জন্মের প্রার্থনা
কবরের প্রতীক্ষায় থাকা একজন বৃদ্ধ যদি
আমাকে আশীর্বাদ করে কাঁপা কাঁপা হাতে
খনি আর তাঁতকল ফেরা একজন শ্রমিক যদি
ভাই বলে ডাকে
যদি ভালোবেসে বুকে নেয় কালি ঝুলি মাখা হাতে
একজন তরুণ যদি তারুণ্যের মিছিল জুড়ে
আমার স্লোগান তোলে
পাড়াগাঁর বধূ আর কিশোরীরা যদি
আমার কবিতা পড়ে জলকেলি করে
কখনো-সখনো কাঁদে
একজন মাঝি যদি পাল ও বৈঠার প্রেমে
আমার কবিতা থেকে গান তুলে ছুড়ে দেয় মুগ্ধ হাওয়ায়
মুক্তিযোদ্ধারা যদি মৃত্যু ও বারুদের ঘ্রাণে
ভালোবাসে আমার কবিতা
আমি সেদিন বলবো
সমস্ত প্রার্থনা আজ শেষ হয়েছে
জন্মের ঋণ আমি স্বীকার করেছি।
বিদায় উপমা
পালঙ্কে কে আছে শুয়ে? সে কি কোনো নারী?
শরীর, আঁচল খুলে পড়ে আছে উস্কোখুস্কো কবির মতোন
সে কি কোনো কবি?
কবিতার কণ্ঠলগ্ন শুয়ে আছে প্রতিমা প্রেমিক
এ যেন পালঙ্ক নয়, তৃণশয্যা, পুষ্পশয্যা নয়
বেহুলা পেখম তুলে ভেসে যাচ্ছে ভেলা
অমৃতপিয়াসী কোনো কবির নগরে।
পালঙ্কে কে আছে শুয়ে? সে কি কোনো শবের উপমা?
সে কি কোনো স্রোতের উপমা?
জলের মাস্তুলে চড়ে দূর দেশে যায় কবি
নারী যায়, পাখি যায়—ভেসে যায় শঙ্খশুভ্র ঘাস
নারী যায়, কবি যায়, কবি যায়...
পালঙ্কে কে আছে শুয়ে? সে কি কোনো বিদায় উপমা?
এসেছি নিজের ভোরে
আলোকে বরণ করো, দ্যাখো আমি দু'হাত তুলেছি
বনভূমি পাড়ি দিয়ে ভোরবেলা শস্যক্ষেত হবো
আমার মৃত্যুর দিনে মা আমাকে দেবে দুধভাত
যতটা বালক আমি তত মুগ্ধ এই আঁখিতারা।
ভ্রূপল্লবে কেঁপে ওঠে গুহামুখে নিদ্রাহীন ফুল
সবুজের একতারা, এই তার নির্জনের ধ্বনি
আশ্রমের কবুতর দ্যাখো আমি ফুলের শোণিতে
দিগন্ত ভাসিয়ে তবু নিজ রক্তে রেখেছি দহন।
এসেছি নিজের ভোরে। সব আলো আকাশে মেলেছি
হিমবাহ কেটে গেলে আমি তার চূর্ণ ধরে রাখি
দ্যাখো এত শুভ্র ফুল কার নামে খুলেছে হৃদয়
তাদের সবার লাশ তুলে আনি অন্ধকার থেকে।
মানুষের মৃত্যু হলে
ভেতরে কীসের খেলা? অ্যারিনায় কীসের উল্লাস?
আমি কি ভেতর যাবো—শতখণ্ড শত মাথা রুদ্ধবাক বিপন্ন সময়
রাজা পরিতৃপ্ত খুব। বুড়ো আঙুলের ইশারায় শব্দ ওঠে
হত্যা করো, করো বধ
কে কাকে নিশ্চিহ্ন করে? কারা হত অসম সমরে?
রাজাজ্ঞা পালিত হলে কী আনন্দ দ্যাখো চারদিকে।
লাল দেখে ক্ষ্যাপা ষাঁড়—প্রতিপক্ষ সেও এক দাস
আহা কী মজার খেলা, অ্যারিনায় অস্থির মানুষ
মারো কাটো—বিদ্ধ করো
কে যে কাকে বিদ্ধ করে—মানুষ না জানোয়ার?
দ্যাখো
মানুষের মৃত্যু হলে সভ্যতায় টিকে যাবে ষাঁড়।
সবুজ মদিরা
সবুজ মদিরা তুমি শেষতম বিরহের আগে
আমার পথের পাশে আঙ্গিনায় রাগে ও বিরাগে
কিছুকাল পাশে থেকো—মৃত্যুকেই তুচ্ছ জ্ঞানে জয়
ধূলি ও সাগর দৃশ্যে বেঁচে থাকা যদি সত্য হয়
তবে সে সৌরভ লিখো কিছু যার পাখিদের চোখে
গোধূলি, রক্তাভ ছায়া, নিশিকাল পরাগের শোকে
মাটি ও মায়ার বৃত্তে অশ্রুময় শ্রুতিময় থেকো
বালক হারিয়ে গেলে ওগো দ্রাক্ষা তাকে মনে রেখো
মুহূর্ত স্মৃতির বাক্যে এই অশ্রুনিকুঞ্জের পাশে
একটি শোকার্ত হাত ধূলিতেই রেখো ভালোবেসে।
কাঁটাতার
রাষ্ট্র যদি সীমারেখা, কবি তবে আরো দূরগামী
সবুজের জাত নেই, রক্তে কোনো অধর্ম থাকে না
মানচিত্রে নদী থাকে, সাদা কালো স্রোতে একাকার
জীবাশ্ম, উপলখণ্ড, সেইসঙ্গে নুড়ি, অণুজীব
সব ভাসে পদ্মা বক্ষে—গঙ্গানদী, ফোরাতের কূল
সবাই সাগর খোঁজে—জলভাগ মানবতাবাদী।
সে তবু আমাকে কেন নৃতত্ত্বের ভিন্ন পাঠ দেয়
ইতিহাস ব্যাখ্যা করে স্মৃতিকার ভাড়াটে ভাষায়
অযোধ্যা, বাবরনামা—পথে পথে খুনি দাঙ্গাবাজ
কবিরও মুক্তি নেই জাতিতত্ত্ব, রোয়েদাদ থেকে!
হানাহানি, রক্তপাত—একবিশ্বে বিভক্ত পৃথিবী
কবি তার অংশ নয়—তার নাম চিরমুক্ত পাখি
জন্ম যদি চুরুলিয়া মৃত্যু তবে ঢাকার মাটিতে
কবিকে রুখতে পারে এরকম কাঁটাতার নেই।
পাতার পয়ার
সামান্য প্রশ্রয় ছিল—তাকিয়েছি দূরে
আলপথ মিশে গেছে দুরন্ত দুপুরে
ছায়ার পেছনে হেঁটে ই-কারে আ-কারে
অভিলাষ বেজে ওঠে পাতার পয়ারে
সকাতরে লিখে রাখি সহপাঠী ফুল
রোদ থেকে বৃষ্টি থেকে অযুত বকুল
কুড়িয়ে ধরেছি হাত—পোড়ায় আগুন
পদব্রজে ফেলে আসা স্মৃতির ফাগুন
দূরের জোয়ারে লেখা কবেকার মেয়ে
এখনো বাজিয়ে যায়—পথে, অসময়ে।
গারো পাহাড়ের মেঘমালা
পাহাড়চূড়ায় প্রতিফলনের আলো
শাল-গজারির আড়ালে আকাশ জাগে
গজনী গ্রামের লোকালত কোলাহলে
ভোর এসে গেছে সূর্য ওঠার আগে
এই কোলাহলে আচিক মুখের ভাষা আমাকে
পাঠায় প্রান্তজনের রোদ
আমি ক্ষত গায়ে আলোর কবিতা লিখে
জলে ধুয়ে ফেলি জাতিতত্ত্বের ক্রোধ
এখন আমার সকালের হাঁটাপথ
মৃত নদীতীরে জলের প্রবাহ দেখে
স্নান শেষে আমি বিমুখ করবো কাকে
যে আমার হয়ে সেতু-বন্ধন লেখে
সবাই বন্ধু—সাংমা, মারাক, মোমিন,
আকাশ সেজেছে মান্দি মেয়ের সাজে
গারো পাহাড়ের মেঘমালা দেখা গ্রামে
স্মৃতির ভেতরে পাহাড়ি কবিতা বাজে।
উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা
হয়তো ঝড়ের সঙ্গে পৌঁছে যাবো তোমার সকাশে
উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা শিখে নিচ্ছে আমাদের শ্রেণি
সহপাঠীদের মুখে যেটুকু ধুলোর স্পর্শ, ক্লেদ ও বিভ্রম
তার জন্য ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে রাখি দিগন্তের পথ—
উড়ে যাওয়া ধুলো, বলো আজ কাকে নেবো?
বলো হে অম্লান মাটি আমিও কি পথে পথে ঝরাপাতাদের শোক?
কী লিখি সুতীব্র মেঘে? ভোরের উন্মুখ গান?
লোকায়ত পাঠ্যক্ৰম, স্মৃতি ও আগামী?
আর যে দিয়েছ তুমি ধ্বংস ও সৃজন সন্ধ্যা
চৈত্র সংক্রান্তির শেষে মুগ্ধ কোন প্রণয়ের লিপি—
এই পাঠে জাতিস্মর, আমারও প্রস্তুতি আজ
ধাবমান বাতাসের মুখে তুলে দেয়া প্রভাত সঙ্গীত
আমারও প্রস্তুতি আজ একখণ্ড নদী রাষ্ট্রে
অক্ষরের অপূর্ব উত্থান।
নির্জন গ্রন্থাগার
শরীরে শরীর রেখে ফিরে আসি নির্জন গ্রন্থাগারে
প্রাচীন ধুলোয় হাত রেখে
পাঠ করি কাম ও অনুশোচনার স্মৃতি
প্রতিটি পাঠে আমাদের নদীতীরে
ভাঙা জাহাজের কথোপকথনের ঢেউ
ভেসে আসে
সে ঢেউয়ে মোমবাতি জ্বেলে দেখি
নদীগর্ভে বিলীন টেবিলে
আমারই হাতে লেখা পুরোনো পাণ্ডুলিপি
একা একা পাতা ওল্টায়
অথচ যে টুকু পাঠের আজ
সেখানেই সাদা পাতা; অচেনা শরীর।
...
কবি কামাল চৌধুরীর জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৫৭, কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার বিজয়করা গ্রামে। মধ্যসত্তরে তারুণ্যদীপ্ত ও দ্রোহী কবিতা নিয়ে সমকালীন কাব্যজগতে প্রবেশ। কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১১) সহ অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন সমাজবিজ্ঞানে, তারপর নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি। পেশাগত জীবনে ছিলেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা। দীর্ঘ ৩৪ বছর দায়িত্ব পালন শেষে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেছেন।