে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছে। রণেশ মৈত্রর পৈত্রিক মাটি পাবনা জেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। সেই অগ্নিঝরা প্রহরেই রণেশ মৈত্রর জন্ম। তরুণদের পাশাপাশি তাঁর পৈত্রিক পিতৃভূমি পাবনার তরুণীরাও বিপ্লবীর খাতায় নাম লিখেয়েছে। কারণ (এক প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য) : ‘পাবনা শহরটা রাজনীতির, অর্থাৎ কংগ্রেসের বেশ বড় রকমের একটা ঘাঁটি। একদিকে কংগ্রেস আবার অন্যদিকে ছিল টেররিস্ট (সন্ত্রাসবাদী) মুভমেন্টের একটি বড় গোপন কেন্দ্র। অন্য পাড়ার কয়েকটি হিন্দু মেয়ে মাঝে মাঝে আমাদের পাড়ায় আসত, মাকে বড়দি বলে ডাকত। মায়ের কাছেই পড়ে শুনেছি এই মেয়েগুলো ছিল সন্ত্রাসবাদী দলের এবং তারা রিভলভার চালাতে পারত।’ (আবদুল আহাদ, আসা যাওয়ার পথের ধারে) এই মাটিতে বিপ্লবের তেজ নিয়ে আগমন ঘটে রণেশ মৈত্রর। পাবনার প্রত্যন্ত পল্লি সাঁথিয়া থানার ভুলবাড়িয়া গ্রামে শৈশব কাটিয়ে পিতার হাত ধরে স্থায়ীভাবে পাবনা শহরে চলে আসেন। ইংরেজ তখন বিতাড়িত হলেও তখন নতুন বোতলে পুরনো মদ সরবরাহের মতোই জাতির কাঁধে দৈত্যের মতো চেপে বসে পাকিস্তানি দুঃশাসন। এমন পরিবেশে রণেশ মৈত্রকে স্কুলে গিয়ে বিপ্লবমন্ত্রের দীক্ষা নিতে হলো। স্কুলটির নাম গোপালচন্দ্র ইনস্টিটিউশন। তাঁকে দীক্ষা দিলেন এই স্কুলের ব্যাকরণের শিক্ষক, বিপ্লবের এক তাত্ত্বিক গুরু জ্যোতিভূষণ চাকী। পরিচয় হলো এই স্কুলেরই আরেক ছাত্র, ক্ষুদে বিপ্লবী আমিনুল ইসলাম বাদশার সঙ্গেও। এরপর দিন যতই যায়, পরিচিত ও সহযাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে ; প্রসাদ রায়, কামাল লোহানী, সেলিনা বানু, আব্দুল মতিন, জয়নাল আবেদীন খান, ফজলে কবীর, নাঈমুল হাসান, রূপবাণী শিকদার, খালিদ হাসান, পরেশ দে, শাহজাহান মাহমুদ, তাছির উদ্দিন- এমন শত শত নাম। সকলেই এক কাতারে সমবেত হয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের ফাঁকিবাজি স্বাধীনতার বিরুদ্ধে স্লোগান তুললেন ‘ইয়ে আজাদী ঝুট্যা হ্যায়, লাখো ইনছান ভূখা হ্যায়।’ অর্থাৎ মুসলিম লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে রণেশ মৈত্র কৈশোরেই সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। আর তাতেই তাঁর জীবন-যৌবনের নিত্যসঙ্গী হয় জেল-জুলুম ও পুলিশি নির্যাতন। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের শাসনের বেশিরভাগ সময় কারাপ্রকোষ্ঠে কেটেছে তাঁর এবং তাঁর সহযোদ্ধাদের; কেউ কেউ রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ডে বন্দি অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এলেও পঙ্গুত্ব থেকে রেহাই পাননি! জীবনভর বুলেটের বিষব্যথা নিয়ে বিপ্লবের বাণী প্রচার করেছেন।

বাঙালিদের চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে দেশভাগের অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানিরা আঘাত হানে তাদের মাতৃভাষার উপর; অফিস, আদালত, শিক্ষাঙ্গন, নিয়োগ পরীক্ষা সব জায়গা থেকে বাংলা ভাষা বাদ দেওয়ায় অপচেষ্টার পাশাপাশি উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেওয় হয়। পূর্ববঙ্গের অন্য অঞ্চলের মতো পাবনার মাটিতেও জ্বলে ওঠে প্রতিবাদের আগুন। মিছিলের অগ্রভাগে দেখা যায় খাপখোলা তরবারির মতো একহারা লম্বা সুদর্শন এক যুবককে। কে এই যুবক? জানা যাক পাবনার আরেক ভূমিপুত্র ভাষার পাবনার রাজপথে ভাষার লড়াইয়ের এক প্রত্যক্ষদর্শী রশীদ হায়দারের (পরবর্তীকালে খ্যাতিমান সাহিত্যিক) বয়ান থেকে : ‘আমি ক্লাস ফাইভে সবে ভর্তি হয়েছি জি সি ইনস্টিটিউশনে। সাল ১৯৫২। ...নামটা বারবার কানে আসছিল রণেশ, রণেশ। ...দেখলাম স্কুলের ঠিক বিপরীতে, উত্তর পাশে, জামতলার বাঁধের ওপর একটি লম্বা মতো ছেলে বক্তৃতা করছেন। আমার ওই বয়সে বক্তৃতার বিষয় সঠিক উপলব্ধি করার কথা নয়, তবে ভাষার অধিকার আদায় ও মায়ের ভাষার মান বাঁচাতে জালেম নূরুল আমীন সরকারের বিরুদ্ধে যে ঝাঁপিয়ে পড়ে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে, সেই কথাটা একটু একটু বুঝেছিলাম।’ (রশীদ হায়দার, ’৫২ সালের রনেশদা) ভাষার লড়াইয়ে প্রকাশ্য এবং গোপন বৈঠক, বক্তৃতা ও কর্মসূচি প্রণয়ন, মিছিল-স্লোগান, ১৪৪ ধারা ভঙ্গ; সব কর্মসূচিতেই রণেশ মৈত্র অংশ নিয়েছেন। তবে এ জেলায় ভাষা-আন্দোলনের শীর্ষনেতা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের জেলা সেক্রেটারি ও এডওয়ার্ড কলেজের তখনকার জি. এস. আবদুল মমিন তালুকদার।

বায়ান্নর রক্তাক্ত ফেব্রুয়ারির ক্ষত না শুকাতেই ১৯৫৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পাবনায় মহাসমারোহে মুসলিম লীগের সম্মেলন আয়োজন করা হয়। সেই সম্মেলন উপলক্ষ্যে পাবনার জিন্নাহ স্টেডয়ামে (বর্তমানে শহীদ আমীন উদ্দীন স্টেডিয়াম) বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়। আসবেন নূরুল আমীন, আবদুর রব নিস্তারসহ মুসলিম লীগের বাঘা বাঘা নেতা। কিন্তু কামাল লোহানী, রণেশ মৈত্রসহ অগণিত ভাষাসংগ্রামীরা জীবিত থাকতে সেটা কি করে সম্ভব? না, সম্ভব নয়। ভাষাশহীদদের রক্ত যার হাতে, সেই নূরুল আমীনের পাবনায় আগমন রুখে দিতে মাঠে নামলেন তাঁরা। শুধু কি তাই? দিনের আলো ফুটতে না ফুটতেই পাবনা শহরের রাস্তার, গলিতে-গলিতে নূরুল আমীনকে দেখা গেল; তবে মানুষের বেশে নয়, কুকুরের বেশে! অর্থাৎ- রাতভর পাবনা শহরের কুকুরগুলোকে ফাঁদ পেতে ধরে গলায় মোটা সাদা কাপড় বেঁধে তাতে কালো রঙে ‘নূরল আমীন’ লিখে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হলো! এদিকে সি-বোটে পদ্মা পাড়ি দিয়ে নূরুল আমীন তখন পাবনায় পদার্পণ করেছেন। একদিকে নূরুল আমীনের পাবনায় পদার্পণ, অন্যদিকে রাস্তায় রাস্তায় কুকুরবেশী নূরুল আমীনের দৌড়াদৌড়ি, এক অভিনব প্রতিবাদী চেহারায় এর আগে পাবনা শহরকে আর দেখা যায়নি কখনো। তারপর ছাত্রজনতা বিশাল শোভাযাত্রা নিয়ে নূরুল আমীনের জনসভার মঞ্চ ভেঙে দেয়। ভাষাসংগ্রামী ডা. সাঈদ হায়দার একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তাঁর ‘পিছু ফিরে দেখা’ গ্রন্থে সেই জনসভাস্থলে ছাত্রদের প্রতিবাদের যে বিবরণ দিয়েছেন, তা আরও ভয়ঙ্কর সুন্দর! তিনি অন্যান্য বর্ণনার মধ্যে লিখেছেন, ‘পাবনা আরিয়া মাদ্রাসার ছাত্ররা মিছিলে যোগ দিয়ে সেখানে গিয়ে গাছে উঠে নূরুল আমীনের দিকে মুখ করে পা-জামার বোতাম খুলে ...প্রদর্শন করে! ছাত্রদের সম্মিলিত প্রতিবাদে নূরুল আমীনের সভা পণ্ড হয়ে যায়। গ্রেফতার ও কারাবন্দি করা হয় রণেশ মৈত্র, কামাল লোহানীসহ অনেককে। মুসলিম লীগ নেতা ডা. মোফাজ্জল হোসেনের মেয়ে ধর্ষণ মামলা দায়ের করে আসামী করে কামাল লোহানীসহ অনেকের নামে।

হয় কারাগার, নয় রাজপথ; এই ছিল পাবনার ছাত্র ইউনিয়নের নেতা রণেশ মৈত্রর তখনকার নিত্যসহচর। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবির পর পাকিস্তান সরকার আরও মরিয়া হয়ে ওঠে। ৯২ (ক) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দিয়ে পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়। গণগ্রেফতার করা হয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের। রণেশ মৈত্রকেও গ্রেফতার করা হয়। জেলবন্দি জীবনে তিনি হতাশ হননি। জেলে বসেই রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন, সিনিয়র নেতাদের কাছ থেকে জীবনের অভিজ্ঞতা শুনে নিজের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করেছেন। কী করতেন রণেশ মৈত্র জেলখানায়? জানা যাক পাবনা জেলখানায় আটক তখনকার এক রাজবন্দি অমিরুল ইসলামের (পরবর্তীকালে প্রখ্যাত ব্যারিস্টার) স্মৃতিচারণমূলক লেখা থেকে : ‘এই সময়টাতে রণেশের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা। সে সময় তাঁর লেখনী শক্তির পরিচয় পেয়েছি। জেলখানাতেও তাঁর লেখা চলমান ছিল। তিনি লিখতেন এবং লিখে পাঠ করতেন। প্রতি সপ্তাহে তাঁর নোট করা দেশ-বিদেশের সংবাদগুলোর আলোচনায় আমাদের আড্ডা ও সভাগুলো জমে উঠতো।’ (ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, বাল্যবন্ধু রনেশ মৈত্র) আইনি লড়াইয়ে মুক্তি পেলেও সবসময় পুলিশ ও গোয়েন্দাদের নজরদারি চলতো তাঁর উপর। পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনে সেসবের উল্লেখ আছে। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক সম্পাদিত বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে করা পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার গোপন প্রতিবেদনগুলোতে রণেশ মৈত্রর উপর নজরদারির প্রসঙ্গ উল্লেখ আছে। ১৯৫৩ সালের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে (তৃতীয় খণ্ড) উল্লেখ করা হয়েছে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমান পাবনার ঈশ্বরদীতে জনসভা করতে এসেছেন। পাবনা থেকে একদন ছাত্রকে সংগঠিত করে সেই জনসভায় নিয়ে যাচ্ছেন রণেশ মৈত্রসহ কয়েকজন ছাত্রনেতা। রণেশ মৈত্রর উপর গোয়েন্দা নজরদারির মাত্রা এমন পর্যায়ে ছিল যে, তাঁর বিয়ের বরযাত্রীদের সঙ্গেও ছদ্মবেশে পিছু নিয়েছিল গোয়েন্দা সংস্থার এক সদস্য। বিষয়টি ওই দিনই জানাজানি হয়। নজরদারি করতে করতেই তাঁকে গ্রেফতার করা হতো। এমনও অবস্থা ছিল যে, আগের দিন জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়িতে ফিরে পরদিন দুপুরে খেতে বসেছেন, এমন সময় আবার পুলিশ এসে পেছনে দাঁড়িয়ে গেছে হ্যান্ডকাপ হাতে! কেমন ছিল পাকিস্তানি জুলুমরাজের সেই জুলুম? জানা যাক রণেশ মৈত্রর নিজের বয়ান থেকেই : ‘আমি ওই দফায় গ্রেপ্তার হই ঠিক যেদিন পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই, দুপুরবেলায়। খেতে বসেছিলাম দেড় বছর কারারুদ্ধ থাকার পর। আগের দিন মুক্তি পেয়ে বাসায় আসি। পরদিনই আবার সরকারি আতিথ্য নিতে হলো, স্ত্রী-সন্তানদের রেখে।’ এমনই ছিল তাঁর জেলজীবন।

রণেশ মৈত্র দুই.

রণেশ মৈত্র রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, মুক্তচিন্তার ধারক; এসব পরিচয়ে পরিচিত হলেও সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবেই তাঁর খ্যাতি সর্বাধিক। অল্প বয়সে লেখনী তুলে নেন হাতে। ১৯৫১ সালে সিলেটের ‘নও-বেলাল’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে এ পথে যাত্রা। তারপর দৈনিক সত্যযুগ, দৈনিক সংবাদ, দ্য ডেইলি মর্নিং নিউজ, দৈনিক অবজারভার, দি ডেইল নিউ নেশন প্রভৃতি পত্রিকায় সাংবাদিকতা করেছেন। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত পাবনা প্রেসক্লাবের তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। দু-হাতে কলাম লিখেছেন। শোষিত-বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর লেখনী সময় সময় তরবারির রূপ ধারণ করেছে। তাঁর কলামগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে। সে গ্রন্থগুলো হলো- ‘রুদ্ধ চৈতন্যে বিপন্ন বাংলাদেশ’, ‘রুদ্ধ চিন্তায় আচ্ছন্ন রাজনীতি’ ও ‘বাংলাদেশ কোন পথে?’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাসঙ্গী এই সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে নিয়েও গ্রন্থ রচনা করেছেন, বইটির নাম ‘আঁধার ঘোচানো বঙ্গবন্ধু’। এছাড়া প্রকাশিত হয়েছে তাঁর ‘আত্মজীবনী’ ও ‘প্রবন্ধসংগ্রহ’। ‘আত্মজীবনী’টিতে নিজের জীবনের কথা বলতে গিয়ে গত শতাব্দীর স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ইতিহাসের নানা ঘটনার বয়ান হাজির করেছেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়াও আরো অনেক জাতীয় নেতাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে তাঁর। এঁদের মধ্যে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, অমূল্যনাথ লাহিড়ি প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। ভ্রমণ করেছেন বিভিন্ন দেশ। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে কাটিয়েছেন দীর্ঘ সময়। সেখানকার বাঙালিজীবন ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশ নিয়ে তাঁর অনেক স্মৃতিচারণমূলক লেখা রয়েছে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের সময় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক পাবনা শহরে আসেন নির্বাচনী প্রচার ও জনসভা করতে। তখন তাঁকে অপ্যায়নের দায়িত্ব পালন করেন রণেশ মৈত্র। শেরেবাংলা কতটা ভোজনপ্রিয় ও ভোজনরসিক ছিলেন তা নিজের চোখে দেখার স্মৃতি তুলে ধরেছেন ‘আত্মজীবনী’তে। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সমান পারদর্শী ছিলেন। জলদগম্ভীর ভাষায় বক্তৃতা দিতেন নানা যুক্তি-তথ্য তুলে ধরে। তাঁর বাচনভঙ্গি শ্রোতামণ্ডলীকে মুগ্ধ করতো। বহু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। রাজনীতি করতে গিয়ে পাকিস্তান সরকারের রোষানলে পড়লেও এ পথে তাঁর সাফল্য আসেনি। আইনজীবী হিসেবেও জমাতে পারেননি পসার। মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীলতা এবং সৎ সাংবাদিকতা দ্বারা সকলের প্রশংসা কুড়ালেও বারবার দল পরিবর্তন করায় রাজনীতিবিদ হিসেবে সময় সময় যে সমালোচনার মুখে পড়েননি, তা নয়। কথাসাহিত্যিক রশীদ হায়দার লিখেছেন : “সত্যি কথাটা এবার বলি, রণেশদা গণফোরাম-এ যোগদান করলেন, তখন আমি মনে মনে বিরক্ত বোধ করছিলাম। আমি কখনোই প্রত্যক্ষ রাজনীতর সঙ্গে যুক্ত নই। তা সত্ত্বেও রনেশদা ‘পথহারা’ ডক্টর রাজনীতিবিদের সঙ্গে যোগ দেওয়াতে অবাক হয়ে ভেবেছি, রণেশদা এরকম আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?” সবকিছু ছাপিয়ে কলামিস্ট ও লেখক রণেশ মৈত্রই টিকে থাকবেন দীর্ঘকাল। সমাজ-রাজনীতির গত পৌনে এক শতাব্দীর জীবন্ত দলিল তাঁর কলামগুলো। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ও ‘আত্মজীবনী’ পাঠকদের চিন্তা ও মনের খোরাক জোগাবে। তাঁর লেখায় শোষক ও অত্যাচারীর প্রতি ক্ষোভ আছে, আছে সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা। সবকিছুর উপরে আছে দেশপ্রেম এবং মানবতার পক্ষে বিরামহীন লড়াই করার প্রত্যয়। যে লড়াইয়ের পথ তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা দেখিয়েছেন, তা চলমান থাকবে। আর সেখানেই অনাগতকালে লড়াকুদের প্রেরণা দেবে তাঁর লেখা। এমন চারণ সাংবাদিক দেশে কি আর জন্মাবেন? এই কলমযোদ্ধাকে একুশে পদক প্রদান করে সরকার যে সম্মান দিয়েছেন, তা ব্যক্তির উপযুক্ত উপযুক্ত সম্মানই বটে। 

তিন.

পরিশেষে একটি বেদনার বার্তা দিয়ে শেষ করতে চাই, তা হলো- বেঁচে থাকলে আজ নব্বই বছর বয়স হতো রণেশ মৈত্রর। দিনটি ব্যতিক্রমী আইডিয়ায় পালন করতে চেয়েছিলেন তিনি। পিতামহের নওহাটার যে বাড়িতে তাঁর জন্ম, ঠিক সেই ভিটাতেই নব্বইতম জন্মদিনই পালনের সকল পরিকল্পনা সম্পন্ন করেছিলেন। এমনকী, গাড়ি পর্যন্ত ভাড়া করে কয়েক হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলেন। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি তাঁর। গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দৈহিকভাবে চিরবিদায় নিলেও থাকবে তাঁর স্মৃতি ও কীর্তি। কেননা, তিনি ছিলেন সেই চেতনার মানুষ যাঁরা নিজের চেয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থকে সবসময় বড় করে দেখে পথ চলেছেন। তাঁর হাঁটা চলমান থাকবে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে। এই মহাকালের পথিক রণেশ মৈত্র সম্পর্কে তাঁর তেষট্টি বছরের জীবনসঙ্গী পূরবী মৈত্র কবিতায় যা লিখেছেন, সেটাই তাঁর সম্পর্কে সবচেয়ে বড় মূল্যায়ন। পূরবী বসুর জীবনাভিজ্ঞতাঋদ্ধ উচ্চারণ : ‘জাতির স্বার্থকে উর্ধ্বে তুলে ধরে/আপন স্বার্থকে দিলে বলিদান।/তুমি যেন সেই বাতিওয়ালা/যে পথে পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে।/অথচ নিজের ঘরেই জমাট অন্ধকার।’ নিজ ঘর আঁধার রেখে অন্যের ঘরে আলো ফোটানো সদ্যপ্রয়াত মানুষটিকে নব্বইতম জন্মদিনে জানাই শ্রদ্ধা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
রাঙামাটিতে হলো সংসদীয় কমিটির বৈঠক
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
ডুবে যাওয়া জাহাজের ১১ নাবিক উদ্ধার, সবার আগে লাফ দেওয়া মাস্টার নিখোঁজ
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
জাকার্তায় সোনা জিতে বাংলাদেশ পুলিশের ভানরুমের চমক
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা