[গর্ভের শিশু হয়ে থাকা।]
স্রোতের ধীর ধারা নদীর ধারে এসে পড়ছে শান্ত মেজাজে। নদীতে নামে আরতি। জলে পা পড়া মাত্র নরম মধুরতা আর আরাম অনুভব করতে থাকে সে। শরীর যেন একটা টকটকে লাল আগুনিয়া অঙ্গার, যতটুকু জলে নামছে ততটুকু থেকে আগুন নিভে যাচ্ছে; শান্তি লাগছে; সে খুব ধীরে ধীরে নামে; প্রতিটা লোমকূপ দিয়ে যাতে শান্তিতা মধুরতা আরামতা ভেতরে ঢুকতে পারে। আরতি ডুবজলে গিয়ে মাথার বেড়াবেণি খুলে ফেলে; লম্বা করে শ্বাস নিয়ে ডুব দেয়।
খোলাচুল কালো শ্যাওলার মতো ভাসছে। বহুক্ষণ ডুবে থাকে। যদি অনন্তকাল এভাবে থাকা যেত এই জলঘরের ভেতর, মায়ের গর্ভের মতো এই জলঘরের ভেতর; খুব ভালো হতো; এক্সরে প্লেটে যেমন দেখা যায় পেটের শিশুকে তেমন ভঙ্গি করে সে জলগর্ভে শিশু হয়ে যায়। গর্ভস্থ শিশু ভঙ্গিমায় নদী জলগর্ভে সে বহুক্ষণ থাকতে চায়, বহুবছর থাকতে চায়, মরণ পর্যন্ত থাকতে চায়। গর্ভের শিশু হয়ে থাকতে তার ভালো লাগছে।
বেশিক্ষণ দম থাকে না জলে ডুবে থাকার। সে জলের ভেতর থেকে মাথা বের করে। এককদম এগিয়ে ডুবজল থেকে গলাজলে আসে।
গলাজলে সে শাড়ির প্যাঁচ খুলে একটা একটা করে। একেবারে নগ্ন। পুরো নদীটায় শাড়ি এখন। আঃ কী আরাম। পুরো নদীটাকেই শাড়ির মতো জড়িয়ে যদি হেঁটে বেড়ানো যেত, শুয়ে থাকা যেত!
জলের ভেতর এভাবে ঢুকে থাকতে তার ভালো লাগছে। জলের ভেতর নগ্ন আরতি চোখ বন্ধ করে মগ্ন হয়ে জলের স্বাদ নিচ্ছে। জলে এভাবে ডুবে থাকার স্বাদ এর আগে কখনো অনুভব করেছে বলে তার মনে হয় না। সে একেবারে নিথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। পাথরের মূর্তির মতো। স্থির নদীর জল। পাথরমুরতি-আরতি। পাথরে আঁকা নদীর মতো নদী; তার ভেতর পাথরের মতো নিথর আরতি। স্থির। ঢেউ নেই। কেউ নেই কোনোখানে।
হঠাৎ করেই একটা পানকৌড়ি প্রায় তার গা ঘেঁষে জলের তলা থেকে উঠে আসে। তাতেই জলে সামান্য তোলপাড় তৈরি হয়। মুহূর্তেই আরতির মূর্তিত্ব ভেঙে যায়, আরতিত্ব ফিরে আসে। পানকৌড়ি ডুব দিয়ে চলে গেছে আবার। সে যেন আরতির ভেতর শুধু আরতিত্ব ফিরিয়ে দিতেই এসেছিল। তবু আরতি আবার মূর্তি হবার চেষ্টা করে। হয় না। শরীর একেবারে শীতল হয়ে গেছে। জলে ডুবে থাকতে আর ভালো লাগছে না। যে জলকে এতক্ষণ এতো ভালো লাগছিল সেই জলের মধ্যে আর একটুক্ষণও ভালো লাগছে না।
কিছুই কি বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে না মানুষ?
সবকিছুই কিছুক্ষণ সহ্য করতে পারে মাত্র?
আরতি ডুব দেয়। ডুব থেকে উঠে হাত পা বুক আর পিঠের যতদূরে হাত যায় সব জায়গাতে হাত বুলিয়ে পরিস্কার করে নেয়। কাপড়টাকে ভালো করে ধুয়ে নেয়। জলের ভেতরেই শাড়ি পেঁচিয়ে নেয়। শাড়ি আর শরীর কচলে কচলে এতো করে ধুয়েছে তবু তার গা থেকে কুকুরের রক্ত লাগা, মগজ লাগা, মাংস লাগা অনুভূতি যায় না। সে আরো ধোয়। শরীর একেবারে শীতল হয়ে গেছে জলের তলে থাকতে থাকতে আর থাকা যায় না।
ভেজা শাড়ি পরে সে পাড়ে উঠে। ভেজা শাড়ি পরে তার মনে হয় যেন নদীটাকেই পরে আছে। নদী আর পরে থাকতে চায় না সে। সে রোদের ভেতর গিয়ে দাঁড়ায়। শাড়িটা যদি একটু আগে শুকোয়।
আজকে কি তার জ্বর নামবে?
থেকে থেকে কেঁপে উঠছে কেন গা?
তার মনে হয়, ঐ কুকুরের মতো সেও কি ট্রাক-বাসে পিষে যেতে পারে না, মিশে যেতে পারে না কালো পথের সাথে? হঠাৎ করে পিষে যাবে, মিশে যাবে, যা সে নিজেও জানতে পারবে না। যেমনভাবে কুকুরটা বুঝতেই পারল না সে মরে গেছে। মরা কুকুরটা মরে গেছে বুঝতে না পেরে মনে মনে হয়তো এখনো দৌড়াতেই আছে, দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেছে। মনে মনে হোটেলের সামনে পড়ে থাকা ভাত খাচ্ছে বা মাড় চাটছে বা হাড়হাড্ডির টুকরো চিবুচ্ছে। আহা, এত দ্রুত কুকুরটাকে নিয়ে তার জীবনের আর মৃত্যুর হাতবদল হয়ে গেল যে, কুকুরটা বুঝতেই পারল না তার মৃত্যু। অমন একটা মৃত্যু হলে খুব ভালো হতো আরতির; এঁটোখেকো হয়ে আর বেঁচে থাকতে হতো না।
[মরা কুকুরের হেঁটে আসা।]
সূর্য পা পা করে পার হয়ে গেছে। সন্ধ্যাও পা পা করে পার হয়ে গেছে। রাতও পা পা করে এগুচ্ছে আরও রাতের গভীরে।.
সে ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন বিল্ডিংয়ের আস্তানায় ফিরে এসেছে। সারাদিন সে যেখানে সেখানে হেঁটে বেড়ায়, যেখানে সেখানে থেমে বেড়ায়, যেখানে সেখানে নেমে বেড়ায় কিন্তু দিনশেষে ঠিক এখানেই ফিরে আসে। এখানে সন্ধ্যা হতেই রাত শুরু হয়ে যায়। রাত আরো রাত হয়ে যায়।
কাপড় ঠিক মতো এখনো শুকায়নি, ভেজা ভেজা ভাব। সে কাপড় খুলে একেবারে নগ্ন হয়ে শুয়ে যায়। পুরো রাতটাই তার শাড়ি।
শরীর কাঁপিয়ে জ্বর নামে। কিছু গায়ে দিতে পারলে ভালো হতো, খুব শীত করছে। সে ঠান্ডায় কাঁপতে থাকে হিহি করে। সে জ্বরে কোঁকাতে থাকে। জ্বরের ভেতর ট্রাকে পিষে মরা কুকুরকে হেঁটে আসতে দেখে। রক্তাক্ত মগজ বের হওয়া মাথা চ্যাপটা কুকুর কীভাবে হেঁটে আসছে। তার হাসি পায় মরা-কুকুরের হেঁটে আসা দেখে। ও রে মরা কুকুর তুই তো মরে গেছিস তাহলে আর হাঁটছিস কেন?
কুকুর হেঁটে হেঁটে একেবারে কাছে চলে এসেছে। তার গা শুঁকতে শুরু করেছে। জোর জ্বরে শরীর অবসন্ন তার।
জ্বরের ঘোরে সে মরা কুকুরকে তাড়ায়— ‘যা, চলে যা মরার মরা-কুকুর। এখানে কী করতে এসেছিস। চলে যা।’
মরা-কুকুর শ্বাস ফেলে তার পায়ের ওপর, গায়ের ওপর। চটচট করে আরতির গা চাটে।
জ্বরের শরীরে আরতি জোর করে সরাবে তাও পারে না, মুখে বলতে থাকে— ‘যা মরার কুকুর, দূর হ, গা চাটছিস কেন? আমার গায়ে তোরই পিষে যাওয়া মাংস-মগজ-রক্ত, হাড়ের কুঁচি লেগে আছে। তোরই রক্ত-মাংস তুই-ই চেটে খাবি নাকি? যা ভাগ মরার কুকুর।’
মরা-কুকুর কথা বলে ওঠে, বিড়বিড় করে— ‘আমার বউ মেলাদিন হলো মরে গেছে... উপোসির মতো আছি গো রূপসি... কতদিন গতদিন হয়ে গেছে... মরা-কুকুর বলো না আমাকে... কুকুর বলো না আমাকে... আমাকে না করো না...’
কুকুর বিড়বিড় করে কথা বলতেই থাকে।
মরা-কুকুরের কথা শুনে আরতির কিছুটা ঘোর ভাঙে, সে দেখে, মরা-কুকুর নয় একটা বুড়া লোক খালি গায়ে তার কাছে বসে আছে, তার শুকনো আঙুল কাক-শকুনের পায়ের মতো, তার লোল মাংস-চামড়া ঝুলে আছে হাড়ের থেকে আলাদা হয়ে। দাঁত মনে হয় একটাও নেই, ঠোঁট কম্বলের মতো গোল হয়ে ঢুকে আছে মুখের ভেতর, ঢুকে যেতে চাচ্ছে আরো।
কাক শকুনের পায়ের মতো হাত দিয়ে তার বুক নাড়ছে, গাল নাড়ছে, ফোকলা মুখে চুমু দিচ্ছে। এই ঘাটের মড়ার বয়স পঁচাত্তর আশির নিচে হবে না। আরতি বিস্মিত হয়, এই দেশি আমড়ার মতো হাড় আর চামড়া সর্বস্ব বুড়ার স্বভাব দেখে। তার ঘৃণা হয়। আরতি জ্বরের দুর্বল শরীরে তাকে বাধা দিতে পারে না। বৃদ্ধ লোকটা জ্বরতপ্ত গায়ে আরতির দুবলা শরীরে উঠে পড়ে।
বৃদ্ধ হিসহিস করে সাপের মতো, ফিসফিস করে কী কী সব ভুল বকার মতো বকতে থাকে। স্নায়ুছেঁড়া শিশ্ন লতপত করছে; সেই লতপতে চেরাগের পলতের মতো শিশ্ন, শিশুর মতো শিশ্ন আরতির দেহে ঠেলে গুঁজে দেবার চেষ্টা করছে।
আরতির জ্বরাক্ত শরীর ভেঙে পড়তে থাকে। বহুচোখি আনারস, কুকুরের মূত্রমাখা আনারস আবর্জনার স্তূপ থেকে তাকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে।
ওরে আনারস, তোর অজস্র চোখ দিয়ে কী দেখছিস?
আর দেখিস নে রে আনারস। আনারস তুই কানারস হয়ে যা।
দাঁত পড়ে যাওয়া বৃদ্ধের চটচটে লালারসে আরতির মুখ ভর্তি হয়ে যায়, বুক ভর্তি হয়ে যায়। তার গা ঘিনঘিন করে।
মাধবী
[মরে গেছে মনে করে ঘুমিয়ে ছিলো। মরে গেছে মনে করে জেগে উঠে।]
মাধবীর জ্ঞান যখন ফিরলো তখনও সে বুঝতে পারেনি সে মরেনি। সে বুঝতে পারেনি তার ফাঁসিতে ঝুলে যাওয়া হয়নি। জ্ঞান ফিরেও জ্ঞান না ফিরার ঘোরের ভেতর আছে। মরে গেছে মনে করে ঘুমিয়ে ছিলো। মরে গেছে মনে করেই জেগে উঠেছে। মরে গেছে মনে করেই, এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখছে। দেখে নিতে চাচ্ছে মরণের পরের যমজগতে তৈরি করা ঘর, ঘরের আসবাবপত্র, চাদর বালিশের নকশা।
আরো বহুক্ষণ পর মাধবীর ঘুম আর ভাবনার চটকা কাটলে মনে পড়ল, সে যখন ঝুলে পড়তে যাচ্ছিল ঠিক সে সময়ে কয়েকজন তার ঘরে ঢুকে পড়েছিল হুড়মুড় করে; ফাঁসের হা করা মুখ থেকে তাকে ছিনিয়ে নেয় যেমন করে বাঘের হা করা মুখ থেকে শিকার কেড়ে নেয় বনকুকুর বা হায়েনার দল। ফাঁসের হা থেকে মাধবীকে টেনে এনে তারা তার মুখে প্রথমে রুমাল চেপে ধরে। রুমালটা এতো দারুণ গন্ধ ধরেছিলো যে তার মনে হচ্ছিলো এমন সুন্দর সুগন্ধ জগতে আর নেই। সে মনে করেছিল মনে হয় তার ফাঁসি কার্যকর হয়ে গেছে, যমদূতকে সরিয়ে বিষ্ণুদূত আর সহযোগীরা তাকে বরণ করতে এসেছে মরণফুলের সুগন্ধ নিয়ে। মরণের গন্ধ সুন্দর।
এবার তার মধ্যে সামান্য ধাতস্ততা ফিরে। যারা তাকে ফাঁসির মঞ্চ থেকে নামিয়েছিল তাদের মধ্যে একটা মুখকে চিনতে পেরেছিল, সে হচ্ছে রমজান ডাক্তারের মেজ ছেলে। অন্যগুলোকে চেনে না। তাদের কোনোদিন দেখেছে বলেও মনে হয় না।
তার সন্দেহ হয় তাহলে কি সে মরেনি?
সে মরে গেছে কি মরেনি এই সন্দেহের মীমাংসা করতে পারছে না। কোনো মানুষ কি কোনোদিন এমন জটিলতার ভেতর পড়েছে যে জটিলতাতে মানুষটা নিজেই বুঝতে পারে না সে মরেছে না মরেনি।
জটিলতা ছিঁড়ে সে বের হওয়ার চেষ্টা করে। মাধবী দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিন্নভিন্ন, ছড়ানো-ছিটানো মনকে কুড়িয়ে একজায়গাতে করার চেষ্টা করে যেমনভাবে টুকরো টুকরো মোম কুড়িয়ে গলিয়ে আবার একটা অখণ্ড মোম করা যায়। মনকে অখণ্ড করে মাধবী ঠাহর করার চেষ্টা করে, সে এখন কোথায় শুয়ে আছে। এটা তো তাদের ঘর নয়। বইতে পড়া বর্ণনা মতো এটা কোনো স্বর্গলোক বা নরকলোকের ঘরও নয়। স্বর্গলোকও নয় মর্গলোকও নয়। নরকলোক নয়। এটা নরলোকই; এটা নরলোকেরই ঘর।
তার ভেতর একটা আশার ঝিলিক খেলে যায়।
এটা কি জগন্নাথের ঘর?
জগন্নাথ তার বন্ধুদের সহায়তায় তাকে তুলে এনেছে?
রমজান ডাক্তারের ছেলের সাথে তার খুব ভাব?
সে মনে মনে একটু আরাম পায়। জগন্নাথের রুমাল ছাড়া কার রুমালে এমন সুগন্ধ থাকবে। রুমালটা যেন আস্ত এক ফুলের বাগান। মাধবী শুয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ভাবে। চোখ বন্ধ করে ভাবনা ভাবা সহজ হয়, চোখ বন্ধ করে ভাবনা ভাবলে ভাবনার গভীরে যাওয়া যায়। মানুষের ভাবনাবিশ্ব বিশাল এক বিশ্ব। এখানে জায়গার কোনো অভাব নেই। ভাবনাবনে ঘুরতে ভালো লাগে। চোখ খুলে ভাবনাতে খুব একটা সুবিধা হয় না।
মাধবী জগন্নাথের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। জগন্নাথের সাহস দেখে তার হৃদয় মৃদু তালে নাচছে।
তার প্রেম কি আবার শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে?
প্রেমের জ্ঞান ফিরেছে?
আগের সবকিছুকে চিনতে পারছে তাদের প্রেম?
সে হাসিহাসি মনে জগন্নাথের জন্য অপেক্ষা করে।
দরজার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছে, দরজা বাহির থেকে বন্ধ করা। হঠাৎ করেই তার ভাবনাবিশ্ব রং বদলে তার সামনে হাজির হয়। বুকটা ধক করে ওঠে, যদি জগন্নাথ না হয়, যদি অন্যকিছু হয়, যদি খুব খারাপ কিছু হয়। কী কী খারাপ আছে পৃথিবীতে; অনেক খারাপই তো সে চিনেছে কিন্তু সব খারাপ তো চিনে না; সব খারাপ তো সে জানে না। সে তার অবস্থা আর অবস্থানের কিছুই বুঝতে পারছে না। বন্ধ চোখ খুলে। শুধু রাত মানেই যে অন্ধকার এমন নয়, প্রকৃত অন্ধকার তো এটাই যেটাতে নিজের অবস্থা ও অবস্থান নিজেই জানে না। সে দুরুদুরু বুকে দারুণ খারাপ কিছুর মুখোমুখি নিজেকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে।
মাধবী বুঝতে পারে না নিজের হাসিহাসিমুখের পক্ষ নিয়ে বসে থাকবে না দুরুদুরু বুকের পক্ষ নিয়ে বসে থাকবে? সে হাসিহাসি মুখে জগন্নাথের জন্য অপেক্ষা করে। সে উজ্জ্বল মুখে দারুণ ভালো কিছুর বুকোবুকি হবার জন্য অপেক্ষা করে। সে দুরুদুরু বুকে দারুণ খারাপ কিছুর মুখোমুখি নিজেকে দেখার জন্য অপেক্ষা করে। ভিরুভিরু চোখে বারবার চমকে চমকে দরজার দিকে তাকায়।
[প্রখর আলোর ঝাপটা।]
খট করে প্রথমে দরজার শিকলি খোলার শব্দ হলো; দরজার পাল্লার বুক একটুমাত্র কেঁপে উঠল। এই শব্দেই ভিরুনী মাধবীর হৃৎপিণ্ড যেন ভেতরে বিস্ফোরিত হলো হিরোশিমা নাগাসাকিতে বিস্ফোরিত বোমার মতো। বিস্ফারিত চোখে চকিতে তাকাল দরজার দিকে। দরজা দুভাগ হয়নি এখনো। ফিসফাস করে বলা কথার বাষ্প আসছে শুধু পুরো কথা আসছে না।
দরজা খুলে গেল। হঠাৎ প্রখর আলোর ঝাপটায় তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল।
একজন চলে গেল তার মুখ দেখা গেল না। একজন প্রৌঢ়া ঢুকল; প্রৌঢ়তা তার শরীরের দৃঢ়তা কাড়তে পারেনি; বেশ শক্তপোক্ত আছে সে। কিন্তু জঘন্য ধরনের মোটা। তার হাতে খাবারের প্লেট। সে যেন ঈশ্বরের কেউ। মাধবী কী ভাবছে, তা বলে দিচ্ছে।
সে এসেই বললো— ‘তুই কী ভাবছিস জানি। তুই ভাবছিস, আমি এখন কোথায়?’
সে বললো— ‘জেনে নে, তুই এখন একটা বেশ্যাখানায়... ভদ্দরলোকেরা বলে পতিতালয়, গণিকালয়।’
সে বললো— জেনে নে, তুই এখন একজন হবু বেশ্যা... যেমন হবু বধু থাকে তেমন হবু বেশ্যা... কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ্যা হয়ে যাবি... বেশ্যাকে ভদ্দরলোকেরা বলে পতিতা, যৌনকর্মী। ভদ্দরলোকেরা আরো কী কী সব ভাষা বলে সব জেনে যাবি। অভদ্রলোকেরাও কী কী সব বলে জেনে যাবি।’
সে বললো— ‘আরো জেনে নে, তোকে আমার কাছে বিক্রি করা হয়েছে। তোকে কিনে নিয়েছি। পালানোর চেষ্টাও করবি নে। পালানোর লোভ করে লাভ হবে না। আমার লোকেরা চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে আর তোকে ধরে ফেলতে একটা বাল উপড়াতে যে সময় লাগে সে সময়ও লাগবে না। তবে চারপাঁচ বছর পর তোর ওপর আর এত কড়াকড়ি থাকবে না। ইচ্ছে করলে তখন চলে যেতে পারিস কিন্তু গিয়ে লাভ হবে না। কোথাও তোর ঠাঁই হবে না। বেশ্যাখানা ছাড়া কোথাও ঠাঁই নাই বেশ্যার।’
মাধবী হতবিহবল হয়ে তার কথা শুনছে। তার ভেতর হিরোশিমা নাগাসাকি। সে শ্বাসপ্রশ্বাস ফেলতে ভুলে গেছে। চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। সে তার নিজের মধ্যে আর পাথরের মধ্যে কোনো ফারাক খুঁজে পেল না।
[জীবিত থাকার হাত থেকে বাঁচতে চায়।]
প্রৌঢ়া চলে গেল। কিন্তু তার কথার বাজ এখনো ঝলক দিচ্ছে পুরো ঘরে, তার কথার ঝাঁজ এখনো পুরো ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাধবীর কান ঝাঁঝাঁ করছে। সবকিছুকে দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
তার সামনে খাবারের প্লেট। খাবার খাওয়ার জন্য একবার বলেওনি ঐ মহিলা। শুধু রেখে গেছে। তার ক্ষুধা পেয়েছে। খেতে হবে এটা ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে। ক্ষুধা লেগেছে এতেই তার ঘৃণা লাগছে। ভেতর থেকে সকলকিছুর প্রতি, এ জীবনের প্রতি, জনমের প্রতি ধিক্কার জন্মে গেছে। তার থুতু ফেলতে ইচ্ছে করে। থুতু কোথায় ফেলবে বুঝতে পারে না। মুখের ভেতরেই ধরে থাকে সে থুতু।
কোনো শব্দ করতেই তার ভয় হচ্ছে। কোনো শব্দ না করলেই যেন বেঁচে যাবে। সে এতটুকু নড়ে না, একবিন্দু শব্দ করে না। নড়ে না, শব্দ করে না বলেই পাথর হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকে। সে পাথর হতে চায়। পাথর জীবিত নয়। সে জীবিত থাকার হাত থেকে বাঁচতে চায়।
সে শব্দ করছে না। সে বেঁচে আছে। সে শব্দ করছে না কিন্তু তার ভেতরে শব্দের ঝড়তুফান, বাজ, ভূমিকম্প, জলকম্প, আকাশকম্প, বায়ুকম্প, স্নায়ুকম্প, আয়ুকম্প। কম্পে কম্পে তার দেহ শুকনো প্রতিমার মতো ঝরে ঝরে পড়বে যেন।
সে শব্দ করছে না, যেন একটু শব্দ করতে গেলেই, একটু নড়তে গেলেই তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে মৃত্যু বাদে জগতের সমস্ত দুর্যোগ, নৃশংসতা। সে শব্দ না করলে, নড়াচড়া না করলে সে যেমন আছে তেমনই থেকে যাবে, তেমন থাকতে থাকতেই মরে যাবে, মরে গেলেই সকল বিপদ থেকে উদ্ধার।
সে শব্দ করছে না কিন্তু দরজাতে শব্দ হলো। সে নড়ছে না কিন্তু দরজার পাল্লা আর ঝনকাঠ নড়ে উঠলো, ঝন করে শিকলি খুলে গেল।
সে শব্দ করছে না। কিন্তু সমস্ত জগৎ শব্দ করছে। সে শব্দ করছে না, নড়ছে না কিন্তু তার কোনো বাঁচন নেই।
প্রোঢ়া ঢুকলো; তার সাথে ষণ্ডামার্কা একটা লোক।
ঢুকেই— ‘কি রে এখনো গিলিসনি?’ প্রৌঢ়া বলে।
বলে— ‘দেখ, এসব করে কোনো লাভ হবে না। এই যে লোকটা এসেছে ভালোয় ভালোয় পায়জামার গিঁট খুলে দিবি, গায়জামার বোতাম খুলে দিবি, মাইজামার হুক খুলে দিবি। কোনো জোর যেন করতে না হয়। কোনো কান্নাকাটি চলবে না।’
লোকটা বললো— ‘সমস্যা নাই, যত জোরাজুরি করবে, যত ‘না না’ করবে তত বেশি মজা পাব আমি। নতুন মাল। কান্নাকাটি করলেও কোনো সমস্যা নাই। যত কান্নাকাটি করবে ততবেশি আমার ভালো লাগবে।’
প্রৌঢ়া মুচকি হেসে লোকটার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। লোকটা তাকে দেখছে। লোকটার রুক্ষ পর্যবেক্ষণ আর ভাব দেখে মাধবী কুঁকড়ে গেল।