X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

গৌতম গুহ রায়
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

পর্ব-৩


‘ছিন্ন পাতায় সাজাই তরণি’

১৯৪৭ এর দেশভাগের ক্ষতচিহ্ন ক্রমশ বাংলার শরীরে ফিকে হয়ে আসছে, আমার দেশে স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনে মুখরিত ‘অমৃত উৎসব’। সনাতন ধর্মীয় মিথ আখ্যানে সাগর মন্থন করে বিষ ও গরল উঠে আসার কাহিনীর গরলাংশ গলাধঃকরণ করে আমাদের এই স্বাধীনতা। ঔপনিবেশিক শক্তির উপহার আমাদের এই বাংলার বুকে দ্বিখণ্ডিত করা কাঁটাতারের ভেদরেখা দেশটাকেই দু-টুকরো করেই ক্ষান্ত হয়নি, দুই পারের অজস্র মানুষ ভিটাচ্যুত হয়ে যায়। এই দেশ হারানো, ভিটা হারানো মানুষদের জীবন যন্ত্রণার প্রকৃত আখ্যান বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির স্মৃতিতে আজও যুক্ত হয়নি। এখনো অনেক মানুষ বেঁচে আছে ওই মারণ-যজ্ঞের স্মৃতি নিয়ে, কালের গহ্বরে অধিকাংশই হারিয়ে গেছে। আমি তেমনই এক উদ্বাস্তু সন্তান, যে দেশভাগ দেখেনি কিন্তু বাবার বুকে বুক রেখে বড় হওয়া আমি সেই যন্ত্রণা প্রতিটি মুহূর্তে টের পেয়েছি, আজও অনুভব করি। আমার জীবনের কথাগুলো আসলে আজন্ম লালিত ক্ষতের আখ্যান।

দেশভাগের সেই কালোরাতের কিছুদিন আগে আমার বাবা ও তার দুই ভাই উত্তরবাংলায় চলে আসেন। পথে কিছুদিন নওগাঁয় থেকে অবশেষে জলপাইগুড়ি। বড় জ্যাঠা শেষ পর্যন্ত চেয়েছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষের ভিটায় থেকে যেতে। সেই দিনের বিক্রমপুর আজকের মুন্সিগঞ্জের মালখানগর ছিল আমাদের পূর্বপুরুষের বংশানুক্রমিক আবাস ভিটা। একদিন সেই বড় জ্যাঠামশাইকেও চলে আসতে হয় তার তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে। আমার জেঠিমার রান্নার হাত ছিল দুর্দান্ত। দেশের বাড়ি ছেড়ে আসার পর গোটা জীবন যে যাপন-যুদ্ধে রত থাকতে হয়েছিল তাকে, তাতে সেই  রসে-পদে রান্নার সুযোগ তাঁর কপালে আর জোটেনি। হাতের কাজ, ছবি আঁকায় জ্যাঠামশাই ছিলেন স্বশিক্ষিত শিল্পী। সেই জ্যাঠামশাইকে এপাড়ে এসে রংমিস্ত্রির কাজ নিতে হয়। জলপাইগুড়ি শহরের বনেদি বাড়ির রংচটা দেওয়ালের, পলেস্তারা খসে যাওয়া দেওয়ালের পুরোনো রং ঘষে ঘষে চটিয়ে দিয়ে তাতে আধুনিক কেমিক্যালের রঙের আস্তরণ টেনেই তাঁর বাকি জীবন কাটাতে হলো। দেশভাগের আগের তিন ও পরের দুই মোট পাঁচ সন্তানের প্রতিপালকের দায়িত্ব বাসায় রং মিস্তিরির কাজ করে খিদা মেটে না। অবধারিত দারিদ্র্য। অভুক্ত থাকা, ক্রমাগত ধূমপান, মূলত হাতে বাঁধা বিড়ি ছিল তাঁর একমাত্র নেশা ছিল।

আমাদের কলোনির বাসার পূর্বদিকের বাসায় দুই ভাই থাকতেন, তাদের বড়ভাই বিমল সরকার পেশা হিসাবে বেছে নেন বিড়ি বাঁধা। আমি স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখতাম পড়ন্ত রোদে পিঠ দিয়ে দুই মেয়ে ও স্বামী-স্ত্রী মিলে একসঙ্গে বসে বিড়ি বাঁধছেন। লাল নীল সুতোয় সাইজ করে কাটা এন্দু পাতায় তামাক মশলা ভরে সরু করে কাটা একটা বাঁশের কাঠি দিয়ে নিপুণ মুন্সিয়ানায় বিড়ির মুখ বাঁধতেন তারা। তারপর আগুনমুখী কয়লার উনুনে তেঁতে পেকে উঠতো সেই কাঁচা বিড়ি। অন্য এক ভাই কমল বাতাসা বানানো শুরু করেন। বাতাসা, তিলের খাজা বানিয়ে হাটে বাজারে বিক্রি করতেন। বড় কড়াইতে আঁখের গুড় জ্বাল দিলে তার গন্ধে ম ম করে উঠতো আশেপাশের গোটা এলাকা। তার ছেলে ছিল আমার বয়সী, মেয়ে আমার থেকে কয়েক বছরের বড়। সেই পিন্টুর সঙ্গে দিনভর আমাদের খেলাধুলা। পড়তে বসার আগে একবার পিন্টুদের বাড়ি হয়ে ফিরতাম বাসায়। সেই জ্বাল দেওয়া গুড়ের মাতাল করা গন্ধের টানে। জার্মান সিলভারের পাত্রে জ্বাল দেওয়া গুড় কালচে খয়েরি হয়ে উঠলে তা একটা লাঠি দিয়ে দ্রুততায় গোলানো হতো। এরপর বিছানো শীতল পাটিতে তা বিন্দু বিন্দু করে ছড়িয়ে দেওয়া হতো। গুড়ের বাতাসার রং গেরুয়া লাল আর চিনির বাতাসা শ্বেত শুভ্র। তিলের খাজা বানানো হতো কিছুটা ভিন্ন পদ্ধতিতে। গুড়ের জ্বালকে আরো ঘন করে তা কিছুটা ঠান্ডা করার পর লেইয়ের মতো বানিয়ে সরু করে টানা হতো। এরপর একটা তারের বা গুণাতে তা নির্দিষ্ট মাপে কেটে গামলায় ফেলা হতো যেখানে প্রস্তুত করা তিল রাখা ছিল। গায়ে তিল মেখে ক্রমশ সেজে উঠতো ‘তিলের খাজা’ সুন্দরী। দেখতে যেমন-  গরম গরম খেতেও তেমনি মজা ছিল সেই গোল গোল তিলের খাজার। মাঝে মাঝে আবদার করে ওই গুড়ের লেই কাটতে আমিও বসে যেতাম। বার্ষিক পরীক্ষার পর একদিন বেশ মজা পেয়ে অনেকক্ষণ ধরে পিন্টু ও আমি তিলের খাজার জন্য গুড়ের সেই লেই কাটছিলাম। খেয়াল ছিল না কখন রাত বেড়ে গেছে। মা হয়ত এক্ষুনি ডাকতে আসবেন, দ্রুত উঠে পড়লাম। পিন্টুদের শোয়ার ঘরের পাশ দিয়ে আমাদের বাসায় যাওয়ার একটা ‘শটকার্ট’ রাস্তা ছিল। সেদিক দিয়ে যেতে গিয়ে চোখ আটকে গেলো, পা নড়ছে না আর! পিন্টুর দিদি, সম্পূর্ণ উলঙ্গ। একটা গামছা কোমরের উপর ফেলে রেখেছে, হাত দুটো বুকের উপর, স্তনের উপর। আমার গলার ভেতর দলা পাকিয়ে উঠছে একটা গরম ফেনা। শরীরে আগুন আসার আগে যেন ঝড় এসেছে। সেই প্রথম এমন...। আমি আর দাঁড়াতে সাহস পাইনি। এক ছুটে বাসায় ফিরে আসি। আমার পায়ের শব্দ কি সে শুনতে পেয়েছিল? ভাবলেই বুকটা ধড়ফড় করে ওঠে। এরপর পিন্টুদের বাসায় গেলেও দিদির দিকে তাকাতে সাহস হয়নি কিছুদিন। এরপর এসেছিল ‘এক জ্যৈষ্ঠের দুপুর’-এর প্রবল গরম। 

সেই আমাদের সেই কলোনির বাসার পশ্চিম দিকে থাকতেন অনন্ত কাকুদের পরিবার, বেশ বড় পরিবার। তিন ভাই ও তাদের ছেলে-মেয়ে। তারা পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ছুতোরের কাজ। দেশের বাসায় যাদের পেশা ছিল কৃষিকাজ। দেশভাগ শুধু ভিটা ছিন্নই করেনি, পেশার চ্যুত,  শেকড় থেকে বিচ্যুত করে ভিন্ন পথে ঠেলে দিয়ে, ভিন্ন কাজ বেছে নিতে বাধ্য করেছিল অনন্ত জেঠু বা আমার জ্যাঠামশাইদের। আমার জেঠামশাই, মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় আড্ডা দিতে বেরুতেন। একদিন সন্ধ্যায় দেখি আমাদের পাশের বাড়িতে বিমল সরকারের বাসায়, সেই বিড়ি বাঁধানোর কাজ করতে থাকা পরিবারের চারজনের মধ্যে তিনিও বসে আছেন। দ্রুততায় বিড়ি বাঁধছেন। আমি বস্তুত পালিয়ে আসে একবুক কান্না নিয়ে। বাবারা পাঁচ ভাই। মধ্যের একভাই দেশ ভাগের পর হঠাৎ জ্বরে মারা যান, আমি তাঁকে দেখিনি। বাবারা বলতেন সেই জ্যাঠামশাই কথা বলতে পারতেন না, কিন্তু খুব ভালো ভায়োলিন বাজাতেন। আমাদের বাসার সামনে কিছুটা ফাঁকা জমি ও তার গায়ে লাগা কিছুটা জঙ্গল ছিল।  সবাই একে বলতো বুড়োর বাগান। সেই জমিটাই ছিল আমাদের কলোনিপ্রন্তের ছালেছোকরাদের ইডেন উদ্যান। বিকাল থেক আলো থাকা পর্যন্ত আমাদের ফুটবল খেলা। তারপর সেই ডোবায় স্নান করে বাসায় ফেরা। একদিন ওই ডোবার জলে গোটা শরীর ভেজা হয়ে বাসায় ফিরে দেখি সবাই চাপা স্বরে কথা বলছে, কানাঘুষো, যেনো একে অন্যের কথা শুনতে না পায়। প্রত্যেকেরই চোখের আড়ালে জল আটকে আছে। আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে? মা বললেন তোমাকে জানতে হবে না, যাও গা মুছে আসো। জানি না কেনো আমার সর্বাঙ্গের জল কেমন শীতল হয়ে এলো। ঠকঠক করে ভেতরটা কাঁপতে লাগল। বাবা মায়ের কথোপকথনে কান লাগিয়ে জানতে পারলাম জ্যাঠামশাইয়ের কাশিতে রক্ত পড়ছে। ডাক্তার বলেছেন টিবি, খুব বেশি ছড়িয়েছে সেই বুকের ক্ষয়। এরপর তাঁকে জলপাইগুড়ি শহর সংলগ্ন টিবি রুগীদের হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। হাসপাতালের নামটি সুন্দর, রানি অশ্রুমতী যক্ষ্মা সেবা কেন্দ্র। আমাদের, ছোটদের সেখানে যাওয়া নিষেধ। প্রায় তিন মাস পড়ে জ্যাঠা বাসায় ফিরে এলেন। ডাক্তার জানিয়েছেন সাবধানে থাকলে আর কোনো ভয় নেই। আমার ঠাকুরমা তখনো বেঁচে ছিলেন। সেই জ্যাঠামশাই এরপর গোপনে বিড়ি খেতেন, ধোঁয়া ও গন্ধে ‘সেই বার্তা রাষ্ট্র হতে’ দেরি লাগতো না। এরপর জেঠীমার চেঁচামেচি, ছোটকাকুর চেঁচামেচির সামনে অসহায় সেই দীর্ঘ দেহ মানুষটা, যে একসময় ছবি আঁকতেন, স্বপ্নও হয়ত দেখতেন। যক্ষ্মা নয় আমার বড় জ্যাঠা মারা গেলেন ক্যান্সারে। জীবনের প্রতিটি ক্ষতের জীবাণু হয়ত ভোল পালটে একদিন কর্কটক্রান্তিতে টেনে ফেলে দিলো তাঁকে। ফুসফুস থেক সেই ক্ষত প্রকাশ্যে চলে এলো। আমাদের সেই ঘরে যাওয়া নিষিদ্ধ হলো। জেঠিমা খাওয়া দিয়ে আসতেন। ক্রমশ রক্তবমি, এবং একদিন অন্তিম ডাক তাকে নিয়ে গেলো, যেভাবে হাজার হাজার উদ্বাস্তু বঙ্গবাসীকে রক্তবমি করে মরতে মরতে যেতে হয়েছে, মুক্তির নতুন দেশ তাদের মরণের দেশ হয়ে উঠেছিল।

চলবে

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভিজিএফের চাল না পাওয়া উপকারভোগীদের মানববন্ধনে হামলা
ভিজিএফের চাল না পাওয়া উপকারভোগীদের মানববন্ধনে হামলা
রাফাহ শহরে নতুন করে  ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
রাফাহ শহরে নতুন করে ইসরায়েলি হামলায় ১৩ ফিলিস্তিনি নিহত
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৯ এপ্রিল, ২০২৪)
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ আজ
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ