X
বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫
১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
উপন্যাস

মহাঘোরা ।। পর্ব—৫

আনিফ রুবেদ
১৬ অক্টোবর ২০২৩, ১১:০২আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০২৩, ১১:০২

[যোগচিহ্ন উড়ন্ত পাখি। যোগচিহ্ন মৃত্যু।]

শ্রীদাম শুয়ে শুয়ে ভাবতেই থাকে। প্রচণ্ড ভাবনার সময় ব্যথা বুঝি কম লাগে।

সে ভাবে, আচ্ছা, একা শুয়ে থাকলে বিয়োগচিহ্ন হয়, দুজন পাশাপাশি শুয়ে থাকলে সমানচিহ্ন হয় তাহলে একা একটা মানুষ দাঁড়িয়ে থাকলে কোন চিহ্নের মতো হয়?

যোগচিহ্নটা মানুষের কোন অবস্থার সাথে মেলে?

গুন আর ভাগ চিহ্ন মানুষের শরীরের কোথায় অবস্থান নিয়েছে?

একজন মানুষকে দেখতে তার ইচ্ছে করছে।

মানুষ দেখার জন্য সে মাধবীকে ডাকে— ‘মাধবী মা, এদিকে আয় তো একটু।’

মাধবী সাড়াহীন এসে দাঁড়ায় তার সামনে। কিছু বলে না, দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে; তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। শ্রীদামের চোখ ঝিকঝিক করে ওঠে মাধবীর দাঁড়ানো দেখে; ইউরেকা! সে আবিষ্কার করে ফেলেছে; মাধবী দাঁড়িয়ে আছে উলম্ব হয়ে। এর মানে একটা মানুষ অনুভূমিকরেখায় একা দাঁড়িয়ে থাকলে উল্লম্বরেখার মতো দাঁড়িয়ে থাকে আর হাঁটলে মনে হবে একটা উলম্ব হেঁটে যাচ্ছে। মানুষ চলমান উল্লম্বরেখা; যখন মাটি স্থির অনুভূমিক রেখা।

শ্রীদাম মাধবীকে ডেকেছিল মানুষ দেখার জন্য। আর ডেকেছিল গণিত আর জ্যামিতি বইটা নিয়ে আসার জন্য। দেখে নিত এ নিয়ে ইউক্লিড বা টলেমি বা বোলাই কিছু বলেছেন কি না তা দেখে নিতে। কিন্তু তার আর দরকার হলো না; মাধবী দাঁড়াতেই উল্লম্বের মানবোচিত ধারণা পেয়ে গেছে। বই লাগেইনি।

তাহলে কি মানুষ একটা বই?

মানুষ কি একটা অসংখ্য বই?

মানুষ কি জ্যামিতি বই?

এই যে হাত দুটো, দুটো সরল রেখার মতো ঝুলে আছে। সরলদোলকের মতো ঝুলে হাঁটার সময়। একটা হাতকে কনুই থেকে ভাঁজ করে নানা ডিগ্রির কোণ পাওয়া যায়। এই যে মানুষ দুপা ফাঁক করে দাঁড়ালে কাঁটা-কম্পাসের মতো মনে হয়।

মানুষ কি গণিত বই?

আঙুলের গাঁট গুনে গুনে মানুষ হিসাব করে সবকিছুর। মানুষ যখন পাশ ফিরে শুয়ে থাকে তখন চোখ দুটোকে ভাগ চিহ্নের মতো লাগে। মানুষ যখন পা ফাঁক করে দাঁড়ায় আর চৈতন্যদেবের মতো হাত দুটোকে উঁচু করে ধরে তখন গুণ চিহ্নের মতো মনে হয়।

ভূগোল বই না কি মানুষ?

মানুষের মাথাকে তো একটা ভূগোলকের মতো মনে হয়। চোখদুটোকে পুকুরের মতো মনে হয়, নাকটাকে পাহাড় পর্বতের মতো মনে হয়। মানুষের মাথায় আর বুকে আর বগলের নিচে আরো এখানে ওখানে বনজঙ্গল।

অর্থনীতি বই?

শরীর দিয়েই অর্থনীতির অর্থভেদ বুঝে নেওয়া যায়। শরীর থাকলে অর্থ আছে না থাকলে নেই। পুরুষের পেট চলে শক্তির জোরে, নারীর পেট চলে রূপের জোরে। শরীরই অর্থনীতি।

মানুষকে ভালো করে দেখলেই জ্ঞানোদয় হবে, জ্ঞানের সব পিপাসা মিটে যাবে।

বেলায়েত স্যার যেমন বলতেন— ‘জন্মিলেই জানোদয় হয়, কিন্তু জ্ঞানোদয় হয় না। বুঝলি রে গাধারা। জানোদয় মানে জান উদয়, জান মানে প্রাণ। মানুষ দেখে দেখে জ্ঞান বাড়াতে হয়; মানুষকে ভালো করে দেখলেই, ভালো করে বুঝলেই জ্ঞানরাজ্যে প্রবেশ করা যায়। বুঝলি রে গাধারা।’

স্বগতোক্তি করল শ্রীদাম— ‘জি স্যার বুঝেছি, তখন বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝলাম।’

ভাবে, কিন্তু কই আর ভালো করে দেখা হয় মানুষকে। মানুষ সবকিছইু ভালো করে দেখে, মানুষ মানুষকেই ভালো করে দেখে না। ভালো করে দেখলে পৃথিবীতে এতো প্যাঁচ পড়ত না; এতো প্যাঁচাল হতো না।

যোগচিহ্ন সম্পর্কিত প্রশ্ন যোগ হয়েই আছে তার কৌতুহলের সাথে। এটার জন্য এবার গণিত বইটা লাগবে। সরাসরি যোগচিহ্নের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে; যোগচিহ্নের একেকটা ঠ্যাং ভেঙে দেখতে হবে, আরো দু-একটা ঠ্যাং যোগ করে দেখতে হবে; গুড়ো গুড়ো করে দেখতে হবে।

শ্রীদাম মাধবীকে বলে— ‘তোর গণিত বইটা নিয়ে আয় তো মা।’

মাধবী বলে— ‘পড়া তো আগেই ছেড়ে দিয়েছি বাবা, স্কুলে যাই না।’

শ্রীদাম চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ; মনে ব্যথা পায় খুব।

ব্যথা ঢাকতেই হয়তো সে রেগে যায়— ‘তুই স্কুল যাওয়া বাদ দিয়েছিস, তাহলে তো তোর বইও স্কুল যাওয়া বাদ দিয়েছে না কি, না কি তোর বই তোকে ছেড়ে একা একা স্কুলে চলে গেছে! তোর গণিত বইটা নিয়ে আয়। শুধু শুধু কথা বলিস।’

বাবার রেগে যাওয়াতে মাধবী আহত হয় একটু, বলে— ‘আমি স্কুল যাওয়া বাদ দিয়েছি, আমার সাথে সাথে বইও স্কুল যাওয়া বাদ দিয়েছে বাবা। আমি চুলোয় গেছি আমার বইও আমার সাথে সাথে চুলোয় গেছে। গণিত বই, ইতিহাস বই, ভূগোল বই, খগোল বই, অর্থনীতি বই, সমাজ বই, বিজ্ঞান বই, সব বইয়ের পাতা একটা একটা করে ছিঁড়ে চুলা ধরিয়েছি বাবা, এখন শুধু ধর্ম বইটা বাকি আছে ওটা পোড়াতে মনে বাধে তবু চুলা ধরানোর কিছু না পেলে কখন সেটাও পোড়াতে হবে কে জানে।’

শ্রীদাম ব্যথা পায় প্রচণ্ড। ভাত ছাড়া মানুষের চলে না, জ্বালানি ছাড়া চুলা জ্বলে না।

আর যদি লাকড়ি না-ই পায় মাধবী?

আর যদি বইয়ের পাতা না-ই পায় মাধবী?

তাহলে কি সে চুলাতে ভাত রান্নার জন্য নিজের চুল পুড়িয়ে ফেলবে?

চুল শেষ হলে পোশাক পুড়িয়ে ফেলবে?

পোশাক ফুরিয়ে গেলে গায়ের মাংস কেটে শুকিয়ে পোড়াবে ভাত রান্নার জন্য?

মাংস শেষ হয়ে গেলে হাড় পোড়াবে?

শ্রীদাম ছটফট করে, যেন সে মাধবীর হাড় পোড়ার পড়পড় শব্দ, মাংস পোড়ার চড়চড় শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আহা আমার রোগে শোকে সোস্ত এ শরীর যদি হঠাৎ করেই সুস্থ হয়ে যেত! মাধবীর একফোঁটা কষ্ট হতে দিতাম না। কিন্তু এ অবস্থায় থাকলে তো কিছুই হবে না। আমার তো এখন শ্রীও নেই, শক্তিও নেই, দামও নেই। শ্রীহীন শ্রীদাম, দামহীন শ্রীদাম, শক্তিহীন শ্রীদাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে। যদি হঠাৎ করেই কালকে ভোরে জেগে একেবারে স্বাভাবিক মানুষের মতো উঠে হেঁটে বেড়াতে পারত, খেটে বেড়াতে পারত তবে কতই না ভালো হতো।

মাধবী বেরিয়ে যায় ঘর থেকে, তাকে চুলার কাছে যেতে হবে। সে চুলা ধরিয়েছিল। কিছুক্ষণ মাত্র চুলার কাছে না থাকাতেই আগুন কমে গেছে। নিভন্ত চুলা ধোঁয়া ছড়াতে শুরু করেছে।

ধোঁয়া শ্রীদামের ঘরেও আসছে। তার দমবন্ধ অবস্থা হয়।

দমবন্ধ অবস্থার ভেতরেই ভাবে, কোন বই পোড়া ধোঁয়া আসছে এখন?

ভূগোল বই?

গণিত বই?

বিজ্ঞান বই?

নাকি ধর্ম বই পোড়া ধোঁয়া?

ধর্ম বই হয়তো সহজে পুড়তে চাইছে না বলে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে। ধোঁয়া আরো বেড়েছে। ধোঁয়া আর ধোঁয়ার স্বভাব সবসময় বক্র, প্যাঁচানো জটবাঁধা সুতোর মতো। ধোঁয়াদের কী কী সব রূপ। কোনো ধোঁয়া লতিয়ে লতিয়ে উড়ে যাচ্ছে মাথায় ঘোমটা নতুন বউয়ের মতো। কোনো ধোঁয়া সাপের মতো। কোনো ধোঁয়া দেবতার বিগ্রহের মতো। ধোঁয়া বেড়ে গেল আরো। এ ধোঁয়াতেই তার দম বন্ধ হয়ে আসবে মনে হয়। মনে হচ্ছে সে মারা যাবে। তার কাশি আসে, বুক ধড়ফড় করে, হাঁসফাস করে। দম ফাটা কাশির গমকে যেন প্রাণ বেরিয়ে যাবে। এখনই ধোঁয়া বন্ধ হওয়া দরকার। নইলে মরণ নির্ঘাত। ধোঁয়া বন্ধ হচ্ছে না, দম বন্ধ হচ্ছে।

শ্রীদাম মরণের জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। তার চোখের সামনে যোগচিহ্ন ভাসছে। যোগচিহ্নটাকে যিশুর মৃত্যুক্রুশের মতো মনে হয়। আচ্ছা যোগচিহ্ন তবে ক্রুশ। মৃত্যুর প্রতীক। যোগচিহ্ন মৃত্যুচিহ্ন।

আর এক যোগচিহ্ন উড়ন্ত পাখি। উড়ন্ত পাখির ডানা নেড়ে নেড়ে উড়ে যাওয়াকে দেখে মনে হয়, একটা যোগচিহ্ন উড়ে যাচ্ছে; সেই উড়ন্ত পাখির মাটিতে পড়া ছায়াকে দেখে আলাদা একটা জীব মনে হয়; ছায়াবিড়ালী। যেন একটা যোগচিহ্ন ধরা দেবে না বলে ইঁদুরের মতো, ছুচোর মতো, কাঠবিড়ালীর মতো দৌড়াদৌড়ি করছে মাটির ওপর, বালির ওপর ঘাসের ওপর। ঠিক এই মৃত্যুর সময় যোগচিহ্নের স্বরূপ চিনতে পারা গেল!

মৃত্যুর ভেতর ঢুকে যাওয়ার পথে পড়ে গেছে শ্রীদাম। ধোঁয়া এখনো থামেনি। তার একটু বাতাসের স্বাদ নেবার ইচ্ছে জাগে।

ধোঁয়া কি থামবে না?

ধোঁয়া না থামলে যোগচিহ্ন হতে আর বেশিসময় লাগবে না তার।

 [মৌলিক প্রশ্নের উত্তর কেউ দিতে পারে না; যার মনে মৌলিক প্রশ্ন জাগে তাকেই উত্তর বের করতে হয়]

ধোঁয়া থেমে গেছিল। মরেনি শ্রীদাম। কয়েকদিনের মধ্যে পায়ের সেই ক্ষত বেড়ে যায়। দৌড়ে দৌড়ে বাড়ছে যেন ক্ষত। তার পা দৌড়াতে পারছে না কিন্তু পায়ের ওপর ক্ষত বেশ দৌড় দিচ্ছে। ক্ষত বা ঘা বৃত্তবান। এর চলন বৃত্তীয়। শ্রীদামের ক্ষত বৃত্ত বড়ো করছে।

একজন লোককে দিয়ে দেলখাটাটোলার এক লোকাল ডাক্তারকে ডাকিয়ে আনে মাধবী।

শ্রীদামের পা দেখে ডাক্তার বলে— ‘পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে না ফেললে হবে না। খুব কঠিন ক্ষত এটা।’

শ্রীদাম বলে— ‘বাবু, আমি গরিব কাঙাল, পা কাটলে শহরে যেতে হবে। অনেক টাকার ব্যাপার। থাক বাবু, পা থাক। পা পচতে পচতে পেটে চলে আসুক, বুকে চলে আসুক...’

পা পচতে পচতে কি পেটে চলে আসতে পারবে?

পা হেঁটে হেঁটে চলে আসতে পারবে পেটে?

মনে মনে নিজের কথার ভুল ধরে, প্রশ্ন তৈরি করে। উত্তর তৈরি করে, পচতে পচতে পা তো পেটে আসতে পারবে না, বুকে আসতে পারবে না, দেহজ্যামিতিতে এ নিয়ম চলে না। পচতে পচতে পচন আসতে পারবে পেটে, বুকে।

সে তার কথাকে শুধরে নেয়— ‘থাক বাবু, পায়ের পচন ছড়িয়ে যাক সারা শরীরে।’

রেখা যে অসীম এটার প্রমাণ শুধু পচনই দিতে পারে, পচন ছড়িয়ে পড়ে তার অসীম প্যাঁচানো রেখা নিয়ে। ভগবান সরলরেখ সাপ তৈরি করে তাকে দিয়েছে বক্ররেখ চলন। ভগবান, ক্ষতের স্বভাবে, ঘায়ের স্বভাবে দিয়েছে বৃত্তীয় চলন।

দেহে সূঁচ ফুটে গেলে একটা বিন্দু তৈরি হয়, একবিন্দু ঘা। এই বিন্দুঘা বসে থাকে শুধু, নিজে নড়ে না, কিন্তু তার চারপাশ তার সাথে যুক্ত হয়ে বৃত্তীয়ভাবে বড়ো হতে থাকে, ধীরে ধীরে পুরো শরীরটা ঐ বিন্দুঘায়ের সাথে যোগ হয়ে যায়। পুরোশরীরটা একটা ঘা হয়ে যায়।

মাধবী দাঁড়িয়ে আছে উদ্বেগ নিয়ে। উদ্বেগের বেগ তার ভেতরকে অস্থির করে।

ডাক্তার বলে— ‘শহরে যেতে হবে না। আমি গ্রাম্য ডাক্তার হলে কী হবে? এগুলো অনেক করেছি। আমি শহরে একটা ক্লিনিকে কাজ করি বড়ো ডাক্তারের সহকারী হিসেবে। ডাক্তারি লাইনে লেখাপড়া না করলেও আমার শিক্ষা তো পাস করা ডাক্তারের কাছেই; একেবারে হাতেকলমে, ওষুধেমলমে। গ্রামে গ্রামান্তরে এমন কাজ কত করেছি। এসব এখন আমার কাছে ওয়ান-টুয়ের ব্যাপার।’

শ্রীদাম আবার বলে— ‘থাক বাবু। টাকা পাব কোথায়?’

এটা একটা প্রকৃত প্রশ্ন। প্রকৃত প্রশ্নের উত্তর, মৌলিক প্রশ্নের উত্তর জগতের অন্য কেউ দিতে পারে না, যার মনে জাগে তাকেই উত্তর করতে হয়। অবশ্য হতে পারে, একজনের মৌলিক প্রশ্ন আরেকজনের কাছে গৌণ প্রশ্নও নয়; প্রশ্নই নয়। ফলে ডাক্তার নিরুত্তর থাকে। এ প্রশ্নের উত্তর দেবার দায় তার নেই। তারা চুপচাপ থাকে। তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ আছে শুধু। মাধবী দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দীর্ঘশ্বাসের শব্দ সবসময়ই স্বাভাবিক শ্বাসের শব্দের চেয়ে ঘন, আঠালো আর উচ্চ।

মাধবীর দীর্ঘশ্বাসের উচ্চ শব্দে সজাগ হয়ে ডাক্তার মাধবীর দিকে তাকায়। এতক্ষণ মাধবীর উপস্থিতির প্রতি সে উদাসীন ছিল বা খেয়ালই করেনি।

ডাক্তার মাধবীর পায়ের দিকে তাকায়, সুন্দর পা, পায়ে কোনো নূপুর নেই।

ডাক্তারের দৃষ্টি ওপরে ওঠে। দৃষ্টি কোমরের কাছে থামে। কটিদেশের দুপাশে মাধবীর সুন্দর দুই হাত ঝুলছে, হাতে কোনো চুড় নেই, চুড়ি নেই।

ডাক্তারের চোখ ওপরে ওঠে। মাধবীর বয়স চৌদ্দ। ডাক্তারের দৃষ্টি চৌদ্দ বছরের কাছে গিয়ে থামে। চৌদ্দ বয়স সুন্দর। বুকের কাছে মালা বা লকেট ঝুলছে না।

ডাক্তারের দৃষ্টি ওপরে ওঠে, মোহন সোহন আর মায়ামাখা মাধবীর মুখ। মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ঠান্ডা ঘাম।

ডাক্তারের এমন দৃষ্টিপাতে মাধবী ব্রীড়িত। পীড়িত। সে সেখান থেকে যেতেও পারছে না, থাকতেও পারছে না। সে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকাটা থাকাও নয়, যাওয়াও নয় অবস্থার প্রতীক।

ডাক্তারের দৃষ্টি মাধবীর কানের কাছে গিয়ে থামে। খুব কম ওজনের দুটো স্বর্ণের দুল কর্ণে ঝুলছে। ডাক্তার বুঝতে পারে, ওজন কম হলেও এ কর্ণফুলের স্বর্ণ খাঁটি। মাধবীও ভুলে গেছিল এ সোনার দুলের কথা।

ডাক্তার বলল— ‘ঠিক আছে। আগামীকাল অস্ত্রোপচার হবে।’

[কাঁটা-কম্পাস। হাঁটা-কম্পাস। পেন্সিল-কম্পাস।]

পরদিন ভোরেই হাতুড়ে ডাক্তার তার সহকারীকে নিয়ে হাজির হয়। কাটা হয়ে গেল পা। পা কাটা হয়ে গেল। একটা পা কাটা—অর্ধেকটা। একটা পা গোটা। কাঁটা-কম্পাস শ্রীদাম পেন্সিল-কম্পাস হয়ে গেল। কাঁটা-কম্পাস পেন্সিল-কম্পাস হয়ে গেল।

ঘুমের ভেতর ডুবে আছে শ্রীদাম। ডাক্তাররা পা কাটা শেষে কাটা পা নিয়ে বেরিয়ে গেলে মাধবী বারান্দায় এসে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে থাকে। ওখান থেকে ঘুমন্ত বাপের দিকে নিস্তেজ চোখে তাকিয়ে থাকে। বাপের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে সেও ঘুমিয়ে পড়ে। বাপ-মেয়ের কাছে পৃথিবী মানে ক্ষুধা নিয়ে, অসুখ নিয়ে, অস্বস্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়া। ক্ষুধা নিয়ে, অসুখ নিয়ে, অস্বস্তি নিয়ে জেগে যাওয়া। শুশুকের মতো ঘুমজলে ডুবে আর ওঠে এরা।

[আত্মজীবনী নয় আত্মমরণী]

দুপুরেরও পর শ্রীদামের মৃদু ডাকে মাধবীর ঘুম ভাঙে। ঘুমলি চোখেই মাধবী বাপের দিকে তাকায়, বাপ কী বলছে শোনার চেষ্টা করে।

শ্রীদাম বলে— ‘মা রে, বড়ো ব্যথা রে মা! দেহজ্যামিতি নষ্ট হওয়া কী কম কথা মা? আমার দেহজ্যামিতি নষ্ট হয়ে গেল মা। দোপেয়ে মানুষ তো কাঁটা-কম্পাসের মতো। দোপেয়ে মানুষের এক পায়ের আধেকটা কাটা গেলে তো দেড়পেয়ে হয়ে যায়। আমি তো দেড়পেয়ে মানুষ হয়ে গেলাম গো মা। দেড়পেয়ে মানুষ পেন্সিল-কম্পাস গো মা। কাঁটা-কম্পাস যদি পেন্সিল-কম্পাস হয়ে যায় তো জ্যামিতির রীতি ঠিক থাকে না, নীতি ঠিক থাকে না, প্রীতি তো ঠিক থাকবেই না। আমার এ দেহজ্যামিতি নষ্ট হলো গো মা। বড়ো ব্যথা আমার।’

কী ব্যথার কথা বলল, কোন ব্যথার কথা বলল, শ্রীদামের বলার ধরণে ঘুমলি মাধবী বুঝতে না পারলেও ডাক্তারের রেখে যাওয়া ঔষুধ থেকে একটা ব্যথার ঔষধ নিয়ে এসে শ্রীদামকে দেয়— ‘হা করো বাবা।’

শ্রীদাম একটা ছোট্ট ঔষুধের জন্য এমন জোরে হা করে, এমন বড়ো হা করে যেন তাকে বড়োসড়ো একটা রসগোল্লা দেওয়া হচ্ছে; যেন বা পুরো পৃথিবীই তার মুখে ঢোকানো হচ্ছে।

ঔষধ খাইয়ে মাধবী আবার বারান্দায় গিয়ে বসে। ওষুধ খাওয়ার সাথে সাথে ওষুধ কাজ শুরু করতে পারে না, তবু রোগী একটু স্বস্তি পায়, ওষুধ খেতে পাবার স্বস্তি।

শ্রীদাম ভাবে, ছাপাখানায় কাজ না করে সে যদি কোনো ঔষধ কারখানায় কাজ করতো তবে ওষুধ কারখানার মালিককে পৃথিবীর মতো, কমলালেবুর মতো গোল গোল ওষুধ বানানোর জন্য বলত।

পৃথিবীর মতো গোল ওষুধের মানে, রোগীকে বোঝানো তোমাকে পৃথিবী দান করা হলো এ ওষুধের মাধ্যমে। আর পৃথিবীকে বোঝানো এ রোগীকে এখনই তুমি খেতে পাচ্ছ না আরো কিছুদিন তোমাকে খাবে সে। যদি সে ওষুধ কোম্পানির মালিককে বোঝাত তাহলে সেকি বুঝত না। নিশ্চয় বুঝতো যেমনভাবে বুঝেছিল, ছাপাখানাতে বই ছাপতে আসা সেই লেখক। লোকটা তার বইয়ের নাম রেখেছিল— ‘আত্মজীবনী’।

শ্রীদাম তাকে বলেছিল— ‘আপনি জন্মের পর থেকে এই মৃত্যুর দোরগোড়াতে আসতে আপনার সাথে যা যা ঘটেছে তাই তো লিখেছেন? তাহলে এর নাম আত্মজীবনী হয় কী করে? এর নাম হবে ‘আত্মমরণী’। কিভাবে আপনার আত্মা ধীরে ধীরে এঁচিয়েপ্যাঁচিয়ে মরণ পানে ধাবিত হলো এই তো কথা।’

লোকটা—লেখকটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল শ্রীদামের দিকে।

লেখক বলেছিল— ‘সত্য বলেছেন দাদা আপনি। এই বইয়ের নাম ‘আত্মমরণী’ রাখলাম আমি।’

খুব একটা ভেবে যে এসব কথা সে সেদিন বলেছিল তা কিন্তু নয় কিন্তু এখন শ্রীদামের মনে হয়, খুব ভালো একটা কিছুই বলেছিল সেদিন সে লোকটাকে। পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষ তাদের ‘আত্মমরণী’র নাম বা ‘মরণী’র নামকরণ ‘আত্মজীবনী’ বা ‘জীবনী’ করে ভুল করে চলে গেছে। এ ভুল চলতেই আছে।

ব্যথাতুর শ্রীদাম ভাবাবেশে, মনে মনে ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করা শুরু করে দিল, সে মনে মনে ঔষুধের ডিজাইন করা শুরু করে দিল। নানা আকার আকৃতির ঔষুধ; ডিম্বাকার ডিম্বাকৃতি; নিম্বাকার নিম্বাকৃতি। কখনো, আগের গোল চ্যাপ্টা ওষুধের ডিজাইনটা ঠিক রেখে চ্যাপ্টার চারধারে উপর কানা আরেকটু বাড়িয়ে দিয়ে থালিকা ডিজাইনের ঔষধ করে সে। এ ওষুধ খেলে রোগির মনে হবে আরো কিছুদিন সে বেঁচে থাকবে, আরো কিছুদিন থালা ভরা না হোক অন্তত থালিকা ভরা ভাত তরকারি খাবে। ভাত আকারের বা পিঠা আকারের ঔষধও বানাল। প্রচুর রকমের, প্রচুর পরিমাণে ঔষধ বানাচ্ছে। মনে মনে ঔষধের ডিজাইন করতে করতে, ঔষধ বানাতে বানাতে সে হাঁপিয়ে ওঠে তবু ঔষধ বানানোতে ক্ষান্তি দেয় না।

ওষুধ খাবার পর ব্যথা কমেছে অনেকটা। নিজের আত্মমরণীর কথা ভাবে। কাটা পায়ের দিকে তাকায়। কাটা পায়ের দিকে তাকিয়ে তার ছাত্রজীবনের একদিনকার কথা মনে পড়ে। একসাথেই এক প্রশ্নপত্রেই চারুকলা ও কারুকলার পরীক্ষা চলছে। কারুকর্মের জন্য স্যারেরা সবাইকে সাদা কাগজ, রং, আঠা, কাঠ, কাঠি, সুতা ইত্যাদি ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ইচ্ছেমত কিছু কারুশিল্প রচনা করো।

সাদা কাগজ কেটে ছিঁড়ে কেউ তৈরি করল নৌকা, কেউ জলজাহাজ, কেউ উড়োজাহাজ, কেউ মোটরগাড়ি। শ্রীদাম তৈরি করেছিল মানুষ, সম্পূর্ণ সুন্দর মানুষ।

এরপর শ্রীদাম শুরু করেছিল চারুশিল্পের কাজ। শ্রীদাম এবারও একটা মানুষ আঁকে। মানুষ আঁকে সে অনেক সময় নিয়ে। আঁকা শেষে দেখে একটা পা আঁকা তেমন ভালো হয়নি। সে ইরেজার দিয়ে পায়ের কিছু অংশ মুছে; আবার নতুন করে আঁকতে যাবে এমন সময় স্যার বললেন— ‘সময় শেষ, নিজেদের পেন্সিলের লাগাম ধরো যাতে আর নতুন কোনো রেখা বের না হয়। যদি আর একটা রেখাও বাড়াও ফেইল করবে। সবার খাতা নিয়ে নিলেন স্যার।’

আচ্ছা শিশুকালে ঐ অসম্পূর্ণ পায়ের আঁকা মানুষটা কে?

সে কি শিশুকালে তারই ছবি এঁকে নিয়েছিল?

তাহলে কারু পরীক্ষায় কাগজের যে সম্পূর্ণ আর সুন্দর, সুগঠিত আর পূর্ণ পায়ের মানুষটা তাহলে কে?

শ্রীদাম নিজেই?

শিশুকালেই নিজের বয়স্ককালের ছবি এঁকে ফেলেছিল?

শ্রীদাম নিজের শরীরের দিকে তাকায়, শরীরে কিছু নেই কেবল নিঃশ্বাস সম্বল করে বেঁচে আছে। শরীরের সৌন্দর্য সূর্য নেই, শক্তি সূর্য নেই। এমনিতেই কৃশ আর কর্কশ শরীর তার ওপর একটা পা কাটা গেছে; কাঁটা কম্পাস থেকে পেন্সিল-কম্পাস হয়ে গেছে। মানুষ তো কাঁটা-কম্পাস, হাঁটা-কম্পাস। মানুষ হাঁটোন্দাজ, দৌড়ন্দাজ। আর কখনোই সে কাঁটা-কম্পাস হতে পারবে না হাঁটা-কম্পাস হতে পারবে না।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঘরের চাল মেরামতের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চাচা-ভাতিজাসহ ৩ জনের মৃত্যু
ঘরের চাল মেরামতের সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্টে চাচা-ভাতিজাসহ ৩ জনের মৃত্যু
সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাইলেন জবির আন্দোলনকারীরা
সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত গাইলেন জবির আন্দোলনকারীরা
সময়টাকে লিখে যেতে চাই : কায়েস মাহমুদ
সময়টাকে লিখে যেতে চাই : কায়েস মাহমুদ
জাতীয় ঐকমত‍্য কমিশনের কাজের অগ্রগতি এখনও অস্পষ্ট: এবি পার্টি
জাতীয় ঐকমত‍্য কমিশনের কাজের অগ্রগতি এখনও অস্পষ্ট: এবি পার্টি
সর্বাধিক পঠিত
সাবেক সেনা সদস্যদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করছে সেনাবাহিনী, ধৈর্য ধরার পরামর্শ
সাবেক সেনা সদস্যদের আবেদন পুনর্বিবেচনা করছে সেনাবাহিনী, ধৈর্য ধরার পরামর্শ
‘পুলসিরাত’ ইসলামিক নাম, তাই পরিবর্তনের নির্দেশ
‘পুলসিরাত’ ইসলামিক নাম, তাই পরিবর্তনের নির্দেশ
পূজা উদযাপন পরিষদের দুই নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা
পূজা উদযাপন পরিষদের দুই নেতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা
অভিযান চালিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা ভাঙায় বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক
অভিযান চালিয়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা ভাঙায় বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক
উদীচীর জাতীয় সংগীত পরিবেশনের অনুষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর, আহত ৭
উদীচীর জাতীয় সংগীত পরিবেশনের অনুষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর, আহত ৭