X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

শহীদ কাদরীর সঙ্গে, মধ্যরাতের আলাপনে

পিয়াস মজিদ
০৯ মে ২০২১, ১০:৪১আপডেট : ০৯ মে ২০২১, ১০:৪১

এখন প্রায়শই মধ্যরাত যখন মৃত্যুর বার্তাবহ হয়ে ওঠে তখন মনে পড়ে শহীদ কাদরীর কথা। প্রিয় এই কবি মার্কিন মুল্লুক থেকে প্রায়শই ফোন করতেন বাংলাদেশ সময় ঠিক মধ্যরাতে। ঘুমভাঙা কণ্ঠে তাঁর জাগরণ-ঘোর কথাবার্তা শান্তি দিত, অস্বস্তি দিত।
শান্তি ছিল শিল্প নিয়ে নিবিড় ভাবনারেখা আর অস্বস্তি দিত আমাদের যাপনের ভেতরকার শিল্প-সংযোগহীনতা তাঁর আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়াতে। বাংলা একাডেমির এক দাপ্তরিক প্রয়োজনে ২০১২ -১৩ নাগাদ তাঁর সঙ্গে টেলি-আলাপনের সূত্রপাত।
'আমি শহীদ বলছি, শহীদ কাদরী'; শুনেই তাঁরই কবিতাসূত্রে মনে পড়ে গিয়েছিল শহীদ কাদরী তো বাড়ি নেই; তাহলে কোথা থেকে বলছেন তিনি!
পৃথিবীর অনিকেত প্রান্তরে ছিল তাঁর বসবাস, যদি-বা বেঁচে থাকার প্রয়োজনে কোথাও ঠাঁই গাড়তে হয়েছিল। তাঁর কবিতাই তো নিক্তিকৃত পটভূমির চুরমার। স্ত্রী নীরা কাদরী প্রায়শই পাশ থেকে বলতেন, 'ছেলেটা ঘুমোবে। এখন কি ওকে না জ্বালালে নয়!'
রাগত নাকি অভিমানী উত্তর ছিল তাঁর, 'আধুনিক বাংলা কবিতা লিখবে সে। রাত ৩টায় ঘুমোলে হবে?'
তারপর শুরু হতো মধ্যরাতের অশ্বারোহী হয়ে গত শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকে সবান্ধব রাত্রিকে শাসন করার গল্পগাছা। শামসুর রাহমানের কথাই বলতেন বেশি। আসতো আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হকের কথাও। একবার তাঁর পরিকল্পিত এক কবিতাসংকলনের জন্য হাসান হাফিজুর রহমান ও বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতাবই চেয়ে পাঠালেন। দিলামও ঢাকা থেকে আমেরিকাগামী একজনের কাছে। পেয়ে ও পড়ে জানালেন, 'ওদের প্রতি অবিচার করেছি আগে। কবিতার নিজস্ব পথ ও গন্তব্য আছে ওদের।'
শুনে যেতাম তাঁর দূরদেশ থেকে ভেসে আসা ঝরনাভাষা; বলতেন―কবিতা লিখতে হলে মানুষের অন্তর-অবস্থা এবং বিশ্বরহস্যের আদি-অন্ত জানতে হবে। বিজ্ঞান, দর্শন, মনস্তত্ত্বের বইপত্রের নাম বলতেন এন্তার। সে তালিকায় মহাশূন্য থেকে নৈরাজ্যবাদবিষয়ক ভুবনখ্যাত বইয়ের নামও বাদ যেত না।
কথাশিল্পী রশীদ করীম যে তাঁর আত্মীয় তা জানা ছিল না। আলাপনে শোনা হতো, আবু রুশদ-রশীদ করীম ভাতৃযুগলের কলকাতা-পর্ব, পার্ক সার্কাসের মুসলিম জনজীবন, মাহমুদুল হকের কথাগদ্য নিয়ে মুগ্ধতার বয়ান। শেষদিকে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে কথাবার্তাও লতিয়ে উঠত তাঁর সংলাপ-বৃক্ষে। তাঁকে উপজীব্য করে লেখা হুমায়ূনের 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' লেখাটার কথাও আসত কখনও; যেমন এসেছিল আবদুল মান্নান সৈয়দের 'ঈশ্বর গুপ্ত থেকে শহীদ কাদরী' বইটার শিরোনামের প্রসঙ্গ। জীবদ্দশায় এমন একটা বইয়ের নাম দেখে যাওয়াকে উপভোগ করতেন তিনি। 'মান্নানের পক্ষেই এটা সম্ভব' বলে ষাটের দশকের কবিতাকাননে ঢুকে মতামত জানতে চাইতেন বিশেষত মান্নান সৈয়দ ও রফিক আজাদ সম্পর্কে। রফিক আজাদের বাংলা একাডেমির চাকরি ছাড়া ও জীবনের অনিশ্চয়তা নিয়ে দুঃখ করতেন আবার এও মানতেন অনিশ্চিতিই তো কবির অনিবার্য বিধিলিপি। আমি স্মরণ করিয়ে দিতাম চাকরি হয়ে যাওয়ার দুঃখে বহু আগে লেখা তাঁর কবিতার কথা। কবিতাটি ছিল না তাঁর কোনো বইয়ে বা সংগ্রহে। আমি কোনো উৎস থেকে ব্যক্তিগত ডায়েরিতে টুকে রাখা 'মত্ত দাদুরী ডাকে' কবিতাটি তাঁরই অনুরোধে অতঃপর মধ্যরাতকে সাক্ষী রেখে পাঠ করে শোনাতে থাকি :

'বিদায়! অস্তগোধূলি, সূর্য, রাশি, জলতরঙ্গ, রেশম, গম, তিসি। শীতরাতের উষ্ণ লাল আভার উনুন, শীতসন্ধ্যার পার্কের বেঞ্চ, হাওয়ার পাতার মর্মর!
বিদায়! মধ্যরাতের দীর্ঘ রাস্তা, উঁচু স্তম্ভের আলো, শস্তা রেস্তোরাঁর ম্লান টেবিল, কান্নার করাত, বৃষ্টি, শিলা!
বিদায়! ঝড়ের রাত, গণিকাপল্লীর আলো, কর্কশ গলার গান, বিদায়! বঙ্গোপসাগর, হাঙর, কুমির, জলোচ্ছ্বাস, মহিলার পৃষ্ঠদেশ, নিতম্ব, শাদা হাত, বিদায় ঘড়ির গান, বাতাসে পর্দার নাচ, কৌচে অলস বিকেল, রাঙা মাটির লাল ধুলো, বিদায়, বিদায়!
যা কিছু ঘৃণা করি, বিদায়! যা কিছু আক্রোশে ভরে দিত, বিদায়! যা কিছু ভালোবাসি, বিদায়!
বিদায়, রাঙা বৌ, বিদায়, বিদায়!'

কবিতাপাঠ শেষে মুঠোফোনের মহাদেশ-প্রান্তে আমাদের দুজনের হাস্যতুফান; হাসতে হাসতে উভয়ের অভিজ্ঞান 'সম্ভবত, চাকরি হওয়ার দুঃখে লেখা বিশুদ্ধ চাকরির অভাবশীল পৃথিবীর বিরলতম কবিতা এটি।'

মান্নান সৈয়দের 'চারিত্র' কিংবা 'শিল্পতরু' সাহিত্যপত্রে নজরুলের কবিতা নিয়ে বুদ্ধদেব বসুর আহতকর মন্তব্যকে খণ্ডন করে 'প্রতিভাবান বালক!' নামে ছেট্ট একটি প্রবন্ধও লিখেছিলেন আবার শেষপর্যন্ত তাঁকে আমার বুদ্ধদেব বসুর ভাবনার বাতায়নী একজনই মনে হয়েছে। 'শার্ল বোদলেয়ার : তাঁর কবিতা'-র বিমুগ্ধ গ্রহীতা কলকাতার কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে বুদ্ধদেব বসু ও মীনাক্ষী দত্ত অনূদিত বরিস পাস্তারনাকের 'ডাক্তার জিভাগো' চেয়ে পাঠিয়েছেন। বলেছেন, বুদ্ধদেবের শব্দব্রহ্ম-সাধনা রীতিমতো শিক্ষাযোগ্য যদিও তাঁর নিজের কবিতা ভাষাশোভা বজায় রেখেও ছিল এক একটি ভাবনার ভাস্কর্য।
ইচ্ছে ছিল, একটি লিখিত সাক্ষাৎকার নেব। রাজি হলেন, প্রশ্নও পাঠালাম। তবে বোকা আমি, প্রথম প্রশ্নেই তাঁদের প্রজন্মের কবিদের পশ্চিমা-মুগ্ধতা নিয়ে কারও কারও তর্কমূলক পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। উষ্মাটা আমার ওপর ঝেড়ে সেই 'কারও কারও' উদ্দেশে বললেন, 'জীবনে ও যাপনে পশ্চিমা-প্রভাব দূর করে তবে কবিদের ভাবনার এলাকা থেকে তাকে নির্বাসনের সময় এসেছে। অহেতু গুঞ্জন করে লাভ নেই কোনো।'
যুবা-তরুণদের নতুন কবিতাভাষা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন খুব। একরাতে হঠাই জিজ্ঞাসিলেন 'তোমার সঙ্গে কি মারজুক রাসেল বা আলফ্রেড খোকনের দেখা হয় কখনও, কী লিখছে আজকাল ওরা?'
নিজে একুশে পদক পেয়েছিলেন। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত পাওয়ার আগ পর্যন্ত স্বগতোক্তি করতেন 'জ্যোতি যোগ্য একজন। কেন যে দিচ্ছে না ওকে?' জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সূত্রেই তাঁর গল্পক্রমে যুক্ত হতো হায়াৎ মামুদ-জ্যোতি আর লিটলম্যাগ 'কালবেলা'-র কথা। কালবেলায় রূপদক্ষ কবি তো ছিলেন তিনি।
জীবন-উপান্তে এসে লিখতেন যা কিছু, তারই বাধা বরাদ্দপ্রাপ্ত ছিলেন 'কালি ও কলম'-এরও প্রয়াত সম্পাদক আবুল হাসনাত। 'আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দিও' বা 'গোধূলির গান'-এর কিছু কবিতা পড়ে এখনও ভালো লাগে এই ভেবে যে, দীর্ঘদিন পর কলম-সক্রিয় হয়েছিল অনুরাগীদের অনুরোধে। নয়তো 'শহীদ কাদরীর কবিতা' নামে সাহিত্যপ্রকাশের সেই মিথিক্যাল কালেকশন নিয়েই তুষ্ট থাকতে হতো আমাদের।
অন্যদের লেখা বিষয়ে তাঁর 'উন্নাসিক মনোভাব' এর অভিযোগ যে স্রেফ একটা অপবাদই তা টের পেয়েছি আমার 'কুয়াশা ক্যাফে' (অন্যপ্রকাশ, ২০১৫) কবিতাবইয়ের পাণ্ডুলিপি পাঠান্তে মেইলে পাঠানো ভূমিকামতন এমন মিত-পরিসর মহার্ঘ্য-কথনে :

'সাম্প্রতিক কালের তরুণতম কবি পিয়াস মজিদের উন্মেষ ঘটেছে শূন্য দশকে। তাঁর রচনার প্রেক্ষাপটে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন দেশের উল্লাস, গণহত্যা তথা লক্ষ লক্ষ শহিদের আর্তনাদ এবং মূল্যবোধহীন এক নতুন ধনাঢ্য শ্রেণির আধিপত্যমূলক প্রতিষ্ঠা। আধুনিক অথবা উত্তর-আধুনিক, যাই বলি না কেন, গত দেড়'শ কি দু'শ বছরের প্রধান লেখক-কবিদের গভীরতম উপলব্ধি হচ্ছে পারক্যবোধ বা এলিয়েনেশন। তরুণতম কবি পিয়াস মজিদের কবিতার ক্ষেত্রে রয়েছে এই পারক্যবোধ অর্থাৎ এক অসেতুসম্ভব নিঃসঙ্গতায় আচ্ছন্ন তাঁর রচনাবলি। পরিণামে, তাঁর চিত্রকল্পগুলি অতি সহজেই প্রতীকী তাৎপর্য লাভ করেছে। এই কবির শব্দচয়ন সুকুমার, কোমল ও পেলব। ইতিমধ্যেই এই প্রতিশ্রুতিশীল কবির একটি পরাবাস্তব-ছোঁয়া নিজস্ব কাব্যশৈলী তৈরি হয়ে গেছে।'

এক সকালে ফোন এল তাঁর। তখনই এখলাসউদ্দিন আহমদের মরদেহ এসে পৌঁছুলো একাডেমি প্রাঙ্গণে। বিয়োগবার্তাটা আমিই দিলাম তাঁকে। মুহূর্তেই তাঁর মনে এল, চট্টগ্রাম-পর্ব, 'বইঘর', এসএম শফি, 'উত্তরাধিকার' বইটির অনুষঙ্গ এবং এসবকিছুতে এখলাসউদ্দিন আহমদের সুগভীর সংযোগ।

আমেরিকা আসার আমন্ত্রণ তো জানিয়েই রেখেছিলেন। এও বলা ছিল তাঁর তরফ থেকে 'আমার এখানে থাকবে।'
হায়, আমারও যাওয়া হলো না, দেখা হলো না জীবিত কবির সঙ্গ যিনি আমার মধ্যরাতের তন্দ্রাহরক ছিলেন। আমেরিকা-ফেরত প্রিয় বাঙালি কবির সঙ্গে প্রথমবার মুখোমুখি দেখা হলো শহীদ মিনারে, কফিন-খোলা শেষবেলার শোকার্ত কফিনে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’