X
সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
১৬ আষাঢ় ১৪৩২

সাকরাইন

শফিক আজিজ
১৯ এপ্রিল ২০২০, ২০:০০আপডেট : ১৯ এপ্রিল ২০২০, ২০:০০

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্য সাকরাইন তিনপাশে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং উঠলেও তিনতলা বাড়িটি তার পুরনো অবয়ব আর ঐতিহ্য নিয়ে বুড়িগঙ্গামুখী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী বাড়িটির চুন-সুড়কি গেছে খসে; দেয়ালের গাত্রে গাত্রে জন্মেছে গুল্মলতা, আড়কাঠগুলো পড়ো পড়ো, সিঁড়ি জড়িয়ে বেড়ে উঠেছে মাঝারি এক বটবৃক্ষ। মালিক আব্বাস সরদারের কাছে ডেপেলপার কোম্পানির অনেকেই বাড়িটি ভাঙার প্রস্তাব করতেই তিনি পানের পিক মিশ্রিত ঠোঁটে হাসিমেখে সাদা লুঙ্গির বাম অংশ সামান্য টেনে বলেন, জব্বর কথা কইতাছেন হালায়...উপরঅলার ইচ্ছায় ট্যাহা-পয়ছাভি কম কামাইনাইক্যা...ধানমন্ডি-গুলছানে আজদাহা বাড়িভি করছি...পোলা-মাইয়্যা-নাতি-নাতকুররা দ্যাছ-বিদ্যাছে বালই আছে..বিবিরে লইয়্যা হজওভি কইর‌্যা আইছি...থাইক ন্যা বাপ-দাদার ওই চিন্নডা...। তো এ কথা শোনার পর কেউ আর দ্বিতীয়বার তার কাছে আসার সাহস করেনি।

পিয়াল নয়ারহাট স্পিনিং মিলের রোলিং সেকশনে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করে। তুলা থেকে নানা প্রক্রিয়ায় উৎপাদনকৃত সুতা রোলিং সেকশনের রোলগুলোতে অটোমেশিনে পেঁচিয়ে ফিনিশিং প্রোডাক্ট তৈরি হয়। পিয়ালের কাজ হলো, পেঁচাতে গিয়ে সুতা ছিঁড়ে গেলে ছেঁড়া অংশটি হাতদিয়ে পুনরায় রোলে জুড়ে দেয়া। শিফটিং সেকশন বলে চব্বিশ ঘণ্টাই রোলগুলো ছন্দময়গতিতে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে, সেই সঙ্গে থাকে একটি রিদমিক সুর; সবমিলিয়ে একটি নান্দনিক দৃশ্যপট পিয়ালকে সবসময় আচ্ছন্ন করে রাখে। মাঝেমধ্যে সে নিজেকে সুতার সঙ্গে মেলায়; ভাবে সে তো আসলে ছিঁড়ে যাওয়া সুতা, জুড়ে দেয়ার কেউ নেই দুনিয়াতে। আবার এও ভাবে যে রোলের সঙ্গেই তার মিল বেশি; প্রতিনিয়ত সে চক্রাকারে ঘুরছে, অথচ সে জানে না তার গন্তব্য কোথায় বা আদৌ আছে কী না। কখনো মনে হয় সুতা ছিঁড়ে সে উড়বে কাটা ঘুড়ির মতো কিংবা এই রোলগুলো একদিন হেলিকপ্টারের পাখার মতো তাকে উড়িয়ে নেবে; উড়িয়ে নেবে তার মায়ের কাছে, যে মায়ের কোনো স্মৃতিই মনে করতে পারে না সে। শুধু এইটুকু শুনেছে রোড অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যু হয়েছে তার।

কদিন পরেই সাকরাইন। সাজ সাজ রব পাড়া-মহল্লায়। ছাদে ছাদে হবে ঘুড়ি কাটাকাটির উৎসব। পায়েল মিল থেকে এক নাটাই পরিমাণ সুতা সংগ্রহ করে মাঞ্জা মেরে রাখে। কাচ গুঁড়ো করে তার সঙ্গে ময়দা মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে কাই তৈরি করে সুতায় মিশিয়ে ধারাল করাকেই বলা হয় মাঞ্জা মারা। শাঁখারি বাজার থেকে একটি ঘুড়ি ও নাটাইকেনে সে।

সাকরাইনের বিকেলে ছুটি নিয়ে পিয়াল আব্বাস সরদারের পোড়ো বাড়িটির ভাঙাচোরা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যায়। মাল্টিস্টোরিড ছাদ থেকে আকাশে উড়ছে হরেক রঙের ঘুড়ি...কাটাকাটি খেলছে...গুত্তা মারছে...টাল খাচ্ছে...কোনটি ভূ-কাট্টা হয়ে বুড়িগঙ্গার দিকে উড়ে একসময় মিলিয়ে যাচ্ছে। পিয়ালও খেলা শুরু করে, মেতে ওঠে কাটাকাটি খেলায়। নিপুণ কৌশলে নাটাই ঘুরিয়ে...দুহাত উপড়ে নিয়ে...কখনো আবার নিচে নামিয়ে তার ঘুড়িকে নিজ আয়ত্তে নিয়ে আশেপাশের সব ঘুড়ির সুতা কাটতে থাকে। তাকে যেন নেশায় পেয়ে বসে; পাগলের মতো আকাশের সব ঘুড়ির সুতা কাটতে থাকে, এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী খেলোয়াড়ে পরিণত হয় সে। আশেপাশের ছাদ থেকে সবাই তাকায় আব্বাস সরদারের পোড়ো বাড়িটির ছাদে, দেখতে থাকে অপরিচিত এই বিস্ময় বালকটিকে।

হঠাৎ তারা দেখতে পায় নাটাই ও ঘুড়িসহ ছেলেটি ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছে; উঠতে উঠতে ছেলেটি হরেক রঙের ঘুড়ির সঙ্গে আকাশে উড়ছে। উড়তে উড়তে ছেলেটি অন্য কাটা ঘুড়ির সঙ্গে গুত্তা মেরে মেরে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গার উপর দিয়ে উড়ে একসময় অদৃশ্য হয়ে যায়।

পরদিন সব পত্রিকায় লাল হেডে একটি নিউজ হয় যার শিরোনাম,—‘পুরান ঢাকায় আড়াইশ বছরের বিল্ডিং ধস: হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।’ নিউজের ভেতরের একটি অংশে আব্বাস সরদারের চোখ আটকে যায়—‘এলাকাবাসীসূত্রে জানা যায় বাড়িটি ধসে পড়বার আগে এলাকায় অপরিচিত পনেরো বছর বয়সি একটি বালক ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল। তবে ফায়ার ব্রিগেডের উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসস্তূপ বা আশেপাশে মানুষ বা কোনো পশুপাখিরও অংশবিশেষ পায়নি।

আব্বাস সরদারের মনে পড়ে পনেরো বছর আগে এক সাকরাইনের রাতে তার বাড়ির কাজের মেয়ে রেহেলাকে সে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। সবাই এটা জেনেছিল যে মেয়েটি সরদারের গদির কয়ালের সঙ্গে ভেগে গেছে। কিন্তু তারা কেউ এখনও এটা জানে না যে কয়ালের লাশটি পড়েছিল বুড়িগঙ্গায় আর রেহেলা পেয়েছিল তার পেটের সন্তানসহ তাকে হত্যার হুমকি। নিজেকে না, পেটের সন্তানকে বাঁচাতেই রেহেলা সেদিন পাথরে মুখ গুঁজে গড়িয়েছিল অন্যখানে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগ নেতা হারুন গ্রেফতার
সাতক্ষীরা জেলা আ.লীগ নেতা হারুন গ্রেফতার
মিয়ানমারে ঋতুপর্ণার অন্যরকম প্রশান্তি
মিয়ানমারে ঋতুপর্ণার অন্যরকম প্রশান্তি
মঙ্গলবার ব্যাংক হলিডে, বন্ধ থাকবে লেনদেন ও শেয়ারবাজার
মঙ্গলবার ব্যাংক হলিডে, বন্ধ থাকবে লেনদেন ও শেয়ারবাজার
সেই ফজর আলী হাসপাতালে, নতুন মামলার আসামি ৩০
সেই ফজর আলী হাসপাতালে, নতুন মামলার আসামি ৩০
সর্বাধিক পঠিত
তিন বিমানবন্দরে ১৬ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে
তিন বিমানবন্দরে ১৬ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার
ব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ
ব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ
যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতায় রফতানি ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্র-চীন সমঝোতায় রফতানি ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
রূপপুর প্রকল্পের ১৮ প্রকৌশলী অপসারণ: হাইকোর্টের রুল
রূপপুর প্রকল্পের ১৮ প্রকৌশলী অপসারণ: হাইকোর্টের রুল