X
মঙ্গলবার, ০১ জুলাই ২০২৫
১৭ আষাঢ় ১৪৩২

আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ ।। পর্ব-১

মুহম্মদ মুহসিন
১০ মার্চ ২০২৩, ১১:৩৬আপডেট : ১০ মার্চ ২০২৩, ১১:৪৮

নারীবাদ, মার্কসবাদ কিংবা মনঃসমীক্ষণবাদ ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সময়বিন্দুতে যাত্রা শুরু করে এখনো ক্রিয়মান রয়েছে। ফলে সাহিত্যতত্ত্বের ইতিহাসে এদের জন্ম হওয়া, বড় হওয়া এবং বৃদ্ধ হওয়ার গল্প আছে। সাহিত্যতত্ত্বে এই জন্ম-বার্ধক্যের গল্প শেষপর্যন্ত এমন একটি ধারণাকেও গলাধঃকরণের চেষ্টা করেছে আবশ্যিকভাবে থাকার কথা চির-যুবা, যার কখনো বৃদ্ধ হওয়ার এবং হারিয়ে যাওয়ার কথা ছিল না। সেই ধারণাটির নাম ‘আধুনিকতা’।

আধুনিকতা সকল ভাষায়ই একটি চির-যুবা শব্দ। এ কখনো পুরনো হবে না, বৃদ্ধ হবে না, ভাষিক অর্থ অনুযায়ী এমনটাই ‘আধুনিকতা’ শব্দের দাবি। হোমারের চেয়ে ইস্কিলাসের যুগ আধুনিক ছিল। ইস্কিলাসের চেয়ে সফোক্লেসের যুগ আধুনিক ছিল। শেক্সপিয়ারের চেয়ে মিল্টনের যুগ আধুনিক ছিল। অর্থাৎ ইস্কিলাস, সফোক্লেস, এ্যারিস্টোফেনিস, চসার, শেক্সপিয়ার, মিল্টন, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ সময়ে আধুনিক কবি বা লেখক ছিলেন। এ দাবি অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। ফলে সাহিত্যের ইতিহাসে আধুনিকতা কখনো ফুরিয়ে বা হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। সে অর্থে আধুনিকতা সব সময় বর্তমানের নায়ক হিসেবে সাহিত্যের সব যুগে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। আধুনিকতার এই চিরকালীন তারুণ্য সমালোচনা জগতের তাত্ত্বিকরা সহ্য কতে পারলেন না। ফলে সমালোচকীয় তাত্ত্বিকদের হাতে পড়ে আধুনিকতাকেও শেষ পর্যন্ত ইতিহাসের চরায় আটকে যেতে হয়েছে। বর্তমান থেকে বিযুক্ত হয়ে তাকে একটি নির্দিষ্ট শতাব্দীর এক কোণে ঠাঁই নিতে হয়েছে এবং সেখানেই ধীরে ধীরে বয়সের ভার নিয়ে ন্যুব্জ হতে হয়েছে। কীভাবে ঘটলো এই অসম্ভব ঘটনা?  

এর জন্য ইতিহাস, বিজ্ঞান, শিল্পসাহিত্য ও দর্শনের বহুমুখী কতিপয় ঘটনা এবং পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত সেই ঘটনাগুলোকে দাগ দিয়ে চিহ্নিত করার সমালোচকীয় এক অস্থির প্রয়াস দায়ী। ইতিহাস এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করলো দু’দুটি বিশ্বযুদ্ধ উপহার দিয়ে এবং মানুষের জীবনের আদর্শ ও ভাবনার নোঙর পরিবর্তনের যাত্রপাথ তুলে ধরে। মধ্যযুগে মানুষের জীবনের আদর্শ ও ভাবনার নোঙর ছিল ঈশ্বর। তখন মানুষের সকল ভাবনার বৈধতা আর সকল আদর্শের গ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করতো ঈশ্বরের নির্দেশনামার সাথে সেগুলোর সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার সাথে। রেনেসাঁস এসে ধীরে ধীরে ঈশ্বরের সেই নোঙর থেকে মানুষকে নড়িয়ে দিতে শুরু করলো। রেনেসাঁস ঈশ্বরের নোঙরকে সরিয়ে সেখানে মানবতা বা হিউম্যানিজমকে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করলো। রেনেসাঁস খুব জোরেসোরে বললো- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। তবে এমন সজোর উচ্চারণেও রেনেসাঁস ঈশ্বরকে পুরোপুরি সরাতে না পারায় ঈশ্বর ও মানবতা মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবুদ্ধি নামক এনলাইটেনমেন্ট তত্ত্বের ওপর ভর করে মানুষের বৈকল্পিক নোঙর হয়ে প্রায় একসাথে চললো কয়েকশো বছর। তারপর হঠাৎ ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দর্শনের কতিপয় ঘটনা একত্রে এক মারাত্মক ধাক্কা লাগালো এই দুই নোঙরের ওপর। ইতিহাসে অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় এই ধাক্কার পরেও কিছু থাকতে পারে এমনটা হয়তো তাত্ত্বিকরা ধারণা করতে পারছিলেন না। তাই তারা বিমূঢ়ভাবে এই ধাক্কার নাম দিলেন ‘আধুনিকতা’। এমন নামকরণের মধ্য দিয়ে যেন মনে করা হচ্ছিলো ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান সবাই এই বিন্দুতে এসে গন্তব্যে পৌঁছে গেছে। সামনে আর কোনো গন্তব্য নেই। ফলে কাল এখানে স্থির হয়ে থাকবে বিধায় আধুনিকতার পরও কিছু থাকতে পারে এমন আর ভাবারই দরকার নেই। কী ছিল ইতিহাস, বিজ্ঞান ও দর্শনের সেই ধাক্কা; যে ধাক্কা সামলাতে না পেরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাত্ত্বিকদেরকে এমন আহাম্মকি নামকরণ করতে হয়েছিল?

বিজ্ঞানের ধাক্কাটি বিশেষভাবে এসেছিল ডারউইনের কাছ থেকে। ‘অন দি অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থে (১৮৫৯) তিনি প্রথম দেখালেন যে, মানুষের সৃষ্টির সাথে বাইবেলিয় এ্যাডাম-ইভ বা আদম-হাওয়া গল্পের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক নেই এ বিষয়ক ঈশ্বরের পরিকল্পনার। মানুষ বরং মানুষ আকারে বিকশিত হয়েছে বানর জাতীয় প্রাণীর রূপান্তুর থেকে। বৈজ্ঞানিক প্রমাণের এই গ্রন্থের দাবি অনুযায়ী ঈশ্বরের হাত থেকে মানুষের সৃষ্টির গল্পটি সরে যাওয়ায় প্রকারান্তরে ঈশ্বরই ‘নাই’ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়ে গেল। সাথে সাথে কোরানের বা বাইবেলের মানুষ সম্বন্ধীয় শ্রেষ্ঠত্ব, তার ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ উপাধিও নাই হয়ে গেল। মানুষ যা, বানরও তাই, পার্থক্য শুধু হাজার বছরের বিবর্তনের ইতিহাস। এভাবে এতদিনের আদর্শ ও কল্যাণের নিয়ামক ও নোঙর ঈশ্বর, মনুষ্যত্ব- এই দুই অপরাজেয় অস্তিত্ব ও আখ্যান মানুষের চিন্তারাজ্য থেকে খান খান হয়ে ভেঙে পড়তে শুরু করলো। 

ফ্রেডরিক নিটশের দর্শন সেই ভেঙে যাওয়া বা বিচূর্ণনকে (fragmentation) আরো এক ধাপ এগিয়ে দিলো। ১৮৮২ সালে ফ্রেডরিক নিটশে বললেন ‘গড ইজ ডেড’, ঈশ্বরের মৃত্যু হয়েছে। যে রাজ্যে ঈশ্বর নেই, আদর্শের কোনো নিয়ামক নেই সে রাজ্যে ভালো ও মন্দের নির্ণয় কী? তাই ১৮৮৬ সালে ‘বিয়ন্ড গুড এন্ড ইভিল’ গ্রন্থে তিনি বললেন মানুষের এ রাজ্যে ভালো ও মন্দও নেই। নীটশের দর্শনের হাত ধরে ঈশ্বর গেছে, ভালো-মন্দ গেছে, তারপরও মানুষ আছে বলে অনেকে ভাবতে চেষ্টা করছিল যে, মানুষের ভিতরে একটা মন আছে যা দিয়ে সত্য-শুভ-সুন্দরের বীজ রোপণ করে আবার একটা মানবিকতার শস্যভূমি আবাদ করা যাবে। কিন্তু ১৮৯৯ সালে ফ্রয়েড খুব চাচাছোলা করে দেখালেন যে, মানুষের ঐ মন নামক নান্দনিক বাগানটিতে মহৎ ও নান্দনিক কিছুর চাষ হয় না। ওখানে চাষ হয় আর জন্মায় শুধু লিবিডো বা যৌনাকাঙ্ক্ষা। আরো উদোম বাংলায় পশুবৃত্তিক কামুকতা। মানুষ তার দিনরাতের সার্বক্ষণিক কায়কারবারের আঞ্জাম দেয় শুধু ঐ যৌনাকাঙ্ক্ষা বা কামুকতার তাড়নায়। এমনকি দুনিয়ার মহত্তম ভালোবাসার উদাহরণ মাতা-পুত্রের ভালোবাসার মধ্যেও ফ্রয়েড দেখাতে চেষ্টা করলেন অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষার সামাজিকীকৃত প্রকাশ যার পরিণতি ‘মাদার ফিক্সেশন’ নামক মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। ইতিহাস আরেকটু এগিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামক রাক্ষুসে ঘটনার মধ্য দিয়ে দেখালো মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তিবুদ্ধির দ্বারা শাণিত এবং এনলাইটেমন্ট দ্বারা আলোকিত শিক্ষিত মানুষেরা কী ভয়ঙ্কর রাক্ষস হয়ে একের পর এক গিলতে থাকতে পারে তারই সহোদর মানুষকে আর মানুষকে।

বিজ্ঞান, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, ইতিহাস- সবাই যখন এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিলো যে, দুনিয়াতে ঈশ্বর, মনুষ্যত্ব, মন, মহত্ব, সত্য, সুন্দর, শুভ এসবের কারো কোনো ঠিকানা নেই, কারো কোনো বন্দনা নেই তখন চতুর্দিকে ঈশ্বর ও মানবতাবাদের ওপর দাঁড়ানো সত্য-সুন্দর-শিবমের বিশাল কাঠামোগুলো, বিশাল প্রাসাদগুলো করুণভাবে ভেঙে পড়তে শুরু করলো। তাত্ত্বিকরা এই সর্বগ্রাসী ভাঙনের (fragmentation) নাম দিলেন আধুনিকতা। এই ভাঙনে ভেঙে পড়লো সকল ধর্মের ঈশ্বরের কাঠামো আর এই ভাঙনকবলিত মানুষেরা আস্থা হারালো ঈশ্বরে, আস্থা হারালো আত্মা ও পরমাত্মায়। ভেঙে পড়লো রেনেসাঁস ও এনলাইটেনমেন্ট তত্ত্বের ওপর দাঁড়ানো মানবতাবাদের কাঠামো আর সেই ভাঙনে মানুষ আস্থা হারালো মানবতাবাদ ও মনুষ্যত্বের ওপর। ভেঙে পড়লো সেই গ্রান্ড ন্যারেটভি বা মহা-আখ্যানগুলো যেগুলো অনেকদিন ধরে মানুষকে আশ্বাস দিচ্ছিলো যে, তারা দিতে পারে মানবের বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান। জার্মান দার্শনিক জুরগেন হ্যাবারমাস তাঁর ‘Modernity: An Incomplete Project’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই রকম আখ্যানগুলোর ভেঙে যাওয়া নিয়ে হা-পিত্যেশ করেছেন। এসব আখ্যানের মধ্যে যেমন ছিল কল্যাণ-রাষ্ট্রের তত্ত্ব, মার্কসবাদের মতো সব সমস্যার সমাধান তত্ত্ব, উপযোগিতাবাদের তত্ত্ব, উপনিবেশবাদের আলোকায়ন বা এনলাইটেনমেন্ট তত্ত্ব এবং এমন আরো অনেকে। এতদিনের সত্য-সুন্দর-শিবমের এমন সব তত্ত্ব ভেঙে পড়ায় তাদের ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠলো ক্লেদ, অসুন্দর আর অশুভের অসুরেরা। চারদিকে মানুষের কণ্ঠে ও লেখনিতে ভীষণ শক্তিতে উচ্চারিত হতে শুরু হলো সেই সব ক্লেদের কথা, অসুরের কথা, অশুভের কথা। শিল্পের সকল শাখায় দোর্দণ্ড প্রতাপে অভিব্যক্ত হতে লাগলো ক্লেদের কথা, অসুরের কথা, অশুভের কথা, মানবের যন্ত্রণার কথা, মানুষের গোঙানির কথা। সাহিত্য মানে নরকের অধিবাসীদের যন্ত্রণার চিৎকার। শিল্প মানে সকল শুভ ও স্বর্গীয়তা হারানোর হাহাকার। এই চিৎকার ও হাহাকারের ওপর দাঁড়ানো সাহিত্য মানে আধুনিক সাহিত্য। এই চিৎকার ও হাহাকারের ওপর দাঁড়ানো শিল্প মানে আধুনিক শিল্প।

তবে আধুনিক সাহিত্য ও শিল্প এই চিৎকার ও হাহাকার ধারণ করতে তার নিজের অবয়বটাও কিছুটা পাল্টে নিতে বাধ্য হলো। আধুনিকতা মানেই যেহেতু ভাঙনের এক যজ্ঞ, সেহেতু সেই ভাঙনের দাবিতে তার নিজ অবয়বকেও সে অনেকখানি ভেঙেচুরে নিলো। সে ভাঙনে প্রথম হাতুড়ি পড়লো সাহিত্য বিষয়ে এ্যারিস্টটলের কানুনের ওপর। এ্যারিস্টটলের কানুন অনুযায়ী প্রতিটি গল্প, উপন্যাস বা নাটকের একটি প্লট লাগবে যার একটি বিকাশ পরিক্রমা থাকবে। আধুনিক সাহিত্যের লেখকরা এই কানুন ভেঙে দিয়ে এমন গল্প উপন্যাস ও নাটক রচনায় নামলেন যাতে প্লট নেই কিংবা প্লট থাকলেও তাতে আদ্য-মধ্য-অন্তের (beginning, middle and end) বিকাশ পরিক্রমা নেই। লিখিত হলো ‘ওয়েটিং ফর গডো’র মতো নাটক কিংবা ‘মিসেস ড্যালোওয়ে’র মতো উপন্যাস। ‘ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকে ভ্লাদিমির ও এস্ট্রাগন নামের দুইজন মানুষ পর পর দুই দিন (অবশ্য দিনের পার্থক্য টেক্সটে স্পষ্ট নয়) একটি গাছের নিচে বসে অপেক্ষা করে একজন ‘গডো’র জন্য যে ‘গডো’ প্রথম দিনেও আসে না, দ্বিতীয় দিনেও আসে না। এই হলো নাটকটির সাকুল্য প্লট। এ প্লটের শুরুও যা, মধ্যখানও তাই, শেষও তাই। এর কোনো আদ্য-মধ্য-অন্তের বিকাশ পরিক্রমা নেই। একইভাবে ‘মিসেস ড্যালোওয়ে’ উপন্যাসে ক্লারিসা ড্যালোওয়ে সন্ধ্যায় একটি পার্টি আয়োজন করবে এমন প্লট নিয়ে উপন্যাসটির শুরু হয়। কিন্তু এরপর সে প্লটের কাহিনি সকাল থেকে বিকালের দিকে অগ্রসর হয় না। বরং সে কাহিনি চলে যায় অনেক পিছনে, অনেক মানুষ ও গল্পের  দিকে যার মধ্যে এই বিকালের-পার্টি প্লটের কোনো দৃশ্যমান সংযোগ নেই। আবার গল্পের শেষে বিকালের পার্টি এসে নাযিল হয় মাঝখানের ঘটনা পারম্পর্য ছাড়াই। এভাবে লিখিত হলো এমন উপন্যাস যেখানে এ্যারিস্টটলের আখ্যানিক কানুনকে রীতিমতো কলা দেখিয়ে দেয়া হলো। 

এ্যারিস্টটলের কানুনের সাথে সাথে আধুনিকতার ভাঙনের হাতুড়ির আঘাত পড়লো শিল্প-সহিত্যের আরো অনেক প্রতিষ্ঠিত রীতি ও কানুনের ওপর। এতদিন কবিতার সাথে ছন্দ ও গীতলতা (metre and melody) এক অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত ছিল। কবিতার আধুনিকতা ভেঙে ফেললো সেই রীতি। কবিতা লিখিত হলো মুক্ত ছন্দে (free verse) অর্থাৎ ছন্দ থেকে মুক্তি নিয়ে। এতদিন কবিতায় ছিল ধ্বনিগত সুরের ব্যঞ্জনা (melody)। আধুনিকতা দাবি করলো জীবনের কাৎরানি আর গোঙানির প্রকাশ এমন সুরের ব্যঞ্জনায় সম্ভব নয়। তাই আধুনিক কবিতায় সুরের ব্যঞ্জনার স্থান দখল করলো ধ্বনির কর্কশতা (cacophony)। এতদিন কবিতায় চিত্রকল্প ছিল পারস্পরিকভাবে অন্বয়যুক্ত। আধুনিকতা ভেঙে ফেললো সেই অন্বয়ের রীতি। চিত্রকল্পের সেই অন্বয়যুক্ত পরম্পরা ভেঙে দিয়ে কবিতার আধুনিকতা দাবি করলো কবিতা মানেই হলো অন্বয়হীনভাবে বিচূর্ণিত চিত্রকল্পের স্তূপ (a heap of broken images)। টি এস এলিয়ট হাতে কলমে দেখালেন সে স্তূপ কেমন হয়। ভেঙে দেয়া হলো গল্পকথকের দৃষ্টিভঙ্গিগত (narrator’s point of view) সনাতন রীতি। এতদিনের রীতিতে গল্প বা উপন্যাস সর্বদ্রষ্টা কথক (omniscient narrator) বা চরিত্র-কথকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণিত ও উপস্থাপিত হতো। আধুনিকতা ভেঙে দিলো গল্প বা উপন্যাসের সেই কথক-রীতি এবং কথকের দৃষ্টিভঙ্গির রীতি। সেখানে প্রতিষ্ঠিত হলো কথকের বহুলতা এবং কোনো নির্দিষ্ট কথকের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপন্যাসকে মুক্তি দেয়ার নতুন নতুন নিরীক্ষণ ও পরীক্ষণ।

ফলে আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায় : ১. সত্য-সুন্দর-শিবমের বিশাল কাঠামোগুলোর ভাঙন ও তদ্দর্শনে মানবের অসহায় হাহাকার ও চিৎকার, যা হলো আধুনিকতার বিষয়বস্তুগত দিক; ২. সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত আঙ্গিক ও কানুনগুলোর ভাঙনের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট নতুন নতুন আঙ্গিক ও কানুনহীনতার উন্মাদনা, যা হলো আধুনিকতার আঙ্গিকগত দিক। আধুনিকতার ইতিহাসে আধুনিকতার আঙ্গিকগত দিকে আঙ্গিকের ভাঙনের শ্লোগান নিয়ে দিনে দিনে হাজির হয়েছে নতুন নতুন অনেক আন্দোলন। সেসব আন্দোলনের মধ্যে আভাঁ গার্দ, দাদাইজম, এক্সপ্রেশনিজম, কিউবিজম ইত্যাদি নাম সারা দুনিয়ার সাহিত্যে অনেক ওলটপালটের ডাক দিয়েছিল। এই সকল আন্দোলনই মূলত আধুনিকতা নামক তত্ত্বের ছা-পোনা। তবে ধীরে ধীরে এই ছা-পোনারা তাদের পৈত্রিক ঋণ অস্বীকার করে এমনকি তাদের পৈত্রিক পরিচয়কে পর্যন্ত অস্বীকার করে নতুন পথে ও পরিচয়ে অগ্রসর হতে শুরু করলো। চলবে

দ্বিতীয় পর্বে পড়ুন : আধুনিকতা থেকে উত্তরাধুনিকতা

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মাইলফলক: পার্বত্য উপদেষ্টা
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মাইলফলক: পার্বত্য উপদেষ্টা
ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো যাবে না: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
ইলিশের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানো যাবে না: প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সাময়িক বরখাস্ত
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সাময়িক বরখাস্ত
জুভেন্টাসের বিপক্ষে এমবাপ্পেকে পাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ?
জুভেন্টাসের বিপক্ষে এমবাপ্পেকে পাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ?
সর্বাধিক পঠিত
সঞ্চয়পত্রে কমলো মুনাফার হার, কার্যকর ১ জুলাই থেকে
সঞ্চয়পত্রে কমলো মুনাফার হার, কার্যকর ১ জুলাই থেকে
তিন বিমানবন্দরে ১৬ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে
তিন বিমানবন্দরে ১৬ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হচ্ছে
ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ
ইস্টার্ন ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিবারের ব্যাংক হিসাব জব্দ
অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মুখোমুখি
প্রশাসনে থামছে না আন্দোলনঅন্তর্বর্তী সরকার ও প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা মুখোমুখি
আরও ১১ ব্যাংকের সম্পদ যাচাই করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
আরও ১১ ব্যাংকের সম্পদ যাচাই করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক