X
শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫
২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
সাহিত্যতত্ত্ব : একটি সংক্ষিপ্ত পরিক্রমা

পোস্টস্ট্রাকচারালিজম বা বিনির্মাণবাদ 

মুহম্মদ মুহসিন
০৫ নভেম্বর ২০২১, ০০:৫৮আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০২১, ০১:০০

স্ট্রাকচারালিজম বা কাঠামোবাদের তাত্ত্বিক ধারায় অগ্রসর হতে হতেই জন্ম নিয়েছে পোস্টস্ট্রাকচারালিজম বা বিনির্মাণবাদ। তবে দুঃখজনকভাবে স্ট্রাকচারালিজম যা বলে পোস্টস্ট্রাকচারালিজম বা বিনির্মাণবাদ বলে প্রায় পুরোটাই তার উল্টো কথা। স্ট্রাকচারালিজমের পথ ধরে এগোতে এগোতে এই উল্টোকথার পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজমের খোঁজ যিনি আমাদের প্রথম দিয়েছিলেন তিনি হলেন রোলাঁ বার্থ (Roland Barthes)। ১৯৬৩ সালে স্ট্রাকচারালিজমের তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে তিনি লেখেন ‘সুর রাসিন’ (Sur Racine= রাসিন বিষয়ে)। বইটি সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত ফরাসী নাট্যকার জাঁ রাসিন বিষয়ক একটি আলোচনা। স্ট্রাকচারালিজমের তত্ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে তিনি এই আলোচনা করেছেন। তাই এ পর্যন্ত তাঁকে আমরা কাঠামোবাদী সমালোচক হিসেবেই দেখি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি প্রবন্ধ যার শিরোনাম ‘ডেথ অব দি অথর’। এই প্রবন্ধে আমরা দেখি যে, রোলাঁ বার্থ স্ট্রাকচারালিজমের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে যেখানে পৌঁছেছেন সেখানে স্ট্রাকচারালিজম পৌঁছায় না। মূলত স্ট্রাকচারালিজমের গন্তব্যই ওটা হওয়ার কথা না।

স্ট্রাকচারালিজম আখ্যানের অন্তস্থ স্ট্রাকচার বা কাঠামো খোঁজে। সে কাঠামো পাঠককে পৌঁছে দেয় আখ্যানের অন্তস্থ অর্থের নিকট যে-অর্থ আখ্যানকে সম্পর্কিত করে তোলে জীবন ও জগতের অন্যান্য তাৎপর্যময় কাঠামোর সাথে। এই কাঠামোর অন্বেষণ প্রথম শুরু হয় সিগনিফায়ারগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক-কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রয়াসের মধ্য দিয়ে। সিগনিফায়ার পরে বৃহত্তর কাঠামো পারোলের সাথে সম্পর্কিত হয়। পারোল পরে আবার যুক্ত হয় বৃহত্তর কাঠামো লাঙের সাথে। এভাবে প্রতি স্তরে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর সম্পর্কের মধ্য দিয়ে পৌঁছতে হয় আখ্যানের অভীষ্ট অর্থে। সুতরাং কাঠামোবাদী তত্ত্বে আবশ্যিকভাবে ধারণা করা হয় যে, আখ্যানে বা টেক্সটে অর্থের নির্দিষ্টতা আছে যে নির্দিষ্ট অর্থটি লেখক ও পাঠক উভয়েরই লক্ষ্য। কিন্তু রোলাঁ বার্থ সাইন, সিগনিফায়ার আর সিগনিফায়েড সংক্রান্ত ধারণাসমূহ সাথে নিয়ে এগোতে এগোতে ‘ডেথ অব দি অথর’ লেখার পর্যায়ে গিয়ে দেখলেন সিগনিফায়ারের সাথে অন্য হাজারো সিগনিফায়ারের বৈপরীত্যের সম্পর্ক এত অসংখ্য যে সে সম্পর্কের মধ্য দিয়ে কোনো সিগনিফায়ারের নির্দিষ্ট অর্থে পৌঁছা অসম্ভব। আর লেখকের পক্ষে কোনো সিগনিফায়ার অর্থাৎ কোনো শব্দ দ্বারা তাঁর উদ্দিষ্ট কোনো অর্থ বোঝানোর তো সুযোগই নেই। কেননা, সস্যুর তো দেখিয়েই দিয়েছেন যে, কোনো সিগনিফায়ার নিজের মধ্যে তো অর্থ ধারণ করে না, অর্থ তো থাকে সেই সিগনিফায়ারের সাথে অন্য সিগনিফায়ারসমূহের সম্পর্কের মাঝে। সে সম্পর্ক লেখকের সর্বরকম কর্তৃত্বের বহির্ভূত এক বিষয়। সে সম্পর্ক সিগনিফায়ারদের নিজেদের আচরণের অধীন, সেখানে লেখকের ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দাম নেই। লেখক না পারেন সিগনিফায়ার সৃষ্টি করতে, না পারেন সিগনিফায়ারদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে কোনো দূতিয়ালি করতে। ফলে লেখা পড়তে গিয়ে লেখকের উদ্দিষ্ট অর্থ খোঁজা তো দূরে থাক, লেখক প্রসঙ্গটাই অর্থাৎ লেখকের অস্তিত্বটাই একটি অলীক কল্পনা হয়ে দাঁড়ায়। বার্থ অবশ্য এটাকে অলীক কল্পনা না বলে বলেছেন বুর্জোয়া কল্পনা (bourgeois fiction)। উল্লেখ্য যে, বার্থ ‘অথর’ বলতে যাকে বুঝিয়েছেন তাকে আমরা এখানে লেখক বলছি। তাঁর মতে অথর হলেন তিনি যাঁকে টেক্সটের ‘অথরিটি’ জ্ঞান করা হয়। এই অথরকে বার্থ রাইটার থেকে আলাদা করেছেন। বার্থ তাঁর ‘ডেথ অব দি অথর’-এর বক্তব্যে অথরের অস্তিত্ব অস্বীকার করলেও রাইটারের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। বার্থের ধারণায় রাইটার হলেন নেহায়েত একজন নকলনবিশ বা অনুলিপিকার। মুহুরি বললেও খারাপ হয় না।

রোলাঁ বার্থের এই ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে সাহিত্যতত্ত্বে দুটো বিপর্যয়কর ধারণা এসে প্রবেশ করেছে। প্রথমত, লেখক লেখার মধ্যে কোনো নিজস্ব অর্থ সৃষ্টি করতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, সিগনিফায়ারদের পারস্পরিক সম্পর্কের সংখ্যা এত অসংখ্য যে সিগনিফয়ারগুলো কোনো সিগনিফায়েডে মূলত পৌঁছতেই পারে না। অর্থাৎ শব্দ কোনো নির্দিষ্ট অর্থই দিতে পারে না। এই দুটো ধারণা দ্বারাই মূলত সাহিত্যে পোস্টস্ট্রাকচারালিজম বা বিনির্মাণবাদ তত্ত্ব সূচিত হয়েছে। বার্থ কর্তৃক সূচিত বিনির্মাণবাদের এই ভাবনাবীজ জ্যাক দেরিদার (Jacques Derrida) হাতে এসে পুরো এক সমালোচনাতত্ত্বের রূপ লাভ করেছে।

বার্থের ‘অথর’ বা লেখক সম্পর্কিত ভাবনার সূত্র ধরে দেরিদা কীভাবে এগোলেন আমরা প্রথমে সেটিই দেখি। বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য দেরিদা ফিরে গেলেন সস্যুরের নিকট। আমরা সাধারণ পাঠক সাধারণভাবে ভেবে থাকি যে, লেখা যেহেতু লেখকের সেহেতু সে লেখার সকল অর্থের মালিক ও নির্মাতা তো লেখকই হবেন। অর্থাৎ আমরা সকলেই ধরে নিই যে, লেখক নামের একজন স্বাধীন মানুষ লেখার বাইরে বসে লেখাটির সকল অর্থ নির্মাণ ও নিরূপণ করে থাকেন। দেরিদা বার্থের মতো এই লেখকের অস্তিত্ব অস্বীকার না করে লেখক কর্তৃক নির্মেয় অর্থের এক বিশেষ নামকরণ করেছেন। সস্যুরের সিগনিফায়ার ও সিগনিফায়েড ধারণার সাথে সম্পৃক্ত করে তিনি এই অর্থের নাম দিয়েছেন ট্রান্সেন্ডেন্টাল সিগনিফায়েড (transcendental signified), অর্থাৎ আসমানি অর্থ। আসমানি অর্থ বলেই জমিনের মানুষের সাথে এই প্রকার অর্থের কখনো দেখা হওয়ার সুযোগ নেই।

এভাবে লেখককে কোনো লেখার অর্থের নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আসমানে পাঠিয়ে দিয়েই দেরিদা ক্ষান্ত হলেন না। নিজ অর্থ সাথে নিয়ে লেখক আসমান থেকে যেন কখনো নামতে না পারেন সে ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে তিনি সস্যুরের সিগনিফায়ার ও সিগনিফায়েডের তত্ত্ব নিয়ে আরো ব্যাখ্যায় অগ্রসর হলেন। এই ব্যাখ্যায় তিনি ব্যবহার করলেন তাঁর নির্মিত এক নতুন শব্দ ‘ডিফেরঁস’ (differance)। শব্দটি তিনি বানিয়েছেন দুটি ফরাসী শব্দ জোড়া দিয়ে। ইংরেজিতে তাদের একটির অর্থ to differ এবং অন্যটির অর্থ to defer। বাংলায় একটির অর্থ ভিন্ন হওয়া এবং অপরটির অর্থ দেরি হওয়া। দেরিদা দেখালেন যে, সিগনিফায়ার ও সিগনিফায়েডের ধারণার মধ্য দিয়ে সস্যুরিয় পদ্ধতিতে টেক্সটের অর্থ খুঁজতে গেলে to differ এবং to defer- এই দুটি ধারণার চক্রেই নিপতিত হতে হয়। প্রথমত to differ- এর ধারণা তো সস্যুরই দিয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেছেন সিগনিফায়ারদের অর্থাৎ শব্দদের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই, তাদের অর্থ তৈরি হয় অন্য সিগনিফায়ারদের সাথে সংশ্লিষ্ট সিগনিফায়ারটির ভিন্নতার মধ্য দিয়ে। এভাবে to differ বা ভিন্ন হওয়ার বিষয়টি অর্থ তৈরির ক্ষেত্রে আবশ্যিক হয়ে দাঁড়ায়। অর্থ তৈরিতে দ্বিতীয় ধারণাটি অর্থাৎ to defer বা দেরি হওয়ার ধারণাটি প্রথম ধারণাটির ফলাফল বা ফসল। ধরা যাক ‘ক’ একটি সিগনিফায়ার। সস্যুরের to differ-এর ধারণা অনুযায়ী টেক্সটে সিগনিফায়ার ‘ক’-এর অর্থ বা সিগনিফায়েড তো ‘ক’-এর নিজের মধ্যে থাকবে না, বরং সে অর্থ থাকবে সিগনিফায়ার ‘খ’-এর সিগনিফায়েড থেকে তার ভিন্নতার (to differ) মধ্যে। ফলে ‘ক’-এর সিগনিফায়েডের খোঁজে নামলে অপেক্ষা করতে হবে ‘খ’-এর সিগনিফায়েড পাওয়ার জন্য। কিন্তু সেই একই সস্যুরিয় ধারণা অনুযায়ী ‘খ’-এর সিগনিফায়েডও তো তার নিজের মধ্যে থাকবে না, তার সিগনিফায়েড থাকবে ‘সিগানফায়ার ‘গ’-এর সিগনিফায়েড থেকে তার ভিন্নতার মধ্যে। তখন গ-এর সিগনিফায়েড বা অর্থ খুঁজতে অপেক্ষা করতে হবে ‘ঘ’-এর সিগিনিফায়েডের জন্য। এভাবেই এক সিগিনফায়ার থেকে আরেক সিগনিফায়ারের দিকে দৌড়াতে হবে সিগনিফায়ার ‘ক’-এর অর্থ খুঁজে পাওয়ার জন্য এবং সে দৌড় কখন শেষ হবে কোনো পাঠকের তা জানা নেই। ফলে সস্যুরিয় to differ নীতিতে অর্থ তৈরিতে বা অর্থ খুঁজে পেতে খালি দেরি হবে তাই নয়, আদৌ কখনো অর্থ খুঁজে পাওয়ার গ্যারান্টিই থাকবে না। ফলে সস্যুরিয় সাইন-সিগনিফায়ার-সিগনিফায়েড সংক্রান্ত ধারণা অনুযায়ী টেক্সটের অর্থ খুঁজতে গেলে অর্থ পাওয়ার ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে to differ এবং to defer-এর চক্রে নিপতিত হতে হবে। to differ এবং to defer-এর এই দুই ধারণাকে একত্র করে দেরিদা এই চক্রের নাম দিয়েছেন ‘ডিফেরঁস’ (differance)।   

‘ডিফেরঁস’-এর মধ্য দিয়ে অর্থ খোঁজার এই অন্তহীন যাত্রাই বিনির্মাণবাদের সার কথা। এই যাত্রায় দেরিদার সাথী হতে হলে আরো কয়েকটি ধারণার সাথে পরিচিত হতে হবে। তার একটির নাম ট্রেস (trace)। উপরে যেমনটা বলা হলো যে এক সিগনিফায়ারের অর্থ খুঁজতে যখন আরেক সিগনিফায়ারের কাছে যাবো তখন দেখবো সেই সিগনিফায়ারের অর্থ রয়ে গেছে আরেক সিগনিফায়ারের কাছে। এমন হাজার সিগনিফায়ারের মধ্যস্থিত আমাদের না-দেখা ও না-পাওয়া যে-সকল উপাদান বা সত্ত্বার ওপর আমাদের প্রথম সিগনিফায়ারের অর্থ নির্ভরশীল সেই সত্ত্বা বা উপাদানকে দেরিদা নাম দিয়েছেন ট্রেস। টেক্সটে এই ট্রেসদের উপস্থিতি ভূতের মতো; এদের কথা বলা হয়, এদের কথা ভাবা হয় কিন্তু এদেরকে কখনো চোখে দেখা যায় না। এই ধারণার মধ্য দিয়ে দেরিদা বলেছেন যে, টেক্সটের অর্থ খোঁজার দৌড়ে তোমার সাথে শুধু দেখা হবে সিগনিফায়ারদের পারস্পরিক ভিন্নতার সাথে এবং ট্রেসের সাথে, আর কিছুর সাথে নয়।

এভাবে অর্থ খোঁজা একেবারেই ভূতের পিছনে দৌড়ানো, একটু ভদ্রভাবে বলা যায় আলেয়ার পিছনে দৌড়ানো। আলেয়া যেমন কতক্ষণ এখানে দেখা যায় তো পরক্ষণেই দেখা যায় সেখান থেকে অনেক দূরে অন্য কোনোখানে। এ দৌড়েও তেমনি অর্থ এখন দেখা যায় ঐ সিগনিফায়ারের মধ্যে, আবার পরক্ষণেই দেখা যায় দূরের আরেক সিগনিফায়ারে। কিন্তু আসলে অর্থ নেই এদের কোথাও, আছে শুধু ট্রেস আর ডিফেরঁস। তাই অর্থের এই দৌড় মূলত এক গোলক ধাঁধা দেরিদা যার নাম দিয়েছেন অ্যাপোরিয়া (Aporia)। কাঠামোবাদীরা এই গোলক ধাঁধা থেকে সহজ মুক্তির জন্য সিগনিফায়ারকে বিপরীতার্থক দ্বিপদে (oppositional binary) সাজায় যাতে দৌড়টা ঐ দুই পদের সম্পর্কের মধ্যে আটকানো যায়। আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি ক্লদ লেভি-স্ট্রসও মিথিমগুলোকে বিপরীতার্থক দ্বিপদী বিন্যাসে সাজিয়ে তাঁর কাঠামোবাদী আলোচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন।

দেরিদা এই দৌড়কে অ্যাপোরিয়া থেকে মুক্ত করতে এক ভিন্ন পথে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর সেই পথটি দেখার জন্য আমরা কাঠামোবাদীদের বিপরীতার্থক একটি দ্বিপদ নিয়ে অগ্রসর হবো। ধরা যাক আলো ও অন্ধকার। কাঠামোবাদীরা এই দুয়ের বৈপরীত্যের সম্পর্ক প্রদর্শন করতে প্রথমে আলো দিয়ে শুরু করে, কারণ সেখানে একটা কিছুর উপস্থিতি আছে যা দ্বিতীয়টিতে অনুপস্থিত বলে সেটি অন্ধকার। মানে হলো আলো দ্বারা একটি উপস্থিতি বোঝায় আর অন্ধকার দ্বারা সেটির অনুপস্থিতি বোঝায়। এই উপস্থিতিটিকে কাঠামোবাদীরা অনপনেয় (immutable) এবং স্বাধীন-সত্ত্বায় আত্মস্থিত (self-contained) হিসেবে দেখেন। এই উপস্থিতিকে কাঠামোবাদীরা তাদের বিপরীতার্থক দ্বিপদের অর্থের কেন্দ্র হিসেবে দেখেন। দেরিদা তেমনটা দেখেন না। তিনি এটাকে কেন্দ্র ভাবা দূরের কথা, এটাকে তিনি বাস্তবই ভাবেন না। তিনি এটাকে ভাবেন অধিবাস্তব। তাই এর নামও দিয়েছেন metapysics of presence। দেরিদা মূলত কাঠামোবাদীদের সৃষ্ট অর্থের এই কেন্দ্রগুলোকে ভাঙার ব্রত নিয়েই বিনির্মাণবাদের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। বিনির্মাণ (deconstruction) শব্দের মানেও হলো নির্মাণে যা করা তার উল্টোটা করা অর্থাৎ নির্মিত বস্তুকে ভেঙে ভেঙে তার মূলে ফিরিয়ে নেয়া যাতে কেন্দ্রের অস্তিত্ব বলতে আর কিছু না থাকে। দেরিদা এই কেন্দ্র কীভাবে ভাঙছেন তা বুঝতে আলো ও অন্ধকারের দ্বিপদেই আবার ফিরে আসি। আলো ও অন্ধকারের অর্থের কেন্দ্র গুড়িয়ে দেয়া বা বিনির্মাণের কাজে দেরিদার পথে আগালে আমাদেরকে প্রথমেই আঘাত করতে হবে যার উপস্থিতিতে আলো হয় এবং যার অনুপস্থিতিতে অন্ধকার হয় সেই অধিবাস্তব উপস্থিতির ওপর। এই অধিবাস্তব উপস্থিতিকে বা উপস্থিতির ভূতকে ঝেড়ে ফেলতে পারলে ‘আলো-অন্ধকার’ দ্বিপদের অর্থের কেন্দ্রে আলো আর থাকছে না। এবার আমরা কৃষ্ণ গহ্বরের ধারণার সাথে সম্পর্কিত করে বলতে পারি অন্ধকার হলো সেই গ্রাসী ক্ষমতা যা আলোকে গিলে ফেলতে পারে যেমনটা কৃষ্ণগহ্বরে ঘটে। এভাবে এই দ্বিপদের পূর্বতন অর্থকেন্দ্র বিনির্মিত হলো বা গুড়িয়ে গেল এবং দ্বিপদী সম্পর্কে অন্ধকারের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা পেল অর্থাৎ অর্থের কাঠামোতে অন্ধকার সক্রিয় (active) হয়ে উঠলো এবং আলো নিষ্ক্রিয় (passive) হয়ে গেল। এভাবে পুরনো বা সনাতন অর্থকাঠামোকে গুড়িয়ে দিয়ে নতুন নতুন অর্থকাঠামোর সন্ধান দেয়াই বিনির্মাণবাদের কাজ। যদিও এ কাজের সীমান্তে অ্যাপোরয়িার শঙ্কা রয়েছে অর্থাৎ এর মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত কোনো অর্থে পৌঁছতে না পারার নিশ্চিত ভবিতব্য রয়েছে, তারপরও এর মধ্যে পুরনো অর্থ ভাঙার আনন্দ এবং নতুন নতুন অর্থের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ রয়েছে বিধায়ই দুনিয়া জুড়ে এ তত্ত্বের এত জয়জয়কার।

বিনির্মাণবাদী তত্ত্বে আরেকজন চিন্তকের বড় অবদান আছে। তিনি হলেন মিশেল ফুকো (Michel Foucault)। ফুকোর দুটি বিশেষ ভাবনা বিনির্মাণবাদী তত্ত্বে খুব উচ্চারিত দুটি প্রসঙ্গ। একটি হলো লেখক বা অথর সম্পর্কিত ফুকোর ভাবনা এবং অপরটি হলো অর্থের সাথে ক্ষমতার সম্পর্ক বিষয়ক ভাবনা যা ফুকো ব্যক্ত করেছেন তাঁর ডিসকোর্স সংক্রান্ত ভাবনা-বলয়ে। লেখক বা অথর সম্পর্কে বার্থ ও দেরিদার ভাবনার সাথে আমরা ইতোমধ্যেই পরিচিত হয়েছি। বার্থ লেখকের অস্তিত্ব অস্বীকার করে তাকে এক ধরনের কল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। আর দেরিদা বলেছেন লেখকের অস্তিত্ব থাকলেও এবং লেখায় তার অর্থ সৃষ্টির ক্ষমতা থাকলেও সে এক আসমানি বিষয় (transcendental signified), কারণ পাঠকের সাথে সেই অর্থের কখনো দেখা হওয়ার সুযোগ নেই। বার্থ ও দেরিদার এই জাতীয় ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে ফুকো লেখক সম্পর্কে একটি নতুন ধারণা হাজির করেছেন। 

ফুকোর ‘What is an Author’ শীর্ষক প্রবন্ধ অনুযায়ী লেখককে আমরা দুইভাবে বা দুই রূপে বুঝি। এক হলো ব্যক্তি লেখক যাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া যায়, আরেক হলো লেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশিত বৈশিষ্ট্যগত সমধর্মিতার সমন্বয়রূপ এক অস্তিত্ব যাকে আমরা আঙুল দিয়ে দেখাতে পারি না, তবে লেখাগুলোর বৈশিষ্ট্যগত সমধর্মিতার মাঝে যার অস্তিত্ব আমরা অনুভব করি। লেখকের এই দ্বিতীয় রূপকে তিনি বলেছেন ‘অথর ফাংশন’ (author function)। প্রথম রূপে লেখকের পরিচয় হলো তাঁর নাম (designation), দ্বিতীয় রূপে লেখকের পরিচয় হলো তাঁর চিন্তা, তাঁর সময়, তাঁর সমাজকাঠামো ইত্যাদি অনেক বিষয়ের একটি দীর্ঘ বিবরণ (description)। ফুকোর মতে প্রথম রূপের লেখককে তাঁর লেখার অর্থের জন্য প্রয়োজন না হলেও দ্বিতীয় রূপের লেখককে অর্থাৎ author function বা descriptive author-কে লেখার অর্থের জন্য প্রয়োজন। ফুকোর মতে এই অথর ফাংশনকে অস্বীকার করলে বিনির্মাণবাদী অর্থ সন্ধানের অভিযাত্রায় আমরা পৌঁছে যেতে পারি বড় বিপর্যয়কারী ডিসকোর্সে (transgressive discourse) কিংবা বিপজ্জনক কোনো অর্থে (proliferation of dangerous meaning) যা চূর্ণ করে দিতে পারে আমাদের এযাবৎ কালের অর্জিত সামাজিক ও রাজনৈতিক শৃঙ্খলা। মনসুর আল হাল্লাজের ‘আনাল হক’ বাক্যের অমন বিপজ্জনক অর্থ করা হয়েছিল বিধায়ই তাঁকে শরিয়তপন্থীদের হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। অথর সম্পর্কিত এই ভাবনা দ্বারা ফুকো বিনির্মাণবাদের দেরিদিয় অর্থ সন্ধানের গন্তব্যহীন ছুটন্ত ঘোড়াটির একটু হলেও লাগাম কষে ধরতে পারলেন। সেই সাথে ফুকোর ডিসকোর্স সম্পর্কিত বক্তব্য দ্বারা তিনি বিনির্মাণবাদের অর্থবলয়কে আরো কিছুটা গণ্ডিবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন।

ফুকোর বক্তব্যমতে সব টেক্সটই ডিসকোর্স, সব ডিসকোর্সই জ্ঞানের বাহন, আর সব জ্ঞানই ক্ষমতা চর্চার কৌশল। ফলে সব টেক্সটই ধারণ করে ক্ষমতাধরদের ক্ষমতা চর্চার চিত্র কিংবা বলা যায় টেক্সটগুলো বা ডিসকোর্সগুলো হলো সেই ভূমি (terrain) যেখানে এই ক্ষমতা চর্চার কার্যগুলো সম্পন্ন হচ্ছে। তাই টেক্সটের অর্থ খুঁজতে উক্ত টেক্সটের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষমতা-কাঠামোর কথা বিবেচনায় নিতেই হবে। অর্থটি উক্ত ক্ষমতা-কাঠামো দ্বারা সমর্থিত না হলে তা গ্রহণ করা যাবে না এবং তা ট্যাবু বা মস্তিষ্কবিকৃতির ফল বলে গণ্য হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। The Order of Discourse প্রবন্ধে ফুকো বলেছেন যে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতকাঠামো দ্বারা সমর্থিত না হলে কোনো নির্দিষ্ট ডিসকোর্স বা ডিসকোর্সের অর্থ ট্যাবু হবে বা মস্তিষ্ক বিকৃতির প্রমাণ হয়ে দাঁড়াবে। আবার ক্ষমতা-কাঠামোর নির্মিত প্রতিষ্ঠানগুলো দ্বারা সমর্থিত না হলেও কোনো ডিসকোর্স বা তার অর্থ গ্রহণযোগ্য হবে না। এভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা-কাঠামো এবং অথর ফাংশন দ্বারা ফুকো বিনির্মাণবাদী অর্থ-সন্ধান অভিযাত্রাকে একটি লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করেছেন। ফলে বলা যায় বিনির্মাণবাদ ফুকোর হাতে তত্ত্ব হিসেবে অধিকতর গ্রহণীয় রূপ লাভ করেছে। সাথে লেখার সাথে সামাজিক রাজনৈতিক ক্ষমতাকাঠামোকে সম্পৃক্ত করে তিনি সমালোচনাতত্ত্বের সেই ধারাকেও শক্তিশালী করেছেন যে তত্ত্বগুলো লেখার প্রসঙ্গকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। আর আমরা ইতোমধ্যেই বলেছি যে, লেখা, লেখক আর পাঠক বাদ দিয়ে লেখার প্রসঙ্গকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে যে সকল সমালোচনাতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে তাদের মধ্যে মার্কসীয় সমালোচনা তত্ত্ব অন্যতম। চলবে

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বদলি হজ কী, নারী কি পুরুষের বদলি হজ আদায় করতে পারবে?
বদলি হজ কী, নারী কি পুরুষের বদলি হজ আদায় করতে পারবে?
সাদকে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা
সাদকে ছয় মাসের নিষেধাজ্ঞা
তৃতীয় দিনের মতো যমুনার সামনে জবির আন্দোলনকারীরা
তৃতীয় দিনের মতো যমুনার সামনে জবির আন্দোলনকারীরা
নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা
বাজেট: অর্থবছর ২০২৫-২৬নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা
সর্বাধিক পঠিত
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সতর্ক করে জরুরি নির্দেশনা মাউশির
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের সতর্ক করে জরুরি নির্দেশনা মাউশির
কমলো স্বর্ণের দাম, কার্যকর শুক্রবার থেকে
কমলো স্বর্ণের দাম, কার্যকর শুক্রবার থেকে
ফ্যাক্টরি পোড়ানোর হুমকি দেওয়া সেই বিএনপি নেতাকে বিমানবন্দর থেকে আটক
ফ্যাক্টরি পোড়ানোর হুমকি দেওয়া সেই বিএনপি নেতাকে বিমানবন্দর থেকে আটক
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল অধ্যাদেশ অনুমোদন
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল অধ্যাদেশ অনুমোদন
বাংলাদেশসহ ৫ রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র পেশের অনুষ্ঠান স্থগিত করলো ভারত
বাংলাদেশসহ ৫ রাষ্ট্রদূতের পরিচয়পত্র পেশের অনুষ্ঠান স্থগিত করলো ভারত