X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

হ্যারল্ড পিন্টারের মানুষজন

শুভ্র শাহেদ
১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:১৭আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০১:২১

হ্যারল্ড পিন্টার হ্যারল্ড পিন্টার নাট্য-প্রেমিদের কাছে ‘বার্থডে পার্টি’র জন্য পরিচিত; বা ‘দ্য হোমকামিং’-এর জন্য। সামান্যই পরিচিত বলা যায় অবশ্য। তবে এই পরিচিতি মলিয়ের, ইবসেন বা ব্রেখট দূরে থাক বেকেট, সার্ত্রের সঙ্গে তুলনাও করা যায় না। বাঙালি সমাজে ব্রেখট, ইবসেন এবং সার্ত্র পরিচিতি পাবার কারণ বৈশ্বিক-স্থানীক সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি। তবে আজকের পৃথিবী ব্রেখট-ইবসেন থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। সেই রাজনীতিও নেই। যদিও হ্যারল্ড পিন্টার সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধবিরোধী বক্তব্য রেখেছেন সবসময়, কিন্তু তার নাটক অন্যরকম। অন্য এক শৈলী তিনি আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। সেই শৈলীটি কী—সহজ করে বললে, তার নাটক বিমূর্ত, পাত্রপাত্রী অনিশ্চিত। পেছনের কাহিনি নাট্যকার ঢেকে রাখেন, বা উন্মুক্ত করেন ততটুকুই যতটুকু কথাবার্তার মধ্যে ফুটকি মারে।

আমরা যদি ‘বার্থডে পার্টি’র কথা ভাবি, দেখবো স্ট্যানলি পাঠককে বিরক্ত করে ছাড়বে বোডিং হাউসের মালিক এক বৃদ্ধ দম্পতি পিতে-মেগের স্নেহ ভালোবাসাকে পাত্তা না দিয়ে দিয়ে, উল্টো তাদের স্ল্যাং বলে হরদম। স্ট্যানলির পরিচয়ও অনিশ্চিত, সে কি সারা দুনিয়ায় পিয়ানো বাজিয়ে বেড়িয়েছে? নাকি ধীরে ধীরে বলবে, সারা দেশে, বা একটি কনসার্টে। কী একটা রহস্য যেন তার সম্পর্কে উদঘাটন হতে হতেও হয় না। কখনো মনে হয় হয়ত সে খুনি, বা ভয়াবহ সিরিয়াল কিলার, আত্মগোপন করে আছে। স্ট্যানলির জন্মদিনে গোল্ডবার্গ-ম্যাকান নামের দু’জন আগন্তক আসে, তারা ট্যানলিকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে। মনে হবে তারা পূর্বপরিচিত, বা গোয়েন্দা সংস্থার কেউ ট্যানলিকে পাকড়াও করতে এসেছে। সবাই প্রায়-বাধ্য করে ট্যানলির জন্মদিন পালন করে, যদিও স্ট্যানলি বলে আজ তার জন্মদিন নয়, এবং এরই মধ্যে স্ট্যানলি বৈদ্যুতিক গোলযোগ ঘটিয়ে ধর্ষণ করেও ফেলে। স্ট্যানলি কি মানসিক বিকারগ্রস্ত? শেষমেশ ওই দুই আগন্তুক নিয়ে যায়, হয়ত খুন করবে, বা চিকিৎসা করাতে।

পিন্টারের নাটকে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য ভরপুর, যা শেষ পর্যন্ত পাঠককে সুনিশ্চিতভাবে কিছু বলে না। জন রাসেল ব্রাউন বলেছেন ‘পিন্টারের ডায়লগে মিথ্যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যখন একটি দৃশ্য থেকে অন্য দৃশ্যের দিকে তা সতর্কতার সঙ্গে উল্লেখ করা হয়, তখনই ...আরও কিছু দারুণ মিথ্যা এতই সহজভাবে বলা হয় যেন তা দর্শকদের কাছে প্রকাশ হওয়ার চেয়ে আরও বেশি কিছু দেখানোর জন্য উৎসাহী করে। দর্শকদের এই আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করা এবং বারবার এই আকাঙ্ক্ষা ব্যর্থ করা পিন্টারের কৌশলের একটি অংশ।’

[falsehoods are important for pinter's dialogue, not least when they can be ditected only by careful reference from one scebe to another...some of the more blatant lies are so casually delivered that the audience is encouraged to look for more than is going to be disclosed. This is a part of pinter's two-pronged tactic of awakening the audience's desire for verification and repeatedly disappointing this desire.]

‘বার্থডে পার্টি’ লেখার সময় লেখকের মানসিক অবস্থা কেমন ছিল তা জানা যায় তার একটি চিঠির কয়েকটি লাইনে, ‘আমার সব নোংরা অসুস্থ খোঁচা, এক নারীর বিশাল মোটা ভেড়ার মতো ঘাড় যার বুক ঝুলে আছে পেটের কাছে, একটা অশ্লীল ঘরকন্না, বেড়াল, কুকুর, নোংরা, চা-ছাঁকনি, এলোমেলো, ওহ্ বলদগুলো, কথা, বাতচিৎ, ফালতু দাগ, পুরীষ-বিষ, ছেলেমিপনা, ঊর্ধ্বমুখী নকশার কাজে অভাবী বিন্যাস, ...রোল অন।’ [কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের অনূদিত অংশটুকুর স্ল্যাং পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে—সম্পাদক] ...আর এই মহিলাটিই হলেন নাটকের চরিত্রটি ‘মেগ’ এবং আরও একজন ছিল যে ইস্টবোর্নে, সৈকতের উপরে থাকতো।’ তার নাটকে স্ল্যাং-এর শক্তিও অসাধারণ।

‘দ্য হোমকামিং’ তো আরও ভয়াবহ স্ব-বিরোধীতা, অস্পষ্টতা এবং অভ্যন্তরীণ সত্য। এই নাটকে দেখা যায় বৃদ্ধ ম্যাক্স তার দুই ছেলে, এক ভাইকে নিয়ে পৈতৃক বাড়িতে থাকেন। তিনি বাসার সবার জন্য রান্না করেন, কর্মজীবনে তিনি কসাই ছিলেন। তাদের কথাবার্তা অত্যন্ত বেরসিক, স্ল্যাং-এ ভরা, বাবা-ছেলে প্রায় মারামারি উন্মুখ থাকে। হঠাৎ করে ম্যাক্সের বড় ছেলে টেডি—যে বহুকাল লাপাত্তা—এখন আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক, তার স্ত্রী রূথকে নিয়ে ছুটি কাটাতে আসেন বাবার বাড়িতে। রূথের এই প্রথম শ্বশুরবাড়িতে আসা। টেডি বিয়ে করেছে কিনা তা তার বাবা-চাচা, ভাইয়েরা জানে না, তাদের তিনটি সন্তানও আছে। স্বাভাবাকিভাবেই এই পর্যন্ত এসে নাটকের নামের সঙ্গে একটি আনন্দের ব্যাপার তৈরি হতে পারে, কিন্তু তাদের বাড়ি ফেরাটা পরে জাহান্নাম হয়ে যাবে, বা প্রকৃত সত্য উঁকি-ঝুঁকি মারবে। রূথ পতিতা কিনা—টেডি তার বাপ-ভাইদের অশ্লীল আকাঙ্ক্ষা মেটাতে এ বাড়িতে তাকে রেখে যায়, সেও থেকে যায়; রূথকে শহরে রুম ভাড়া করে পতিতাবৃত্তি করার সুযোগ তৈরি করে দেবে আরেক ভাই, যে কিনা দালালও—টেডির সঙ্গে বিয়ে হয়েছে কিনা, সন্তান আছে কিনা তা তো দূরস্থান। টেডির অধ্যাপকের পরিচয়ও শেষে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠবে। তাহলে কেন টেডি রূথকে নিয়ে মাঝরাতে বাবার বাড়িতে ওঠে—এই প্রশ্নের উত্তর নেই, প্রথমে অনুমান করা যাচ্ছিল হয়ত শোয়ার সুযোগ খুঁজতে। তার এক ভাই প্রকাশ্যে যেভাবে রূথের শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকছে, আরেক ভাইয়ের পতিতাবৃত্তি করে তার পেট চালানোর উপায় বাতলে দেয়া এবং বাবার তাতে সমর্থন, অবিরাম স্ল্যাং ও অবদমনের ঝড় পুরো পরিস্থিতিকেই উল্টেপাল্টে দেয়।

এই পরিবারের মধ্যকার যে রক্তসম্পর্ক তা আশ্চর্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ ডায়লগে মনে হয় এরা পরস্পরকে খুন না করে বেঁচে থাকতে পারবে না। কিন্তু বেঁচে থাকে, এটাই আশ্চর্য। রূথ একইসঙ্গে মা, পতিতা ও স্ত্রী ভূমিকায় জড়িয়ে পড়ে হয়ত।

পিন্টারের সব নাটকেই এমন অস্পষ্টতা লক্ষ্য করি। The Dumb Waiter নাটকে ক্লান্তিকরভাবে দুটি চরিত্র গাস ও বেন, যারা পেশাদার খুনি, একটি রুমের মধ্যে চা বানানো নিয়ে তর্ক-বিতর্কে মেতে আছে। তাদের মধ্যে হৃদ্যতার সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেওও একজন খুন হবে, কেন হবে সেটা স্পষ্ট নয়, খুনি শুধু নির্দেশ পালনকারী।

A Slight Ache নাটকে দেখি এক বৃদ্ধ ম্যাচ বিক্রেতাকে, যার কোনো ক্রেতা নেই, সে বেচতে চায় কিনা তাও সন্দেহ, দাঁড়িয়ে থাকে এডওয়ার্ড-ফ্লোরার বাড়ির বাইরে দেয়াল ঘেষে। তাকে নিয়ে দুজনের উত্তেজনা, ঈর্ষা, সন্দেহ। ওই বৃদ্ধকে তারা বাড়িতে ডেকে আনে। বৃদ্ধ বোবা-কালা কিনা নিশ্চিত হতে পারা যায় না। তার ম্যাচবাক্সও ভেজা। একটি অচল-অক্ষয় মনুষ্যমূর্ত হয়ে সে কী বোঝাতে চায় তাদের। তিনিই কি এডওয়ার্ডের ভবিষ্যত রূপ?

পিন্টার কম পরিসরে পঠিত বা চর্চিত হলেও এবসার্ড নাট্যচর্চার পরিসর দিনদিন বাড়ায় তিনি নানান ভাষায় অনূদিত হচ্ছেন। তবে তাকে নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় বাধা যায় না। তিনি মূর্ত থেকে বিমূর্ততায় জার্নি করেন সহজেই এটাই তার বড় একটি লক্ষণচিহ্ন।

পঞ্চাশ বছর পরের পৃথিবীতে তিনি কীভাবে পঠিত হবেন—প্যারিস রিভিউর এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘...বিশ্বজনীনতার কোনো আগ্রহ আমার নেই, আমার শুধু একটি নাটক লেখার জন্যে এখনো যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।’ যদিও পৃথিবীর পঞ্চাশটি বসন্ত অতিক্রান্ত হয়েছে অনেক আগেই।

তথ্যসূত্র :

১. হ্যারল্ড পিন্টার, দ্য আর্ট অব থিয়েটার, সাক্ষাৎকার : ল্যারি বেনস্কি, অনুবাদ : কুন্তল মুখোপাধ্যায়।

২. হ্যারল্ড পিন্টারের চারটি নাটক, অনুবাদ : রবিউল আলম

৩. হ্যারল্ড পিন্টারের দুটি নাটক, অনুবাদ : ড. ইনামুল হক

৪. উইকিপিডিয়া

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
ডিভোর্স দেওয়ায় স্ত্রীকে কুপিয়ে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন স্বামী
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!