X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
শান্তিতে নোবেলজয়ী নাদিয়া মুরাদের আত্মজীবনী

দ্য লাস্ট গার্ল ।। পর্ব-০২

অনুবাদ : সালমা বাণী
১৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৫:৩৪আপডেট : ১৫ অক্টোবর ২০১৮, ১৬:০২

দ্য লাস্ট গার্ল ।। পর্ব-০২

ইয়াজিদি জাতিগোষ্ঠী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের নিজস্ব ধর্ম বিশ্বাসের কারণে বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অন্যান্য ইয়াজিদি শহরের তুলনায় কোচো শহরের অবস্থান বহু দূরে আর মাউন্ট সিনজার সুউচ্চ ও সংকীর্ণ গিরিপথ আমাদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে রেখেছে বংশানুক্রমে। ইরাকি সুন্নী আরব এবং সুন্নী কুর্দি এই দুই পরস্পর প্রতিযোগী ধর্মগোষ্ঠী সব সময়ই চাপের মুখে রেখেছে আমাদের নিজস্ব ইয়াজিদি জাতিস্বত্তা ত্যাগ করে কুর্দি অথবা আরব পরিচয় গ্রহণ করতে। ২০১৩ সালে সম্পূর্ণ পাকা রাস্তা নির্মাণের পূর্ব পর্যন্ত কোচো এবং পর্বত এর মধ্যবর্তী রাস্তা ছিল ধূলিময় দূর্গম। পর্বতের পাদদেশ থেকে সিনজার শহর পর্যন্ত যেতে আমাদের সাদা ডাটসান পিকআপ-এ প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে যেত। আমি বেড়ে উঠেছি পবিত্র মন্দির থেকে দূরে কিন্তু সিরিয়ার কাছে, নিরাপদ আশ্রয় থেকে দূরে কিন্তু বিপদজনক মানুষদের নিকটবর্তী এলাকায়। 

পবর্তের পাদদেশ ধরে গাড়ি ভ্রমণ দারুন আনন্দের ছিল। সিনজার শহরে আমাদের প্রিয় ক্যান্ডি আর ভেড়ার মাংশের বিশেষ স্যান্ডউইচ পাওয়া যেত, যা কিনা কোচোতে পাওয়া যেত না। আমার বাবা প্রায় প্রতিদিনই আমাদের নিয়ে যেত অথবা আমাদের প্রিয় জিনিসগুলো কিনে দিতে যাতায়াতের পথে গাড়ি থামাতো । আমরা ধূলার মেঘ কেটে কেটে এগিয়ে যেতাম। ধূলা মেঘের মতো ঢেকে রাখতো আমাদের যাত্রাপথ, তারপরও আমি গাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতাম খোলা হাওয়ার জন্য। আমাদের পরিচিত উৎসুক প্রতিবেশীদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য আমরা ট্রাকের পেছনে শুয়ে থাকতাম, ওদের পার হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আমি খাড়া হয়ে দাঁড়াতাম—আমার খোলা চুলের ভেতরে বাতাসের দাপট অনুভব করার জন্য। আর দু’চোখ ভরে রাস্তার দুপাশের চরে বেড়ানো প্রাণীদের ঘাস খাওয়া দেখার জন্য। ওভাবে খাড়া হয়ে ট্রাকের পেছনে দাঁড়িয়ে  দৃশ্যাবলীর ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমি এমন তন্ময় হয়ে যেতাম। যে কোন মুহুর্তেই হয়ত হাওয়ায় ভেসে যেতে পারতাম। কখনো আমার বাবা, কখনো আমার বড় ভাই চিৎকার দিয়ে বলতো সাবধান—একটু বেখেয়ালি হলেই তোকে কিন্তু পাহাড়ী বাতাস উড়িয়ে নিয়ে একেবারে রাস্তার ধারে ফেলবে।

পর্বতের মনোরম সৌন্দর্য আর সেই সুস্বাদু ভেড়ার মাংশের স্যান্ডউইচের দোকানের উল্টোদিকে দৃষ্টি মেলে দিলে যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি যায় তার সবটুকু ইরাক। শান্তিপূর্ণ সময়ে যদি কোন তাড়া না থাকে তাহলে কোচো থেকে নিকটবর্তী সুন্নী শহরে শস্য অথবা দুধ বিক্রি করার জন্য নিয়ে যেতে একজন ইয়াজিদি পন্য বিক্রেতার মাত্র পনের মিনিট সময় লাগে। সেই সব গ্রামে আমাদের অনেক বন্ধু ছিল—আমাদের সখ্যতা হয়েছে—বিয়ে বাড়ির মেয়েদের সাথে—কোচোর স্কুলে রাত্রি যাপন করা টিচার, ছেলে শিশুদের মুসলমানির ধর্মীয় আচার রীতি পালনের সময় যে মানুষেরা আমাদের দাওয়াত দিয়েছিলো মুসলমানি অনুষ্টানে, আমরা ওদের ছেলেদের ধরে রেখেছি ধর্মের আনুষ্টানিকতা পালন করার জন্য। এভাবে ক্রমেই এই সব পরিবারের সাথে ইয়াজিদি পরিবারের ‘কিরিভ’(Kiriv) অর্থাৎ পালক মাতাপিতার (God-Parent) সম্পর্ক স্থাপিত হয়।

আমরা যখন অসুস্থ হয়ে পড়তাম তখন মুসলিম ডাক্তাররা কোচো অথবা সিনজি শহরে এসে আমাদের চিকিৎসা সেবা দান করতো। পোশাক, ক্যান্ডি এই রকমের পন্য যা কোচোর দোকানে পাওয়া যেত না, সেই সব নিত্য প্রয়োজনীয় পন্যের সরবরাহ নিয়ে ব্যবসায়ী, ফেরিয়ালার আগমণ ঘটতো কোচোতে। আমার ভাইয়েরা যখন বেড়ে উঠছে তখন হাত খরচের অর্থ যোগানের জন্য ইয়াজিদি গ্রামে গিয়ে তারা নিন্ম মজুরির চাকরি করতো। 

কিন্তু এসবের পরও আমাদের সম্পর্কের ভেতর গভীরতা ছিল না। আমাদের সব রকমের আতিথিয়েতা সত্বেও যখন মুসলমান অতিথিরা বিবাহ অনুষ্ঠান অথবা উৎসব সমূহে আমাদের খাদ্য গ্রহণ করতো না তখন সেটা মেনে নিতে খুব কষ্ট হতো। সত্যিকারের বন্ধুত্ব কিছু কিছু অবশ্যই ছিল—এবং সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কের সময়ের দিকে ফিরে তাকালে আমরা ফিরে যাই অটোম্যান (Ottoman) শাসন, বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ (British Colonization), সাদ্দাম হোসেন (Saddam Hussein), এবং আমেরিকার দখলদারী (American Occupation) সময়ের দিনগুলোতে।

সুন্নি গ্রামবাসীর সাথে আমাদের পরিবারের সুসম্পর্কের কথা কোচোতে সকলেই জ্ঞাত ছিল। কিন্তু সম্পর্ক ক্রমশ অবনতির দিকে যেতে থাকে। এর একমাত্র কারণ ছিল শতাব্দীব্যাপি পুঞ্জিভূত অবিশ্বাস। ইরাকে যখনই কোন প্রকার দাঙ্গা সৃষ্টি হতো—বলতে গেলে সব সময়ই ইরাকে অশান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করতো, তখনই গ্রামবাসীর সব ধরনের ক্ষোভ এসে পড়তো আমাদের ওপর—ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ইয়াজিদি মানুষদের ওপর। এবং দীর্ঘদিনের বৈষম্য, ঘৃণা, সহজেই পরিণত হতো ক্ষোভ ও আক্রোশে।  বিগত দশ বছর যাবৎ যখন থেকে ইরাক ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধ দানা বাঁধছিল, যা শেষ পর্যন্ত ২০০৩ সালে এসে বাস্তব রূপ নেয়—তখনই ওদের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ দাঙ্গায় পরিণত হয় এবং ভয়াবহ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাস আকারে (Terrorism) আর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে আমরা ছিটকে পড়ি বহুদূরে।

প্রতিবেশি গ্রাম বিবর্তিত হয় সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে—যারা ঘোষণা করে খ্রীষ্টান এবং অসুন্নি মুসলমানেরা ইয়াজিদি কাফেরদের মতো এতো ঘৃণিত নহে এবং এই সব কাফেরদের হত্যা করা প্রয়োজন। কাফেরদের হত্যা ধর্ম সন্মত। ২০০৭ সালে সন্ত্রাসীদের একটি দল ট্যাঙ্ক এবং আগ্নেয়াস্ত্রা পরিপূর্ণ তিন গাড়ির বহর নিয়ে কোচো থেকে দশ মাইল উত্তর-পশ্চিমে ইয়াজিদিদের অন্যতম ব্যস্ত শহরের দুটিতে আক্রমণ চালায়। ওরা হত্যা করে শতশত মানুষ আর আগুনে পুড়িয়ে ধ্বংস করে শতশত যানবাহন। প্রথম দিকে এই দুই শহরের মানুষেরা মনে করেছিল আগন্তকেরা হয়ত পন্য বহন করে বানিজ্যের জন্য এসেছে ।

ইয়াজিদিয়ানিজম হলো বহু সনাতন মনোথেষ্টিক ধর্ম। আমাদের ধর্মীয় গুরু, যারা আমাদের পুরাতন ধর্ম কাহিনীতে বিশ্বাস করে তারা আমাদের ধর্মের পবিত্র বাণী মৌখিক ভাবে প্রচার করে এবং এভাবেই আমাদের ধর্ম  প্রচার লাভ করে। মধ্যপ্রাচ্যের অসংখ্য ধর্ম বিশ্বাসের সাথে এই ধর্মের বিশ্বাস ও রীতিনীতির সামঞ্জস্য আছে। মিথরাইজম (Mithraism), জুরোএ্যাসট্রিয়ানিজম (Zoroastrianism)  হতে শুরু করে ইসলাম (Islam) পর্যন্ত এই ধর্মের সাথে সামঞ্জস্য থাকলেও সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এই ধর্মের ব্যাখ্যা খুব কঠিন। এমন কি ধর্মগুরু, যারা পবিত্র প্রাচীন ধর্মকাহিনী মুখস্থ করেছে তাদের জন্যও প্রযোজ্য। আমি নিজেও বিশ্বাস করি আমার ধর্ম সেই প্রাচীনতম বৃক্ষ যার যার হাজার হাজার শাখা প্রশাখা পরিচ্ছেদ গল্পের ছলে বর্ণনা করে হাজার বছরের পুরাতন ইয়াজিদি ইতিহাস। আর এই সব ইতিহাসের অসংখ্যই হচ্ছে  দুঃখ ও বেদনার।

আজ পৃথিবীব্যাপী আনুমানিক এক মিলিয়নের মতো ইয়াজিদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। জন্মাবধি আজ পর্যন্ত আমি এবং আমারা এটাই জেনেছি এবং বিশ্বাস করি আমাদের ধর্ম আমাদের পরিচয় এবং অস্তিত্ব। এবং আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অন্যতম উপায় হলো একত্রে দলবদ্ধভাবে বসবাস। আর এটাই আমাদেরকে বড় বড় ধর্মীয় দলগুলো যেমন অটোম্যান (Ottoman) সাদ্দামের ব্যাথিষ্ট (Baathists) দল, ওদের আক্রমণের লক্ষ বস্তুতে পরিণত করে।  ক্রমাগত আক্রমণের মাধ্যমে আমাদেরকে ওদের অনুগত করার চেষ্টা চালাতে থাকে। ওরা সকলেই আমাদের ধর্মকে ঘৃণা করে, তাদের ভাষায় আমরা শয়তানের উপাসনা করি, অথবা আমরা সকলেই ঘৃণিত এবং আমাদের ধর্ম বিশ্বাস বিসর্জন দেয়ার জন্য বলা হয়।

ইয়াজিদি ধর্মকে বিলুপ্ত করার উদ্দেশ্যে  হত্যাযজ্ঞ, জোড়পূর্বক ধর্মান্তকরণ, জমিজমা, অর্থকড়ি, সম্পদ লুণ্ঠন করে নেয়া হয়েছে। এই সব হিংস্র আঘাত আর আক্রমন সহ্য করে ইয়াজিদিরা বংশানুক্রমিক তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। আমাদের ধর্মের অস্তিত্ব ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বহিরাগত শক্তি আমাদের ওপর নিষ্টুরতম আক্রমণ চালিয়েছে ৭৩ বার। ‘গণহত্যা’ (genocide) শব্দটি শেখার পূর্বে আমরা এই আক্রমণগুলোকে অটোম্যানদের ভাষায় বলতাম ইয়াজিদিদের বিরুদ্ধে ফিরম্যন (Yazidis Firman) ।

যখন দুইজন কৃষককে তুলে নিয়ে যাওয়া হলো এবং মুক্তিপণ বাবদ চল্লিশ হাজার ডলার দাবী করা হলো তখন আমাদের ভেতরে নেমে এলো ভয়ানক ভয় ও শংকা। অপহরণকারীরা টেলিফোনের মাধ্যমে কৃষকদের স্ত্রীদের নিকট এই মুক্তিপণ দাবী করে। অপহরণকারীরা জানায় মুক্তিপণের অর্থ প্রদান করো আর না হয় পরিবার পরিজন সহ আমাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করো, অন্যথায় তোমাদের দুজনকে আমরা হত্যা করবো। এটা শুধু অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে মুক্তিপণ দাবী ছিল না। শোকে মুহ্যমান কৃষকদের স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে গ্রামের মোখতার অথবা গ্রাম প্রধান আহমেদ জাসোর বলেন—এই চল্লিশ হাজার ডলার এর দাবী নয়, একটি ওছিলা মাত্র। আমরা জানি আমাদের কৃষকরা মৃত্যুকে গ্রহণ করতে প্রস্তুত কিন্তু তারা ধমান্তরিত হবে না। গ্রাম প্রধানের এই আশ্বাসে গ্রামবাসীর চোখের জল প্রবোধ মানে। অল্প সময়ের ভেতরে অপহৃত দুইজন কৃষক ভাঙ্গা জানালা দিয়ে পালাতে সক্ষম হয়। রাতভর বার্লি ক্ষেতের ভেতর হামাদিয়ে যখন তারা বাড়ী পৌঁছায় তখন তাদের হাটু পর্যন্ত ধূলায় ডুবে ছিল এবং তাদের চেহারা ছিল ভয়ে বিবর্ণ। কিন্তু কখনোই অপহরণের পরিসমাপ্তি ঘটেনি ।  

দিসহান (Dishan)’র অপহরনের পরপরই একজন লোককে আমাদের বাড়িতে কাজের জন্য নিয়োগ দেয়া হয়। সিনজার পর্বতের নিকট থেকে তাহাসকে (Tahas) অপহরণ করা হয়, সেখানে কর্মচারীটি আমাদের ভেড়া পাহারা দিতো। ভেড়াগুলো ক্রয় করতে এবং সেগুলোর প্রজনন বৃদ্ধি করতে আমার মা এবং ভাইদের বছরের পর বছর লেগেছে। এক একটি ভেড়ার জন্ম ছিল আমার মা ও ভাইদের জন্য একটি বিজয় স্বরূপ। আমরা আমাদের এইসব প্রাণীদের নিয়ে অহংকার করতাম। যখন তারা গ্রামের বাইরে চরতে যেত না তখন আমরা তাদেরকে গৃহপালিত প্রাণীর মতো সেবাযত্ন করতাম। বছর শেষে সকলের মাঝে সমান ভাগে ভেড়ার লোম বন্টন ছিল আমাদের নিকট ধমীর্য় রীতির মতো পবিত্র-প্রিয় বিষয়। এই রীতি আমার ভীষণ প্রিয় ছিল। মেঘের গুচ্ছের মতো ভেড়ার নরম উল যখন স্তুপীকৃত হতো, ভেড়ার পালের নীরব আনুগত্যের মতো আমাদের বাড়ির বাতাসও ভরে উঠতো মদির মাস্কি গন্ধে। ফুল-ছাপা কাপড়ের দুই টুকরা জোড়া দিয়ে তার ভেতরে ভেড়ার কোমল উল দিয়ে আমার মা যে নরম কমফোর্টার তৈরি করতো, তার নিচে ঘুমাতে আমি খুব ভালবাসতাম। আর যখন মাংশের জন্য ভেড়াকে জবাই করার সময় আসতো সেই সময় আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতাম। কারণ আমি ভেড়াদের সাথে এতো বেশি ঘনিষ্ট হয়ে যেতাম যে, আমার পক্ষে এটা ধারণ করা কঠিন ছিল। যখন দিসহানকে অপহরণ করা হয়েছিল সে সময়ে আমাদের ভেড়ার সংখ্যা ছিল শতাধিক—যা ছিল সত্যিকার অর্থেই আমাদের সৌভাগ্য স্বরূপ। 

আজও মনে পড়ে—যখন অন্যান্য কৃষকদের সাথে আমাদের মুরগি এবং মুরগির বাচ্চাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো সেদিন আমার ভাই সাঈদ সিনজার পর্বতের পাদদেশে   পিকআপ ভ্যানের পিছে প্রতিযোগীতায় নামার মতো দৌড়েছিল। সিনজার পর্বত-এর পাদদেশ থেকে মাত্র কুড়ি মিনিট, আমাদের ভেড়ার পালকে ঠেকানোর জন্য সেই রাস্তা এখন বাঁধানো। অবশ্যই আমাদের সমস্ত ভেড়ারপালদের কেড়ে নেয়া হয়েছে এবং আমরা শোকে মাতম করেছি। কারণ এই ভেড়াগুলোই ছিল আমাদের জীবিকার একমাত্র সম্বল।

বেলাশেষে যখন আমার ভাই সাঈদ আমাকে ফোন করে, ওকে খুব বিপন্ন বিহ্বল শোনাচ্ছিল। মাকে সে জানায় শুধু মাত্র দুটো ভেড়া ছিনতাই করে নিয়ে গেছে—যার একটা যবুথবু চরে বেড়ানোর অযোগ্য বুড়ো মরদ ভেড়া এবং দ্বিতীয়টা বাচ্চা মাদী ভেড়া। পালের আর বাকী সবগুলো গাঢ় বাদামী সবুজ ঘাসের ভেতরে দলবেঁধে চরে বেড়াচ্ছে, ওদের নিয়ে আমার ভাই বাড়ি ফিরবে। ভাইয়ের এই কথায় আমরা খুব আনন্দিত হলাম, হাসির জোয়ার এলো যেন, আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু আমার বড় ভাই ইলিয়াস খুব উদ্বিগ্ন হলো, তার চেহারায় তৎক্ষণাত দুশ্চিন্তা স্পষ্ট হলো, সাথে সাথে সে মন্তব্য করলো—আমি বুঝতে পারছি না, ঐ গ্রামের বাসিন্দারা ধনী নয়, ওরা তাহলে কেন ভেড়ার পাল ফেলে রেখে গেল? তৎক্ষনাত সে সক্ষম হলো এটার ভিন্ন অর্থ অনুধাবন করতে।

যেদিন দিসহানকে অপহরণ করা হলো সেদিন ভয়ংকর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে কোচোর মানুষেরা। ঘরে ঘরে দানা বাঁধে উত্তেজনা।  আমাদের গ্রামের সীমানায় নতুন চেক পয়েন্ট বসানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য গ্রামবাসীরা সবাই জড়ো হয়। সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় এখন থেকে কোন অচেনা গাড়ী কোচোতে প্রবেশ করতে দেখলেই তার ওপর নজরদারি করা হবে। হেনজি আমার আরেক ভাই যে সিনজার শহরে পুলিশে চাকরিরত। সে তখন বাড়ি ফিরছে, সেও তৎক্ষণাত সেই সমাবেশে উপস্থিত হয়। প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য দিশহানের চাচা কোচোর পুর্বাঞ্চলে অবস্থিত রক্ষণশীল সুন্নি গোত্রের গ্রামে অভিযান পরিচালনায় নেতৃত্ব দিতে প্রতিজ্ঞা করে। ক্ষোভের সাথে সে ঘোষণা করে ”আমরা ওদের দুটি ভেড়া কেড়ে নেবো” তাহলে ওরা আমাদের দিসহানকে ফেরত দিতে বাধ্য হবে।

এটা ছিল খুব ঝুঁকিপূর্ণ পরিকল্পনা, ফলে সকলেই দিসহান’র চাচাকে সমর্থন জ্ঞাপন করে না। এমন কি আমার ভাই—যে উত্তরাধিকার সূত্রে ধারন করে আমাদের পরিবারের ঐতিহ্যমন্ডিত দুঃসাহসিকতা এবং আমার বাবার নিকট থেকে যুদ্ধের পারদর্শিতা, সেও দ্বিধান্বিত হলো এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে। সাঈদ ছিল আমার থেকে মাত্র কয়েক বছরের ছোট। সে সারাক্ষণ কল্পনার জগতে স্বপ্নে বিভোর থেকেছে যে, একদিন সে তার বীরত্ব ঠিকই প্রদর্শন করতে পারবে। যা হোক, সে প্রতিশোধ গ্রহনের পক্ষে সমর্থন জানালো। কিন্তু আমার থেকে এক যুগ অর্থাৎ বারো বছরের বয়োজ্যেষ্ঠ সকলের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য ছিলো যে ব্যাপারটি সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ও বিপদজনক। পরবর্তীতে হেনজির নিষেধ উপদেশ অগ্রহ্য করে দিসহানের চাচা যে কয়েকজনের সমর্থক পায় তাদের সহযোগে সুন্নি আরব ভেড়াপালকের নিকট থেকে দুটি ভেড়া কেড়ে নেয়। এবং ভেড়ার পালকদের কোচোতে এনে নিজ গৃহে বন্দী করে রাখে। (চলবে)

আরো পড়তে ক্লিক করুন: দ্য লাস্ট গার্ল ।। পর্ব-০১ 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
বেচাকেনা জমজমাট, কম দামে ভালো পাঞ্জাবিতে আগ্রহ ক্রেতাদের
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
‘মাঝেমধ্যে ভাবি, আইপিএল কি আদৌ ক্রিকেট’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
ঈদে আরিয়ানের একমাত্র নির্মাণ ‘তখন যখন’
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
করোনার পর মাধ্যমিকে ১০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়