অফিস শেষে বৃষ্টিতে আটকা পড়লাম। বসন্তের প্রথম বৃষ্টি, আজ ফাল্গুনেই! খাঁচাবন্দি পাখির মতো ছটফট করছিলাম, হঠাৎ তার সাথে চোখাচোখি। উপমা রায়, অনার্সে পড়াকালীন এলাকার কোচিংয়ে ওদের ম্যাথ পড়াতাম। যদিও বেশিদিন থাকিনি, অথরিটি বেতন নিয়ে গড়িমসি করত।
সেকালের অনেক কথাই আজ বিশেষ মনে নেই, তবে উপমাকে কেন জানি ভুলতে পারিনি। বেশ চঞ্চল ছিল, তবে বেশ মনোযোগী।
দীর্ঘ বারো বছর পর আজ হঠাৎ তার মুখোমুখি। আঁটোসাঁটো চোখ, ঈষৎ শ্যাম বর্ণ আর কোঁকড়া চুলগুলোর জন্য চিনতে অসুবিধা হয়নি।
সেসময় বারো তেরো বছর বয়সী এক কিশোরীকে অন্যভাবে দেখার মতো পাপ আমি অবশ্যই করিনি। তবে আজ কেন জানি পরিস্থিতি ভিন্ন, নিজের অনুভূতি পরখ করেই তা আন্দাজ করতে পারছিলাম।
"প্রণবদা না? চিনতে পারছেন? স্কুলে আমাদের কোচিংয়ে অঙ্ক পড়াতেন।"
"হ্যাঁ, ইয়ে…"
"আমি উপমা। ক্লাস সিক্স, সিদ্ধেশ্বরী গার্লস।"
"ওহ ইয়েস! মনে পড়েছে। তুমি কি রায়হানদের ব্যাচে ছিলে?"
সবকিছু মনে থাকা সত্ত্বেও তা প্রকাশ করলাম না। এত বছর পর দেখা, তাও আবার কর্মস্থলে। কিনা কী ভেবে বসে!
"জি। আমি তো অনার্স শেষে আপনাদের এখানে ইন্টার্নি করেছি ছয় মাস। আজ আমাদের নতুন পজিশনে জয়েনিং ছিল।"
"কংগ্রাচুলেশনস! এজন্যই হেড ব্রাঞ্চে আসা?"
"হ্যাঁ। আপনি…"
"আমি এক্সিকিউটিভ প্ল্যানার হিসেবে আছি এখানে।"
"আরে, সেইম ডিপার্টমেন্ট দেখি। আমি তো নতুন জুনিয়র প্ল্যানার।"
"বেস্ট অফ লাক! সামনের সময় কিন্তু সুবিধার না, আগেই সাবধান করে দিচ্ছি।"
সময় আক্ষরিক অর্থেই সুবিধার ছিল না। বাইরে বৃষ্টি তো থামার নাম নেই, সাথে আরো দমকা হাওয়া। ফেব্রুয়ারিতে এত ঝড় শেষ কবে দেখেছি মনে করতে পারছি না।
"আপনি তো ছাতা আনেননি। আমার সাথে আছে। আপনি এখন কোথায় থাকেন?"
"কাজীপাড়া।"
"তারমানে মেট্রোতে যাবেন?"
"হ্যাঁ।"
"চলেন, আপনাকে স্টেশন পর্যন্ত দিয়ে আসি।"
আজই এক ছাতার নীচে ঝড় পাড়ি দিতে হবে? ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে কিছুটা তাজ্জব না হয়ে পারলাম না।
"ইয়ে, আসলে সমস্যা নাই। তুমি আজকের মতো যাও বাসায়, স্টেশন তো এই কাছেই। আমি বৃষ্টি থামলেই দৌড় দিব।"
"আরে সমস্যা নাই। আপনাকে এতো দৌড়টোর দিতে হবে না। আমার বাসা শ্যামলীতেই। রিকশায় চলে যেতে পারব।"
আমি বেশ ইতস্তত বোধ করলাম। বাইরে ঝড়ের তাণ্ডব যেন ডাকছে, চলে এসো। অবগাহন করো এক অজানা গন্তব্যে, চিরচেনা এই হৃদয় মাঝে।
আমি আর উপমা বেরিয়ে পড়লাম। প্রচণ্ড বাতাসেও ছাতাটা শক্ত করে ধরে আছে।
"এতোদিন পরে দেখা আপনার সাথে। বেশ ভালো লাগছে।"
"আমারও!"
"আপনি পড়ানো ছেড়ে দেওয়ার পরেও আমরা আপনাকে নিয়ে কথা বলতাম। আপনি অনেক ফানি ছিলেন।"
উপমা বেশ আনন্দ নিয়ে স্মৃতিচারণ করছিল, আমি শুনছিলাম।
"বাকি সবাই তোমার মতো বড় হয়ে গেছে, ভাবতেই অবাক লাগে।"
"সেটাই তো দেখছি। স্টুডেন্ট থেকে কলিগ!"
দুজনেই হাসলাম। বাউন্ডুলে মন বলতে চাইল, কলিগ থেকেও কিন্তু আরো অনেক কিছু হওয়া সম্ভব। নিজেকে নিবৃত্ত করলাম, ত্রিশের কোঠায় এসে এমন চপলতা মানায় না, প্রণব।
ধরে আসা বৃষ্টির বিশালাকার ফোঁটাগুলো রাস্তায় সশব্দে ঝরে পড়ছে। আমি স্টেশনের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে উপমার রিকশার দিকে তাকিয়ে রইলাম। না ভিজতে চাওয়া মানুষগুলো, সাময়িক আশ্রয়স্থল ছেড়ে ফের যে যার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ছে।
ভিজেছি বেশ। ক্লান্ত শরীরে ঝিমুনি আসে, স্বপ্ন দেখা প্রয়োজন—সেথায় নিজেকে প্রশ্ন করব, এই যান্ত্রিক শহরে, এমন করেও সন্ধ্যা নামে?