X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
ঈশ্বর মানুষের পক্ষে

তত্ত্ব ও গল্পের যুগলবন্দি

তপন শাহেদ
১৩ জুন ২০২২, ১৬:৩১আপডেট : ১৩ জুন ২০২২, ১৬:৩১

আধুনিক মননশীল শিল্পমাধ্যম হিসেবে যেকোনো উপন্যাসেই আখ্যানটি শেষ অবধি একটা তত্ত্ব বা দর্শনের প্রকাশমাধ্যম তথা sign মাত্র। আরিফ হাকিম তাঁর উপন্যাসিকা ঈশ্বর মানুষের পক্ষে লিখতে গিয়ে বিশ্বখ্যাত ইতালীয় চিহ্নবিজ্ঞানী ও কথাসাহিত্যিক উমবের্তো একো-র কাছে ঋণ স্বীকার করে একথা পাঠককে প্রকারান্তরে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তত্ত্ব অংশের গোড়াপত্তন হয়েছে বাইবেলে বর্ণিত ‘বাবেলের টাওয়ার’ আখ্যানের উল্লেখের মধ্যদিয়ে, যে আখ্যানে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মানুষের ভিন্নভিন্ন ভাষায় কথা বলার বাইবেলীয় ব্যাখ্যা রয়েছে।     

উপন্যাসিকাটির কাহিনির ঘটনাস্থল কেনিয়ার বিস্তীর্ণ মাসাইমারা অভয়ারণ্য। কাহিনির প্রারম্ভে মাসাইমারা ও তার সংলগ্ন অঞ্চলের ভূগোল, উদ্ভিদ, প্রাণিকুল ও তাদের চলাচল, খাদ্যশৃঙ্খল, মানব অধিবাসী এবং তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত জীবনযাত্রার একটি বাস্তবানুগ বিবরণ দেওয়া হয়েছে।

উপন্যাসিকাটির বিশেষ চরিত্র প্রকাশ পায় যখন এই বাস্তবতার পটভূমিতে একটি কল্পিত কাহিনির অবতারণা করা হয় যার কেন্দ্রে রয়েছে এক প্রবীণ সিংহ-সাধক। এই উদ্ভাবিত কাহিনি—যার চরিত্র অনেকটা দীর্ঘ এক উপকথার (fable) মতো—এই উপন্যাসিকার মূল কলাকৌশলগত উপাদান। অন্য কথায়, এই উদ্ভাবিত উপকথাই এ উপন্যাসিকার sign যাকে অবলম্বন করে লেখকের তত্ত্বগত বিষয়বস্তুটি (theme, signified) দাঁড়িয়ে আছে।

উপন্যাসিকার প্রধান চরিত্র মাসাইমারা তৃণভূমির মাঝখানে এক বিশাল আকাসিয়া গাছে একাকী বসবাসকারী এক সিংহ। সে স্বভাগতভাবে অহিংস এবং স্বজাতির কল্যাণচিন্তায় নিমগ্ন। ‘মানবজাতির সহজাত এক বিবেকবৃত্তি তাঁর মধ্যে আরোপিত হয় এবং জগতের সৃজনকারী স্রষ্টার ধ্যানে নিমগ্ন হন।’

দিব্যদৃষ্টিসম্পন্ন সিংহ-সাধকের ভাবনায় মানুষ নেহাতই পশুনিগ্রহকারী এক জীব যে স্রষ্টার কাছে ‘জ্ঞান’ নামক আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়ে তারই জোরে অন্য জীবদের পদানত করে রেখেছে। পৃথিবীতে করোনা মহামারি দেখা দিলে মানবকূল যখন বিপুল সংখ্যায় মরছে তখন সিংহমশাইয়ের মনে বাসনা জাগে তার এই দুর্বল অবস্থার সুযোগে ‘সমগ্র মানবজাতিকে নির্বংশ এবং তাদেরকে দুনিয়া থেকে বিতাড়িত করার।’ তিনি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেন তিনি যেন মানুষের কাছ থেকে তাঁর দেওয়া দান ‘জ্ঞান’ ফিরিয়ে নেন, এবং মানুষ যেন তার আদি আবাসস্থল স্বর্গে ফিরে যায়, যাতে পৃথিবীর পশুরা শান্তিতে জীবন কাটাতে পারে। কিভাবে তা করা যায় তা নিয়ে আলোচনার জন্য মাসাইমারার সব পশুর সাথে আলোচনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাধা হলো একেক পশুর একেক ভাষা। ধ্যানী সিংহ তখন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন সেই ক্ষমতার জন্য যা বাবেলের টাওয়ার নির্মাণের সময় মানুষের সবচেয়ে বড় সহায় ছিল—একটি অভিন্ন ভাষা। স্রষ্টা তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। আকাসিয়া গাছের নিচে সভায় মানুষের জ্ঞান লাভ, পৃথিবীতে আগমন, আগুন আবিষ্কার, নগর নির্মাণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আবিষ্কার ও অপব্যবহার, মানুষের হাতে পশুদের শোষণ-অপমান-অত্যাচার-নিধন-বন্দিত্বের ইতিহাস, মানুষের সহিংস ও যুদ্ধংদেহি স্বভাব, পৃথিবীতে জীবের বিবর্তনের মানব-কথিত ‘ভুল’ বয়ান, মানুষের লোভী মন—সবকিছু একে একে বানর, শেয়াল, বন্য কুকুর, ওয়ালবিস্ট, মহিষ, ছাগল, হায়েনা, শূকর, বেবুন, বাবুই, সিংহ, শিম্পাঞ্জি, কাক, হাতি, অজগরের বক্তব্যের মধ্যদিয়ে উন্মোচিত হতে থাকে। বিরূপ অবস্থায় টিকে থাকার নামে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক টেলিভিশন চ্যানেলের বেয়ার গ্রিলস-এর সর্বভুক ‘নৃশংসতা’র প্রসঙ্গও সভায় উঠে আসে। সবশেষে পশুরা সমবেতভাবে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতে থাকে তাদের বাসনা পূরণের জন্য। ঈশ্বর তাদের দেখা দেন জ্যোতিরূপে, কিন্তু তা কেবল নির্বোধ পশুদের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য, তাদের ভর্ৎসনা করতে, মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব আর নিজের সৃষ্টি নিয়ে তাঁর নির্ভুলতার কথা জানিয়ে দিতে। তারপর স্রষ্টা পশুদের পরস্পরের ভাষা বোঝার ক্ষমতা কেড়ে নেন, তাদের ওপর প্রকৃতি সংহারক-রূপে নেমে আসে। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে দিগ্বিদিক ছুটে পালায়, সিংহ-সাধক প্রাণ হারায়। মাসাইমারার জীবনস্রোত তার চিরকালীন রূপে বয়ে চলে।

আধুনিক মানুষ যে-বিজ্ঞানের শক্তিতে পৃথিবীর বুকে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, তার একটি নির্দিষ্ট কর্মপ্রক্রিয়া রয়েছে। তত্ত্বনির্মাণ তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানবসভ্যতার অগ্রগতির বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় মহাজগতের জানা জীবনের একমাত্র আবাস এই পৃথিবী নামক গ্রহ ধ্বংস হতে বসেছে। এই পটভূমিতে পৃথিবীর ইতিহাসের অতি-আধুনিককালে উদ্ভব ঘটেছে পরিবেশ সংরক্ষণবাদ তত্ত্বের। মানুষেরই নির্মিত এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী উন্নত জীব হিসেবে মানুষের ধ্বংসাত্মক স্বভাব ও কর্মকাণ্ড আর তার বিপরীতে পশুদের অসহায়তা ও বিলোপের কথা বলা হয়। এরই চরম বয়ানে মানুষ অন্যান্য পশুর চেয়ে নিকৃষ্ট, এই পৃথিবীতে বসবাসের অযোগ্য—পৃথিবী ধ্বংসের জন্য একমাত্র দায়ী।

মানুষেরই আবিষ্কৃত বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা ও বয়ানে উপরিউক্ত বাস্তবতা সত্য, কিন্তু বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করাও অসম্ভব। তার জ্ঞান-ক্ষমতাই তার শক্তি, আর শক্তিমানই টিকে থাকে, সৃষ্টিকর্তা যেন তার পক্ষেই অবস্থান নেন। মানুষেরই তত্ত্ব তাই তারই শাসিত গ্রহটির বাস্তবতায় ভুল প্রমাণিত হয়।

এই বিষয়বস্তু ঈশ্বর মানুষের পক্ষে উপন্যাসিকার উপজীব্য।

‘জীবনের ঘটনাপ্রবাহকে যদি কোনও তত্ত্বের মধ্যে আটকানো না যায়, তাহলে তা আখ্যানে রূপ দিয়ে দাও’—উমবের্তো একো-র এই উপদেশই এই উপন্যাসে বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেছেন আরিফ হাকিম। এই অনুসরণ কিন্তু সহজ নয়, এর জন্য প্রয়োজন বিশ্বাসযোগ্যভাবে গল্প বলার দক্ষতা, বিশেষ করে গল্পটি যখন কল্পিত, উদ্ভাবিত—অর্থাৎ বাস্তববাদী (realistic) তথা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশ্বাসযোগ্য নয়। উপন্যাস কত রকম হতে পারে এই বিবেচনায় ঈশ্বর মানুষের পক্ষে উপন্যাসিকাটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। কারণ আধুনিক উপন্যাসে কাহিনির পরিসরে চিন্তার প্রাধান্য ক্রমাগত বাড়ছে, আর গল্পের মধ্যে জটিল ও নীরস চিন্তা, তত্ত্ব, ব্যাখ্যা ইত্যাদির জায়গা করে দিয়েও তাকে আকর্ষণীয়ভাবে পাঠযোগ্য করে তোলার কাজ অত্যন্ত দুরূহ।

এই পরীক্ষায় লেখক অনেকখানি উত্তীর্ণ হয়েছেন। একো-র কথিত Intertextuality-র কিছু নমুনা উপন্যাসিকাটিতে আছে। জর্জ অরওয়েলের Animal Farm-এর সাথে এর সাদৃশ্যও চোখে পড়ে। ঈশপের উপকথার ছায়াও দুর্লভ নয়। সব মিলিয়ে আধুনিক পাঠকের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি গ্রন্থ।  

উপন্যাসিকায় কাহিনিটি বেশি দীর্ঘায়িত হলে বিশ্বাসযোগ্যতার সংকট তৈরি হতো, একথা লেখকও নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তবে গল্প হিসেবে আকর্ষণীয় হবার জন্য আরও বিস্তারণের প্রয়োজন ছিল।

গ্রন্হটির প্রকাশনায় সম্পাদনার অভাব চোখে পড়েছে।

 

ঈশ্বর মানুষের পক্ষে : আরিফ হাকিম, প্রকাশক : অন্যপ্রকাশ, প্রকাশকাল : ফেব্রুয়ারি ২০২২, পৃষ্ঠাসংখ্যা : ৯৪, মূল্য : ৩০০ টাকা।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা