X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১
বাঙলা সাহিত্যে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা

আধুনিকতাবাদ ও উত্তরাধুনিকতাবাদ ।। শেষ পর্ব

মুহম্মদ মুহসিন
১৫ মার্চ ২০২৩, ১৬:৪৭আপডেট : ১৫ মার্চ ২০২৩, ১৭:৫৯

আধুনিকতা ও  উত্তরাধুনিকতার সময়কাল

এবারে একটা প্রশ্ন আসে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা শব্দের এই পাগলাটে সব অর্থ যখন করা হয় তখন শব্দ দুটোর আভিধানিক অর্থের মধ্যে সময় বা কালগত সাম্প্রতিকতার যে আবশ্যিক অর্থ রয়েছে তা কি পুরোটাই উবে যায় নাকি ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকে। সাথে সম্পূরক আরো প্রশ্ন দাঁড়ায় ইতিহাসে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতার যুগ বলতে কোন সময়কালকে বোঝাবে? আমরা এ আলোচনার শুরুতে বলেছিলাম ‘আধুনিকতা’ তো এমন এক শব্দ যা ইতিহাসের কোনো বিন্দুতে আটকে যেতে পারে না। আধুনিকতা তো সবসময় সর্বসাম্প্রতিক অগ্রগতির অর্থ বোঝানোর জন্য অভিধান দ্বারা লাইসেন্সপ্রাপ্ত এক শব্দ। কিন্তু অভিধানের দেয়া এই লাইসেন্স অকার্যকর করার লক্ষ্য নিয়েই মূলত তাত্ত্বিকরা তাদের আলোচনায় ‘আধুনিকতা’ নামের বয়ান শুরু করেছিলেন। আধুনিকতার সূচনা যেসকল দার্শনিক মতবাদ ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফসল হিসেবে সংঘটিত হয়েছিল আমরা সেগুলোর আলোচনায় দেখেছি তাদের যাত্রা ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগ থেকে শুরু হয়েছিল। ডারউইনের আগমন ১৮৬০ এর দশকে, নিটশের দর্শনের আগমন ১৮৮০ এর দশকে, আর ফ্রয়েডের তত্ত্বের আগমন ১৯১০ এর দশকে। দর্শন, বিজ্ঞান ও ইতিহাস থেকে বের হয়ে সেসকল তত্ত্বের শিল্পসাহিত্যের জমিনে এসে ব্যাপক উৎপাত শুরু করতে কিছুটা সময় নিলেও ১৮৯০ এর দশকে প্রায় সকল তত্ত্ব একযোগে এই উৎপাতটা জোরদার করে ফেলেছিল। ফলে ইতিহাসের নিরিখে আধুনিকতার দাপুটে যাত্রাটা ১৮৯০ এর দশকে শুরু হয়েছিল। এরপর মহাসমারোহে এই যাত্রা চলেছে ১৯২০ এর দশকের শেষাবধি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বিধ্বস্ত মানবতার হাহাকার সে দাপটকে অধিকতর শক্তি যুগিয়েছিল। এরপরে এর ডামাডোল ধীরে ধীরে নিস্তেজ হতে থাকে। ১৯৬০ এর দশক থেকে আধুনিকতার নির্মিত সৌধের ওপর নতুন সাইনবোর্ড উঠে উত্তরাধুনিকতার। ১৯৮০ এর দশক পর্যন্ত উত্তরাধুনিকতা দোর্দণ্ড প্রতাপে সাহিত্য ও শিল্পের জগতে রাজত্ব করে ১৯৯০ এর দশক থেকে নিস্তেজ হতে শুরু করে। এ্যালান কিরবি (Alan Kirby) নামে একজন ব্রিটিশ পন্ডিত ২০০৬ সালে পোস্টমডার্নিজম বা উত্তরাধুনিকতার মৃত্যু ঘোষণা করে প্রবন্ধও লিখেছেন। এভাবে একসময় আধুনিকতাও বৃদ্ধ হয়ে গেল, মরে গেল এবং উত্তরাধুনিকতাও বৃদ্ধ হয়ে গেল এবং মরে গেল। এই ‘মরা’ এক রূপক শব্দ, শিল্প-সাহিত্যের কোনো তত্ত্ব বস্তুত কোনোদিন মরে না।

এই অবস্থায় ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো আধুনিকতা শব্দের অর্থ নিয়ে। আধুনিকতা নিজেই সাহিত্যের জগতে ঢুকে আর আধুনিক থাকতে পারলো না, পুরনো ও সেকেলে হয়ে গেল। সাহিত্যের জগতে আধুনিকতা দ্বারা অগ্রগতি ও উন্নতির শেষ অবস্থা কিংবা যে কোনোকিছুর সর্বশেষ বা সর্বসাম্প্রতিক অবস্থা বোঝানোর আর সুযোগ থাকলো না। সাহিত্যের আধুনিকতা আর ইতিহাসের আধুনিকতা সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেল। ইতিহাসে আধুনিক মানে সাম্প্রতিক সময়কাল, পক্ষান্তরে সাহিত্যে আধুনিক মানে হয়ে দাঁড়ালো অন্তত একশো বছর আগের সময়কাল। সাহিত্যের এই তত্ত্ব না-জানা যে-কেউ আধুনিক কবিকে ইতিহাসের আধুনিক যুগে খুঁজবে এমনটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সাহিত্যতত্ত্ব জানা কোনো ব্যক্তি যখন শুনছে পাশে একজন বলছে- ‘আমাদের এসময়ের আধুনিক কবিরা যথেষ্ট দেশপ্রেমী ও মানবপ্রেমী’; তখন তত্ত্ব-জানা লোকটি পাশের লোকটিকে প্রথমত বেকুব ভাববে এবং তারপর জ্ঞান দিয়ে বলবে- ‘দাদা, আপনি অন্তত তিনখানা ভুল কথা বলেছেন: ১. সাহিত্যে আমাদের এসময়টা আধুনিক নয়, আধুনিকতার সময় গেছে প্রায় একশো বছর আগে; ২. দেশপ্রেম এনলাইটেনমেন্ট থিওরির একটি ইতিবাচক মূল্যবোধ যা কবিতায় উচ্চারিত হলে তা মূল্যবোধের ভাঙন, বন্ধ্যাত্ব ও খরাকে তুলে ধরতে পারে না, ফলে কোনো দেশপ্রেমের কবিতা আধুনিক হতে পারে না; ৩. মানবপ্রেমও একইভাবে এনলাইটেনমেন্ট থিওরির একটি ইতিবাচক মূল্যবোধ যা কবিতায় উচ্চারিত হলে তা মূল্যবোধের ভাঙন, বন্ধ্যাত্ব ও খরাকে তুলে ধরতে পারে না, ফলে কোনো মানবপ্রেমের কবিতা আধুনিক হতে পারে না।’ তত্ত্ব-না-জানা লোকটি তখন মনে মনে নাউজুবিল্লাহ পড়বে আর বলবে, ‘ইয়া আল্লাহ, এ পন্ডিত কী কয়! কথা কইলাম একখান আর তাতে ভুল হইলো তিনখান? আল্লাহ, তুমি আমাদের সাহিত্যকে এই মস্তিষ্কবিকৃত পন্ডিতদের হাত থেকে বাঁচাও’।

এই সমস্যা থেকে বাঁচার জন্য আমার কাছে একটি টোটকা বুদ্ধি আছে। বুদ্ধিটা খুব মৌলিক না, কিছুটা ব্যবহারে ইতোমধ্যেই আছে, তবে ব্যাপকভাবে গৃহীত ও সমাদৃত হয়নি। বুদ্ধিটা হলো শিল্প সাহিত্যের ‘আধুনিকতা’ আর ইতিহাস বা সময়কাল বোঝানোর ‘আধুনিকতা’ শব্দদুটো এক না রেখে, কোনো অনুসর্গ-উপসর্গ যোগে দুটোকে আলাদা দুটি শব্দে রূপান্তর করে দেয়া। যেহেতু ইতিহাস বা সময়কালের সাম্প্রতিকতা বোঝানোর অর্থে আধুনিকতা শব্দটি আপামর পন্ডিত-মূর্খ, যুবা-বৃদ্ধ, হিন্দু-মুসলমান সবাই ব্যবহার করছে সেহেতু এই অর্থে শব্দটি যেমন আছে তেমনই রাখা যেতে পারে। তবে সাহিত্য ও শিল্পের আধুনিকতা বোঝাতে ‘আধুনিকতা’ শব্দটির সাথে ‘বাদ’ অনুসর্গ যুক্ত করে ‘আধুনিকতাবাদ’ এবং এর বিশেষণ হিসেবে ‘আধুনিকতাবাদী’ শব্দটি ব্যবহার করা যেতে পারে। তখন বলা যেতে পারে যে, আধুনিক সাহিত্য হলো সাম্প্রতিক কালের সাহিত্য। আর আধুনিকতাবাদী সাহিত্য হলো সেই সাহিত্য- যে সাহিত্য জীবনের ক্লেদের কথা, অসুরের কথা, অশুভের কথা, যন্ত্রণার কথা, গোঙানির কথা বলে; যে সাহিত্য মানব জীবনের সকল শুভ ও স্বর্গীয়তা হারানোর হাহাকারের কথা বলে; যে সাহিত্য খুঁজতে হলে আমাদের প্রায় একশো বছর আগে ১৮৯০ এর দশক থেকে ১৯৩০ এর দশক পর্যন্ত ইতিহাসের জমিন হাতড়াতে হবে। তখন আধুনিক সাহিত্য বলতে বোঝাবে সাহিত্যের বিশ্বব্যাপী চলমান সাম্প্রতিক প্রবণতাসমূহ ধারণ করে এমন সকল সাহিত্য। আর আধুনিকতাবাদী সাহিত্য বলতে বোঝাবে বিশেষ করে নিটশে, ডারউইন আর ফ্রয়েডের তত্ত্বের আঘাতে ভেঙেচুরে পড়া ইউরোপীয় সাহিত্য সৌধকে। তখন আমাদের বর্তমানের সাহিত্য বিশ্লেষণ করে তাতে আধুনিকতাবাদের প্রকাশ না দেখে মন খারাপ করার কিছু থাকবে না, হীনমন্যতারও কিছু থাকবে না। আমাদের বর্তমান সাহিত্যে আধুনিকতাবাদের প্রয়োগ না দেখে বরং তখন স্বস্তি ও শান্তি লাগবে, কারণ আধুনিকতাবাদ মানে তো সকল সত্যম-শিবম-সুন্দরমের ধ্বংসযজ্ঞের ওপর ক্লেদ ও যন্ত্রণার উন্মত্ত আস্ফালনকে ঘিরে মানবের প্রাণান্তকর চিৎকার, যা কারো কাম্য হতে পারে না।

বাঙলা সাহিত্যে আধুনিকতা ও উত্তরাধুনিকতা

আমাদের সত্যিই আল্লাহ বাঁচিয়েছেন যে- নিটশে, ডারউইন আর ফ্রয়েড বাংলার জমিনকে অতটা তছনছ করতে পারেনি; তাদের জীবদ্দশায়ও না, আর সেই থেকে শুরু করে আমাদের জীবৎকাল পর্যন্তও না। ফলে সাহিত্যের আধুনিকতাবাদ আমাদের বাংলা সাহিত্যকে মাশাল্লাহ এখন পর্যন্ত কাবু করতে পারেনি। আমাদের বইপত্রে আধুনিক কবি বলতে কিছু কবি ও সাহিত্যিককে হালকা চালে নির্দিষ্ট করা আছে, আধুনিক নামে একটি যুগও বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থগুলোয় আছে। বিশেষ কিছু কবি সাহিত্যকদেরকে আধুনিক বলে নির্দিষ্টকরণের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় আধুনিকতাবাদের তত্ত্বকে দূর থেকে কিছুটা স্মরণে রাখা হলেও যুগচিহ্নিতকরণে বিষয়টি পুরোই ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে করা হয়েছে, আধুনিকতাবাদের তত্ত্বকে বিন্দুমাত্র আমলে নেয়া হয়নি। যুগ চিহ্নায়নের ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে ১৮০১ সাল থেকে আজকের সকাল পর্যন্ত পুরো সময়টাই আধুনিক যুগ। কী অর্থে এই সময়কালটা আধুনিক? কারণ এটি মধ্যযুগের পরে এসেছে। এর বাইরে এই চিহ্নায়নের আর কোনো কারণ ও ব্যাখ্যা নেই। ইউরোপে বা ইংরেজি সাহিত্যে কোথাও তখন পর্যন্ত আধুনিকতার কোনো নামগন্ধও শুরু হয়নি। ইংরেজি সাহিত্যের যুগ চিহ্নায়নে মোটাদাগে মধ্য যুগের পরে রেনেসাঁস, তারপর নিওক্লাসিকাল, তারপর রোমান্টিক, তারপর ভিক্টোরিয়ান এবং তারপর বলা যায় আধুনিক যুগের শুরু। মাঝখানে পিউরিটান যুগ, রেস্টোরেশন যুগ ইত্যাদি নামে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু যুগ চিহ্নিত থাকলেও ইতিহাসে সেগুলো খুব বিখ্যাত ও গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগ যেতেই ধপাস করে আধুনিক যুগ হাজির হয়েছে। তাই সাহিত্যের আধুনিকতাবাদের সাথে কোনো সম্পর্ক ছাড়াই বাংলা সাহিত্যে আধুনিক যুগের নামকরণ হয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে ১৮০১ সাল থেকে চিহ্নিত এই আধুনিক যুগের দিকে তাকিয়ে এর বৈশিষ্ট্য অনুসন্ধানে নামলে একটি সাধারণ বিষয় চোখে পড়ে। সেটি হলো ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় আর ইউরোপীয়দের হাতে বাংলা গদ্যের সূচনা হয়। বাংলার লোকেরা কলোনাইজার ইংরেজদের কাছ থেকে তাদের অর্থাৎ ইংরেজি ও ইউরোপীয় সাহিত্যের প্রকরণ ও আঙ্গিক সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। ফলে আমাদের পুরনো সাহিত্যের ধারা যেমন মঙ্গলকাব্য, পদাবলী সাহিত্য বা কলমি পুঁথি ইত্যাদি প্রকরণ (genre) ও আঙ্গিক  (form) থেকে বের হয়ে ঔপনিবেশিক জ্ঞান থেকে লব্ধ ইউরোপীয় আঙ্গিকে ও প্রকরণে বাংলা সাহিত্যের চর্চা শুরু হয়। সহজ কথায় তখন থেকে বাংলায় ঔপনিবেশিক সাহিত্যধারার যাত্রা শুরু হয়। এই ঔপনিবেশিক সাহিত্যই বাংলা সাহিত্যের যুগ চিহ্নায়নে আধুনিক যুগ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। তার মানে হলো বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কলোনিয়ালিজম বা উপনিবেশবাদ মানেই আধুনিকতা। বাংলা সাহিত্যে এখনো সেই ঔপনিবেশিক সাহিত্য ধারা চলমান বিধায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসবেত্তারা সেই ১৮০১ থেকে শুরু করে পুরো সময়কালকে এখনো আধুনিক যুগ হিসেবেই অভিহিত করে যাচ্ছেন, নতুন কোনো যুগের সন্ধান তারা এখনো পাননি।

যুগ চিহ্নায়নে ঔপনিবেশিকতাকে আধুনিকতার মানদণ্ড হিসেবে জ্ঞান করলেও বিশেষ করে ১৯৩০ এর দশকের ‘কল্লোল যুগ’ বলে কথিত যুগের কতিপয় কবি এবং তাদের অনুসারীদেরকে আধুনিক কবি হিসেবে আখ্যায়িত করার ক্ষেত্রে আধুনিকতাবাদের তত্ত্বকেও আমলে নেয়া হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়। এঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন জীবনানন্দ দাশ ও তাঁর অনুসারীরা। এই কবিরা বাংলা কবিতাকে সনাতন ছন্দ থেকে মুক্তি দিয়েছেন, কবিতাকে অনেক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান সম্পর্করহিত চিত্রকল্পের স্তূপে রূপায়ণ করেছেন, কবিতাকে আদমধ্যঅন্ত-রূপ বিকাশ পরিক্রমা থেকে মুক্তি দিয়েছেন- ফলে এঁদেরকে আধুনিক কবি বললে তা আধুনিকতাবাদের তত্ত্ব-সমর্থিত মনে হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁরা আধুনিকতাবাদের বিষয়বস্তুর দিকে কতটা ঝুঁকেছিলেন বা ঝুঁকেছেন তা খুঁজতে গেলে আমরা দৃঢ়তার সাথে বলতে পারবো তাঁরা কেউ বিষয়বস্তুগতভাবে আধুনিক হতে চাননি। তাঁদের কবিতা বা অন্য প্রকরণের সাহিত্যকর্মসমূহ তীব্র উচ্চারণে বলে না জীবনের ক্লেদের কথা, অসুরের কথা, অশুভের কথা, যন্ত্রণার কথা, গোঙানির কথা বা মানব জীবনের সকল শুভ ও স্বর্গীয়তা হারানোর হাহাকারের কথা; কারণ তাঁরা সকলেই স্পষ্টতভাবে ধারণ করতেন আদর্শিকতার এক স্বপ্ন কাঠামো। সে স্বপ্ন কাঠামোতে কারো রয়েছে নিসর্গের অনিন্দ্য সৌন্দর্যে অবগাহনের আনন্দ, কারো রয়েছে অতীন্দ্রিয় কোনো আধ্যাত্মিক জগতের অনির্বচনীয় আনন্দ ও সৌন্দর্যের আবাহন, কারো রয়েছে মানবতাবাদের দুর্দান্ত জয়গান, কারো রয়েছে মানবরচিত কোনো মতবাদ কেন্দ্রিক মানবমুক্তির জয়গান ও শ্লোগান। আর এই সকল উচ্চারণই অবিসংবাদিতভাবে রোমান্টিক ও অনাধুনিক। ফলে জীবনানন্দ ও তাঁর অনুসারী বাংলা কবিদের মধ্যে মারাত্মক বৈপরীত্যের একটি দ্বৈততা রয়েছে। তাঁরা প্রায় সবাই আঙ্গিকে আধুনিক এবং বিষয়বস্তুতে রোমান্টিক। সত্যিকার অর্থে বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে বাংলা কবিতা, বিষয়বস্তুতে কখনোই আধুনিকতাবাদকে লালন করেনি। আমাদের মূলধারার কবিদের মধ্যে বিষয়বস্তুতে রোমান্টিক নন এমন কবি খুঁজে পাওয়া যায় না।

তবে আমাদের বাংলা কবিতায় যন্ত্রণার চিৎকার ও হুঙ্কার অনেক আছে। সেগুলো আধুনিকতার হাহাকারের চেয়ে মার্কসবাদী বিপ্লবের চেতনায় অধিকতর রঞ্জিত ও উজ্জীবিত। সেগুলোতে নিষ্পেষিতের ও নির্যাতিতের যন্ত্রণার কাৎরানি আছে এবং গোঙানি আছে। কিন্তু সেই গোঙানির উচ্চারণের সাথে মার্কসবাদী বিপ্লবের চেতনা বুনে দেয়ার অঙ্গীকার থাকায়, সেখানে বিশ্বাসের ও আস্থার কেন্দ্র হারানো কিংবা চেতনার কেন্দ্র হারানো অনিকেত মানুষের হাহাকার নেই। ফলে তার মধ্যে আধুনিকতার শূন্যতা ও হাহাকার নেই। এতদসত্ত্বেও বলতে হয় যে, বিষয়বস্তুতে সর্বতো অনাধুনিক হলেও আঙ্গিকে ও প্রকরণে বাংলা কবিতা আধুনিকতা তো ধারণ করেছেই, এমনকি উত্তরাধুনিকতায়ও পিছিয়ে নেই। আমাদের এই মাটির সাহিত্যের উপনিবেশপূর্ব প্রকরণ চর্চায় নিয়ে উত্তর-উপনিবেশবাদিতা তথা উত্তরাধুনিকতার চর্চা করেছেন আমাদের অনেক কবি ও সাহিত্যিক। সেলিম আল দীনের দ্বৈতাদ্বৈতবাদী নাটক, রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর হাটুরে কবিতা ঘরানার কবিতা, বাদল সরকারে থার্ড থিয়েটারের নাটক, শহীদুল জহিরের বাঙালি অধিবাস্তবতার গল্প আমাদের সাহিত্যের উত্তরাধুনকিতার বহুল চর্চার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র।

উত্তরাধুনিকতা চর্চার এই ঐশ্বর্য থাকা বাংলা সাহিত্যের জন্য গৌরবজনক হলেও, বাংলা সাহিত্যে বিশুদ্ধ আধুনিকতার চর্চা না থাকাটা আমার মতে মোটেই অগৌরবের নয়। আমাদের এতক্ষণের আলোচনায় আশা করি এই বিষয়টি কোনোমতে অস্পষ্ট নেই যে, আধুনিকতাবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী আধুনিকতা হলো আঁকড়ে ধরার মতো কোনো বিশ্বাস, কোনো দর্শন বা কোনো মূল্যবোধ না থাকা। আমরা বাঙালি জাতি কোনোকালে এমন বিশ্বাসহীন ও দর্শনহীন শূন্যতায় পড়িনি এবং পড়বোও না। ফলে ইংরেজি সাহিত্যের আধুনিকতাবাদ আমাদেরকে কখনো পাকড়াও করেনি। এটাই আমাদের গৌরব।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ ডিসি ও এসপিদের
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসকে ১৮ দেশের আহ্বান
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
উপজেলা নির্বাচনে নেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল
উপজেলা নির্বাচনে নেই বেশিরভাগ রাজনৈতিক দল
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা