X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টির সংসারে আমি কেউ নই

সাকিরা পারভীন
০৬ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:৫৭আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২৩, ২০:০৫

বাতাস তার স্রোত বন্ধ করেনি,
তবু মনে হলো নিশ্বাস আটকে গেছে।
মাথার উপরে দগদগে সূর্য
তবু মনে হলো চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার । [১]

বুকের ভেতর হুড়মুড় করে বরফের চাই ভেঙে পড়ছে। ঠেকাতে পারছি না। তুমি খুব অপরাধ করেছ জাহিদ। আমি কোনও এলিজি লেখার জন্য প্রস্তুত নই। নাদিম ইকবালের পোস্ট থেকে আর সকলের মতন আমিও জানছিলাম কবির বিদায়ের ক্রমবর্তমান ধারাবাহিক ভৈরবী। যেকোনো সময় বন্ধ হবে আনাগোনা। তার পোস্টে আমি কেবল লিখছিলাম কিছু বলব না আর বলছিলাম মাবুদ তুমি তাকে মুক্তি দাও। বিবিধ পাইপ, নল, যন্ত্রপাতি তার কষ্ট কমাতে পারবে না। তাছাড়া তিনি আর ফিরবেন না। তুখোড় ফাঁকিবাজ এইসব রোদ আর চিকিৎসাশাস্ত্র তাকে ফেরাতে পারবে না। সময় হয়েছে। এইবার ছুটি দাও তারে।

দুই
তখন বেলা একটা বাজে বোধ হয়। গতকাল। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের আলোচনা চলছে। আমি শুনছি। প্রত্যেক বক্তাই একই সুরে গান গাইছেন। তারা সকলেই আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে যার পর নাই বিব্রত, অস্বস্তিতে ভুগছেন। দীর্ঘ হতাশাব্যঞ্জক বক্তৃতার মাঝে মুঠোফোনের দিকে তাকালাম। নজর রাখছিলাম নাদিম ইকবালের পোস্টের দিকে। আর তাই হলো। বেজে উঠলো না ফেরার বাণ। এতো জানতাম। তবু বুকের কোণায় জমে উঠল চিরকালের বেদনার্ত লিপি। তিনি আমার তো কিছু হন না। তাহলে কেন এমন করে তারা ভেসে এলো চোখের কিনারা বেয়ে নাকে। মুখে। চিবুকের চন্দনে।

কী লিখি তোমায়। কবি।
                             ....
আশুরা হয়েছে গত
ক্ষত—
জখমের মতো—
পড়ে আছে তাজিয়ারা সব
রোদে গলা কাপড়ের শব।

কলরব
শেষ হলো। আতরের বাসে
সেতারের সুর
ঝুরঝুর। [২]

তিন
তুমি তো তোমার মতন। আর কেউ এরকম নয়। এখন খুব ভয় করে। তুমি নেই। সাদাকে সাদার মতো করে বলবে না কেউ। কেউ কালোকে বলতে পারবে না কালো। বঙ্গদেশে প্রথম গির্জা তৈরি করেন যশোর (বর্তমান শ্যামনগর থানার অন্তর্গত) ঈশ্বরীপুরের রাজা প্রতাপাদিত্য। তার স্থপতি খাজা কামাল রাজার কাছে একটি মসজিদ তৈরির আবেদন জানালে প্রতাপাদিত্য তার অনুমতি দেন। খাজা করিমের কয়েকজন অনুসারী এবং রাজা প্রতাপাদিত্যের তার পক্ষে যুদ্ধ করে নিহত সৈনিকসহ মোট বারো জন মুসলমানের কবর দিয়েছিলেন তিনি যেটি ‘বারো ওমরাহ’ হিসেবে প্রচলিত। বর্তমানে ঈশ্বরীপুর মসজিদ প্রাঙ্গণে দুটি কবরের অস্তিত্ব এখনো বিদ্যমান। তা এতকিছু রেখে প্রয়াত কবির জন্য চোখের জল বুকে চেপে কেন সেই পাঁচশো বছর আগের প্যাচাল পাড়ছি? তার কারণ হলো কবি আসাদ চৌধুরীকে কথার ফাঁকে বহুবার এই প্রসঙ্গটি টানতে শুনেছি । তিনি বারংবার বলতেন অসাম্প্রদায়িকতা শেখার জন্য বিদেশে যেতে হবে কেন? ওরা আমাদেরকে কী শেখাবে? আমাদের সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতির গল্প অনেক পুরানো। আর তার উদাহরণ তিনি এই ঘটনা দিয়ে টানতেন। আর এই আকালের কালে যখন বাংলা ভাষার রাজাধিরাজ আল মাহমুদকে নিয়ে এদেশের সাহিত্যপ্রেমীরা মরা মাছির চিবাতে চিবাতে রং বেরঙের ঢেকুর তোলে তখন তিনি মানে এই যে আসাদ চৌধুরী গণগণে রোদেলা কণ্ঠে বলে দেন, ভাষা আন্দোলনে তার অবদানের কথা, তার ক্ষুরধার লেখনির কথা, তার অনর্গল বিহ্বলতার কথা। কী সুন্দর।

          মৃতদেহ চুপচাপ থাকে,
মৃতদেহ কথা বলে কম, খুব কম কথা বলে।
আসলে লোবান আর আগরবাতি যে ভুবন
গড়ে তোলো, তাতে কথার সুযোগ কম,
স্মৃতিরা তাড়ন করে, মনে-মনে
অনর্গল কথা বলাবলি হয়—
কিন্ত মনে-মনে। ... [৩]

চার
কবি আসাদ চৌধুরীকে ফুলের তোড়া উপহার দিচ্ছেন কবি সাকিরা পারভীন তেইশে ফেব্রুয়ারি রাতে কবির ফোন ‘আমি তো পরশু চলে যাব, সাকিরা’...জি আসাদ ভাই। কালই যাবেন...আমি জানতাম তিনি দেশে এসেছেন। তার শরীর ততো ভালো নয়। যাই যাই করে যাচ্ছি না। প্রায়োরিটি না বুঝলে যা হয় আরকি। তিনি খুব কমের ভেতর অনেক বেশিকে ঠেসে দিতে পারতেন অনায়াসে। তীক্ষ্ম অথচ সরল। তার স্মৃতিগদ্য, প্রবন্ধগুলোতে তার অনিমিখ স্পর্শ। পরদিন চব্বিশে ফেব্রুয়ারি শুক্রবার। গেলাম কবি আসাদ চৌধুরীর বাড়ি। সঙ্গে আমার তিন চার খানা বই। একটি গোলাপের তোড়া আর একখানা কেক আর কিছু মিষ্টান্ন। শুক্রবার দিন। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। দোকানপাট বন্ধ। একে পাই তো তাকে পাই না। মনমতো পাচ্ছি তো পাচ্ছি না। তবু শেষমেশ তাকে উৎসর্গ করা ‘ছড়ানো ছিটানো মন’-এর কপিটিও দিলাম। উৎসর্গে লেখা ছিল ‘আমাদের ভ্রাম্যমাণ ইতিহাস ঘর’। কেকের উপরেও তাই। নিজে হাতে লিখেছিলাম। সংশয় নিয়ে দ্বিধা চেপে। বইগুলো আপনি নেবেন? —আরে কেন নয়? নিশ্চয়ই। আমি জানি বিদেশে যাবার সময় এত কিছু নেয়া যায় না। ওজনের হিসেব নিকেশ থাকে। তবু নিলেন তিনি। বাসায় গিয়ে দেখি সেখানে রয়েছেন উর্দু ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবি শামীম যামানভী। কবি ও অনুবাদক হাইকেল হাশমী আর তার বোন কবি শাবানা নাভেদ। তারা দুজনেই কবিকে চাচা ডাকছিলেন। তাদের তিন জনের সাথেই কবির দীর্ঘ আত্মিক সম্পর্ক। তো তাদেরকে সাথে নিয়ে কেক কাটা হলো। ফুলের ডালাখানি একা দিলাম। আবার সবাই মিলে দিলাম। সেদিন যেন বেশ খানিকটা স্বার্থপর হয়ে উঠেছিলাম। আর না হলে সকলে মিলে দিলেই তো হতো। আবার একা একা কেন। তা হতেই পারে। আমি একা যে তাকে ভালোবাসি। ঘরে ঢুকে তার সামান্য শুকিয়ে যাওয়া শরীর দেখে ভেতরে ভেতরে আতকে উঠি। কিন্তু  ভেতর থেকে তাকে বাইরে বেরোতে দেইনি। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব। অথচ কত কী হতে চলেছে নিকট ভবিষ্যতের পাতাজুড়ে। আর আমার একার মতন সকলেই তাকে ভালোবাসেন প্রতিযোগিতা করে। যেমন প্রতিযোগিতা করে বৃষ্টি নেমেছে একদিন; তার কারণও তো তাই। বাংলাদেশ ভালোবাসে কবিকে। যেমন তিনি ভালোবেসেছিলেন বাংলাদেশকে। অথচ কখনো তাকে বলতে শুনিনি আমি তো মুক্তিযোদ্ধা। এটা করেছি দেশের জন্য। ওটা। শুধু খেদ ছিল বর্তমানকে নিয়ে। বিবিধ অরাজকতা নিয়ে।

পাঁচ
স্বার্থপর কেন সেটা বলি। কোনটা বলব। কোনটা বলবা না। বলে কী হয়? কিছুক্ষণ পর অনেকগুলো কাজ সেরে কবিপত্নী ফিরলেন বাইরে থেকে। এ কী? তোমরা এই ঘরের ভেতরেই। বাইরে গিয়ে বসো। ততক্ষণে জানতে পেরেছি তার রক্তে কোনো একটা গন্ডগোল ধরা পড়েছে। ডাক্তার বলেছে আসতে দেবে না। আমি বলেছি, যেতে আমাকে হবেই। একবার দেশে যাব না তা কী হয়? সব নিয়ম কানুন মেনে কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে এসেছি।

যা বোঝার বুঝে ফেলেছি। ড্রইং রুমের সোফায় বসলাম। তিনি মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে নিশ্বাস ছাড়ছেন। আপনার কি কষ্ট হচ্ছে?

না না তেমন কিছু নয়। ঐ একটু আরকি।

তারও একটু পরে কবির আত্মার সুহৃদ অন্য মেহমানগণ কবির জন্য সর্বোচ্চ দোয়া ও শুভকামনা জানিয়ে বিদায় নিয়েছেন। আমি তবু লোভাতুর। বসে আছি। মনে মনে বলছি, আরেকটু থাকি আপনার কাছে। আর তো থাকা হবে না কোনোদিন । আর তো আপনাকে দেখতে পাব না কোনোদিন।

হয়ত তিনিও তা জানতেন। তাই তিনি তার পরিচিত জনদের প্রায় সকলকেই ফোন দিয়েছিলেন, যেটা তার স্বভাবে ছিল না তেমন। কবিতা শোনাই আসাদ ভাই? ঠিক আসাদ ভাই বলতাম না। মানে অত বড় মানুষ কেমন যেন আটকে যেত মুখে। হয়ত ভাইটা উহ্য থাকত টুশব্দে। হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। এমন করে সায় দেবেন যেন এটাই তিনি চাইছেন। আমি ‘দরজায় মিশ্র ভৈরবী’ থেকে দুটি কবিতা পাঠ করলাম। আর সাথে একটু চোরামি করলাম। নিজেই বাম হাত দিয়ে ফোনের রেকর্ড বাটন চাপ দিয়ে তার দিকে কেমন করে জানি ধরে রাখলাম। ওটুকু বলার সাহস নেই যে আমি রেকর্ডিং করি? খুব ব্যক্তিগত সুন্দরটুকু ধারণ না করাই তো ভালো। তবু করলাম। স্বার্থপরের মতন তাই করলাম। মনে হলো এইটুকু ধরে রেখে দেই। আর তো পাব না তাকে কোনোদিন। তিনি চোখ বন্ধ করে শুনলেন। এইতো অনেক পাওয়া। মাঝে মাঝে মুখ দিয়ে নিশ্বাস ছাড়ছেন। আপনার কি কষ্ট হচ্ছে আসাদ ভাই? না না তেমন কিছু নয়। আসলে কোনটা যে তেমন কিছু তা আমরা বুঝতেই পারি না। ওনার তেমন কষ্টই হচ্ছিল যা তিনি সয়ে নিচ্ছিলেন; যেমন গাছ সয়ে নেয়। যেমন নদী।

ছয়
দুপুর হয়ে আসছে। আর থাকাটা ঠিক নয়। তাই চলে এলাম। সাহস করে মিথ্যা বলে এলাম। আসাদ ভাই সামনের বই মেলার আগেই কিন্তু ফিরে আসতে হবে। তখন গলার ভেতরে দলা দলা মার্বেল। তখন এক অপূরণীয় ক্ষতিবারদিন দুপুর। 

নিসর্গের ব্যাকরণে কিছু সূত্র
জুড়ে দিলে তুমি
আদি নিয়মের মতো
সহাস্য বিদায় নিলে।

মেঘ বললো, যাই। [৪] 

---
আসাদ চৌধুরীর কবিতা থেকে:
১. আবদুল আলীম মারা গেলে
২. প্রতীক্ষা
৩. মৃতদেহ চুপচাপ থাকে
৪. আবুল হাসান-কে

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
জাতীয় দল রেখে ঢাকা লিগে সাকিবের খেলার ব্যাখ্যা দিলেন নির্বাচক
পাপন শুনেছেন, তামিম নাকি সামনের বছর ফিরবেন!
পাপন শুনেছেন, তামিম নাকি সামনের বছর ফিরবেন!
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
তিনটি গ্রাম থেকে সেনা সরিয়ে নিলো ইউক্রেন
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
ভেসে আসা ‘টর্পেডো’ উদ্ধারে কাজ করছে নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ড
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে