X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২
ঈদসংখ্যা ২০২৩

একজন টনি মিয়া এবং তার খিচুড়ি

ধ্রুপদী রিপন
১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:০০আপডেট : ১৪ এপ্রিল ২০২৩, ১৫:০০

এক.
“জীবন তো ওখানেও থেমে থাকতে পারত...ঘন অন্ধকারে, যেখানে কোনো আলো ছিল না; জানা ছিল না আজ বাদে কাল কী অপেক্ষা করছে জীবনের প্রতিটি বাঁকে...অথচ এখন...!”—কথাগুলো ভাবতে ভাবতে রিসোর্টের ব্যালকনিতে বসে ওয়াইনের পেয়ালায় আবারও চুমুক দেয় টনি মিয়া; কী যেন ভেবে আনমনেই শরীর দুলিয়ে নিশ্বাসের শব্দের সঙ্গে মুচকি হাসে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দের সঙ্গে পেয়ালার ওয়াইন যেন একই সুরে কথা বলে যায় হৃদয়ের গহিনে।

টনি মিয়া ভাবে; তার ফেলে আসা স্মৃতিগুলো সিনেমার রিল হয়ে যেন ফ্লাশ-কাটের মতো করে মনস্তত্ত্বে ধরা দিয়ে যায়। টনি মিয়ার ভাবনাগুলো ক্রমাগত শাখা-প্রশাখা বিস্তার করলেও ওয়াইনের পেয়ালায় চুমুক দেয়ার কথা ভোলাতে পারে না। ওয়াইনের পেয়ালায় চুমুক দিতেই হঠাৎ পায়ের আওয়াজ শোনে টনি মিয়া। পায়ের আওয়াজ নিকটে আসতেই ঘাড় ঘুরিয়ে নোটিশ করে। উপস্থিত ব্যক্তি আর কেউ নয়, টনি মিয়ার সহকারী মগবুল। উপস্থিত হয়েই মগবুল অনুগত সহকারীর মতো অভিব্যক্তি প্রকাশ করে, স্যার, অতিথিদের আসতে আরও ঘণ্টাদেড়েক সময় লাগবে। মগবুলের কথা শুনে টনি মিয়া মুখের মাংসপেশি সংকুচিত করে, ভাবুক ভঙ্গিমায় মাথা দোলায় যেন এটি হবারই ছিল। এরপর গলা খাঁকারি দিয়ে গলা পরিষ্কার করে টনি মিয়া, অপলক দৃষ্টিতে মগবুলের দিকে তাকায়। টনি মিয়ার দৃষ্টি যেন অবলীলায় তাকে রাগি মানুষের সার্টিফিকেট দিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, টনি মিয়া আসলে একজন বিনয়ী প্রকৃতির মানুষ। কোন এক বুজুর্গ জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, ‘এদেশে বিনয়কে মানুষ দুর্বলতা ভাবে এবং রাগকে ভাবে ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ’—একথা জানার পর থেকেই টনি মিয়া নিজেকে একজন রাগি মানুষ হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত করেছে; শুধু তাই নয়, রাগ তার কাছে এখন একটি শিল্পও বটে। আর এজন্যই ব্যক্তি ভেদে রাগ প্রকাশের ক্ষেত্রে রাগের গুণ ও পরিমাণের প্রতি টনি মিয়া অনেক যত্নশীল। তার এই যত্নশীলতার প্রমাণ মেলে তার আচরণে, টনি মিয়ার দাবি অনুসারে, সে কখনোই ঝিকে মেরে বউকে শেখায় না!

টনি মিয়ার অপলক চাহনিতে মগবুল অনেক ইতস্তত বোধ করে, টনি মিয়ার চাহনি যেন বারংবার বলে চলে, হালার পোলা—দোষ তোর...দোষ তোর...দোষ তোর...। এ বুঝি প্রকৃতির অলিখিত নিয়ম, জগতের যাবতীয় দোষ ঘাড়ে নেবার দায়িত্ব কেবল অধীনস্তদের!

মগবুল কাচুমাচু করে কথা বলে, স্যা-র...বাইরে প্রচুর বৃষ্টি...এছাড়া রাষ্ট্রপতি মহোদয় আগের প্রোগ্রামটি যথাসময়ে শেষ করতে পারেননি...বিধায়....

মগবুলের কথা শেষ হতেই টনি মিয়া গম্ভীর স্বরে আনমনে বলে চলে, হুমম...এর মানে...জীবনে এখনও অনেক কিছু করা বাকি!

—কেন স্যার?

—আমার দাওয়াতের দিনেও গেস্টদের সিডিউলে অন্য প্রোগ্রাম থাকছে...হটএভার, যাও একটি টুল নিয়ে আসো...বসে গল্প করি—দেড় ঘণ্টা তো কাটাতে হবে।

টনি মিয়ার প্রস্তাবে মগবুল যেন আকাশ থেকে পড়ে। জীবনে এমন সৌভাগ্যের সময় আসবে সে চিন্তা মগবুল কল্পনাও করেনি। মগবুল দ্রুত একটি টুল নিয়ে এসে টনি মিয়ার পাশে বসে। মগবুল বসতেই টনি মিয়া বাঁকা চোখে বিড়বিড় করে মগবুলের দিকে তাকায়। মগবুল অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়ায়, একটু বসতে গিয়েও বসতে পারে না। মগবুলের এরূপ সিদ্ধান্তহীনতা দেখে টনি মিয়া ঠোঁট টিপে টিপে হাসে, বসো...এত সংকোচ করতে হবে না। গল্প কিংবা আড্ডায় উপস্থিত সকলকে সম্পৃক্ত থাকতে হয়—এছাড়া আড্ডা বা গল্প জমে না।

টনি মিয়ার কথার পর মগবুল নড়েচড়ে বসে, কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে যায়। টনি মিয়া বিষয়টি নোটিশ করে। পেয়ালায় আরও একপ্যাক ওয়াইন ঢেলে চুমুক দেয় টনি মিয়া, বললাম তো সংকোচ করার দরকার নেই...যা মন চায় বলে ফেলো...তবে হ্যাঁ, সীমার মধ্যে থেকো...সীমা লঙ্ঘনকারীকে সৃষ্টিকর্তাও পছন্দ করে না...

—জি স্যার।

—তাহলে বলো কী বলতে চাও...?

—স্যার আমি অনেক দিন থেকেই...

মগবুলকে থামিয়ে দিয়ে টনি মিয়া বলতে থাকে, হ্যাঁ আমি জানি...তুমি অনেক দিন থেকেই কিছু একটা বলতে চাচ্ছ, কিন্তু সেটা কী...?

—স্যার, আমার খুব জানার ইচ্ছা...

—কী?

—স্যার...পৃথিবীতে এত প্রফেশন থাকতে আপনি কেন এই প্রফেশনে আসলেন?

মগবুলের কথা শুনে টনি মিয়া অবাক হয়, বলে, অবাক কাণ্ড—এক বছর যাবৎ আমার অ্যাসিস্ট করছ...আর তুমি এটা জানোই না! পত্রিকা কিংবা অনলাইন পোর্টালের নিউজগুলো পড়োনি?

—পড়েছি স্যার।

—জানা বিষয়ে জানার জন্য প্রশ্ন করে মূর্খ না হয় অতিচালাক; তুমি কোন গোত্রের?

—স্যার আমি দুই গোত্রের একটিতেও তো পড়ি না!

—মানে কী? আরও কোনো গোত্র আছে নাকি?

—জি স্যার, আছে।

—কী গোত্র বলো তো।

—স্যার, ভেরিফাইড গোত্র।

—এটা আবার কী!

—স্যার, আমি বা আমরা আপাতদৃষ্টিতে যা জানি, তা সঠিক কি না সে তথ্যগুলো উৎসর কাছ থেকে যাচাই করা। কেননা মানুষ বিখ্যাত হয়ে গেলে বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে কম কথা বলে।

—তুমি কি বলতে চাচ্ছ পত্রিকায় আমি মিথ্যে বলেছি...

—না স্যার, তা কেন হবে।

—তাহলে?

—স্যার, বিখ্যাত মানুষেরা শুরুতেই সব সত্য প্রকাশ করেন না, অনেক সত্যই রেখে দেন জীবনী লেখার প্রয়োজনে।

—ভালো বলেছ।...তোমাকে যতটা নির্বোধ ভেবেছিলাম, তুমি আসলে ততটা নও।

টনি মিয়ার কথা শুনে মগবুল মিটমিট করে হাসে। টনি মিয়া বলতে থাকে, জগতে আসলে প্রেডিকশনাল ভুলগুলোই বেশি হয়, এরপরেও মানুষ প্রেডিকশন করে—কেন বলো তো?

—সিদ্ধান্তহীনতা থেকে।

—ওরে পাগল, শুধু সিদ্ধান্তহীনতা থেকে নয়; প্রেডিকশন হলো অনুমান, মানুষ প্রেডিকশন করে আবিষ্কারের নেশায়, অজানাকে জানার জন্য। এবার বলো যা বলছিলে...

—স্যার ঐ তো...আপনি এই প্রফেশনে আসলেন কীভাবে?

মগবুলের কথা শুনে টনি মিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, ঢুকে যায় তন্দ্রার ভিতর, হ্যাঁ...প্রফেশন...

টনি মিয়া কথা শুরু করার পর মগবুলও যেন কোনো এক অজানা ঘোরে ডুব দেয়। টনি মিয়া বলতে থাকে, হ্যাঁ...প্রফেশন...আসলে...কুকিং কখনোই আমার প্যাশন ছিল না...পত্রিকায় ভুল বলেছি। আমার প্যাশন তো ছবি আঁকা...ভালো ছবি আঁকতাম...যদিও এখন আর আঁকা হয় না।...চারুকলায় পড়েও তো শিল্পী হতে পারিনি, এখন আর ছবি এঁকে কী হবে!...অবশ্য এর অন্যতম দায় পরিবারের...ধর্মীয় বেড়াজালে থেকে আসলে শিল্পী হওয়া যায় না...আর আমিও পরিবার ছাড়তে চাইনি।...তো কী আর করার হয়ে গেলাম রাঁধুনি।

একথা বলেই টনি মিয়া একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চুপ হয়ে যায়। ভারী পরিবেশে কারও মুখে কোনো কথা নেই। অনেকক্ষণ নীরবতা চলে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি, রিসোর্টের ব্যালকনিতে বসে ওয়াইনের পেয়ালা হাতে একজন জগৎ বিখ্যাত রাঁধুনি, সঙ্গে তার সহকারী, চলে আবেগতাড়িত স্মৃতিচারণ।

 

কিছু সময় পর ওয়াইনে চুমুক দিয়ে নীরবতা ভাঙে টনি মিয়া, মগবুল...

—জি স্যার...

—এবার তুমি বলো, কেমিস্ট্রিতে পড়ে তোমার রাঁধুনি হবার ইচ্ছা হলো কেন?

—স্যার আপনাকে দেখে...

মগবুলের কথা শুনে টনি মিয়া মুচকি হেসে বলে, এইসব অবান্তর কথা না বললেও পারো...

—না স্যার অবান্তর নয়...ঘটনা সত্য। আপনার প্রতিযোগিতার প্রতিটি এপিসোড আমি দেখেছি...

—গুড।

—দেখার পর আমার মনে হয়েছে...এই ট্র্যাকে ফিউচার আছে...

—হা হা হা...তার মানে তোমারও এইটা প্যাশন নয়...

টনি মিয়ার কথা শুনে মগবুল কিঞ্চিৎ লজ্জা পায়, স্যার, আপনিই তো বলেন, সাবকন্টিনেন্টে প্যাশনের কোনো মূল্য নেই...

—আসলেই নেই...তুমি দেখো—যে ছেলে বা মেয়েটা ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি পড়ে বিজ্ঞানী হতে চায়, সে হচ্ছে ব্যাংকার। আবার দেখো বুয়েট কিংবা মেডিকেলের ছেলে-মেয়েরাও পুলিশ কিংবা অ্যাডমিন ক্যাডার হওয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে  ছুটছে...সুতরাং এখানে প্যাশনের চেয়ে ফাকস্থানের দিকে মানুষ বেশি ছোটে...ও হ্যাঁ, ফাকস্থান কিন্তু শূন্যস্থান—এটা কিন্তু এফ ইউ সি কে স্থান নয়...

—হা হা হা...তা বুঝেছি স্যার...

—আরও কিছু জানতে চাওয়ার থাকলে বলতে পারো...

সুযোগ পেয়ে মগবুলের আগ্রহ বেড়ে যায়। মগবুল আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে, স্যার রান্না সুস্বাদু হওয়ার বিষয়টা যদি একটু বলতেন।

—তুমি তো অনেক সিরিয়াস মানুষ দেখছি...আমি তো ভেবেছিলাম তুমি রসিকতায় মজে যাবা...

—স্যার, আমাদের জীবনে তো রসের কোনো কমতি নেই...আমরা এক-দুজন একসঙ্গে হলেই অবান্তর সব গল্পের ডালা খুলে বসি, রসিয়ে রসিয়ে গল্প করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেই...বাইডেন-পুতিন সকালে নাশতা করেছে কি না—এ নিয়েও আমরা দুই-তিন ঘণ্টা গল্প করি...অথচ আমাদের প্রয়োজনের গল্পগুলো আমরা কখনোই করি না।

—বাহ্, ভালো বলেছ তো।...তাহলে কি আমরা বিনোদনের মাঝেও প্রয়োজন খুঁজব...?

—স্যার বিনোদন তো নিজেই একটি প্রয়োজন, এর বাইরে আমরা শুধু ধরনগুলো আলাদা করতে পারি...

—সে যাই হোক, তোমার প্রশ্নটা যেন কী ছিল?

—স্যার...রান্না সুস্বাদু হওয়ার বিষয়টা...

—হুম,

হুম শব্দ করেই টনি মিয়া হাই তুলে শরীর টানা দেয়। এরপর ক্রমাগত যেন তন্দ্রায় হারিয়ে যায় টনি মিয়া। টনি মিয়ার সে তন্দ্রা ওয়াইনের ইফেক্ট কি না তা বোঝা যায় না। কিছু সময় ঝিম মেরে থেকে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে টনি মিয়া, এরপর আনমনেই বলে চলে নিজের অভিব্যক্তি, রান্না সুস্বাদু হবার বিষয়টি শুধু এলিমেন্টগুলোর নিখুঁত পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না—ইটস অলসো ডিপেন অন কুকারস ফিল।

—স্যার হাউ?

—তোমার মনে রাখা জরুরি যে রান্না শুধু একটি কাজ নয়; এটি একটি শিল্প। তোমাকে সব বিষয়ের টেস্ট জানতে হবে, শুধু জানলেই হবে না, টেস্টগুলো ভালোভাবে বুঝতেও হবে, শুধু তাই নয়, টেস্টগুলোর পরিমাণগত ভেরিয়েশনাল পার্থক্য এবং মিথস্ক্রিয়াগত পার্থক্য জানতে-বুঝতেও হবে...আগে এটুকুই জানো-বোঝো...বাকিটা অন্য দিন...

—স্যার...?

—হুমম...

—এক্ষেত্রেও জানা এবং বোঝা কি আলাদা?

—হুম...তোমাকে একটা মজার ইনফরমেশন দেই...আমি যখন ‘পৃথিবীর সেরা রাঁধুনি’ পুরস্কারটি পাই, আমি তখনও রান্নাটা বুঝতাম না—কিন্তু জানতাম। এখন আমি রান্নাটা বুঝি।

—স্যার, এ দুয়ের পার্থক্য আপনার কাছে কেমন মনে হয়?

—হিউজ পার্থক্য। তখন রান্নাটা বুঝলে আমি কম্পিটিশনে যেতাম না।

—কেন স্যার?

—কোনো কিছুতে বুঝদার মানুষের জন্য পুরস্কারের প্রয়োজন হয় না; বুঝদার মানুষেরা কম্পিটিশনে জড়ায় না।

টনি মিয়ার কথা শুনে মগবুল দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ায়, আনমনে ভাবে, আমার তাহলে রান্নাটা আপাতত না বুঝলেও চলবে...

—কী ভাবছ আনমনে?

—না স্যার, তেমন কিছুই নয়।

—তেমন কিছু তো বটেই...মগবুল, রান্নাটা আপাতত না বুঝলেও চলবে নাহ্...বুঝতে হবে...

টনি মিয়ার কথা শুনে মগবুল অবাক হয়ে যায়। তার কাছে বিষয়টি কেমন যেন আধ্যাত্মিকতার গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। মগবুল অবাক হয়ে টনি মিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। টনি মিয়া মগবুলের দিকে খেয়াল করে না, গলা বাড়িয়ে ব্যালকনিতে বৃষ্টি দেখে, ঘন বৃষ্টির চাদর ভেদ করে টনি মিয়ার দৃষ্টি আকাশ দেখতে চায়, কিন্তু ঘন বৃষ্টির চাদর ভেদ করে তা সম্ভব হয় না। টনি মিয়া মগবুলের দিকে না তাকিয়েই ভারী গলায় বলে ওঠে, ওভাবে তাকিয়ো না মগবুল—নজর লেগে যাবে।

টনি মিয়ার কথা শুনে মগবুলের অবাক হবার পরিমাণ বাড়ে, সেই সঙ্গে বাড়ে তার ঘোরের পরিমাণ, স্যার, হাউ?

টনি মিয়া এবারও মগবুলের দিকে তাকায় না। মৃদু হেসে উত্তর দেয়, দ্যাটস কল সেন্সেবিলিটি...ইউ হ্যাব টু অ্যাচিভ দ্যাট।

মগবুল তড়িঘড়ি করে নড়েচড়ে বসে, মাথা ঝাঁকিয়ে ঘোর কাটায়। টনি মিয়া মগবুলের দিকে না তাকিয়ে আনমনেই বলে চলে, আজব মানুষ তুমি মগবুল...পৃথিবীর সব মানুষ ঘোরে ঢুকতে চায়, আর তুমি একজন—ঘোর কাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছ!

টনি মিয়ার কথা শুনে মগবুল তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায়, স্যার আমি এখন যাই...

যাই বলেই মগবুল দ্রুত চলে যায়। মগবুল চলে গেলেও টনি মিয়া ফিরে তাকায় না, আকাশ দেখার বাহানায় সশব্দে হাসতে থাকে।

দুই.
বাইরে বৃষ্টি কমতে শুরু করেছে। তবে এখনও থামেনি। টনি মিয়া ব্যালকনিতে বসে বৃষ্টি দেখে আর চুমুক দেয় ওয়াইনে। টনি মিয়া যেন ক্রমাগত হারিয়ে যায় ভাবনার সমুদ্রে। যেখানে তার পীড়াদায়ক অতীতও আজ আনন্দের খোরাক জোগায়। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে একাধিক কণ্ঠের উপস্থিতি টনি মিয়ার কানে এসে ধরা দেয়। টনি মিয়া কান পাতে কণ্ঠের পরিচয় জানার আশায়। কিন্তু কোনো কণ্ঠই তার কাছে পরিচিত মনে হয় না। আগ্রহ বাড়ে টনি মিয়ার। এক-দু পা করে অগ্রসর হতে থাকে রান্না ঘরের দিকে। রান্নাঘরের নিকটবর্তী হতেই টনি মিয়া থমকে দাঁড়ায়, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরগুলো মানুষের মতো শোনা গেলেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে সে কণ্ঠস্বরগুলো কোনোভাবেই মানুষের নয়। টনি মিয়া গন্তব্য পরিবর্তন করে, এক-দু পা করে খুব সাবধানে রান্নাঘরের জানালার দিকে অগ্রসর হয়। জানালার কাছে গিয়ে খুব সাবধানে উঁকি দেয় টনি মিয়া। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে টনি মিয়া যা দেখে, তাতে তার নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হয়। টনি মিয়া দেখে রান্নাঘরের ভিতর বড় পাত্রে রাখা খিচুড়ির প্রত্যেকটি উপাদান মানুষের ন্যায় অস্তিত্ব ধারণ করে পরস্পরের সঙ্গে ঝগড়া করছে। নিজের হাত দিয়ে চোখ পরিষ্কার করে টনি মিয়া। টনি মিয়া চোখ পরিষ্কার করলেও রান্নাঘরের ভেতরের দৃশ্যপটের কোনো পরিবর্তন হয় না। টনি মিয়া দেখতে থাকে রান্নাঘরের ভিতরে ঘটে চলা ঘটনা প্রবাহ। রান্নাঘরের ভিতরে বড় পাত্রের বেষ্টনীতে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজ চিৎকার দিয়ে ওঠে, এই থামো। পেঁয়াজের চিৎকারে সবাই চুপ হয়ে যায়। পেঁয়াজ বলতে থাকে, এমনে চিল্লায়া গুরুত্ব বোঝান যায় না। এই খিচুড়ির প্রধান উপাদান আমি। আমারে না হলে খিচুড়ি কিন্তু খাওয়ার উপযোগী হতো না। আমি খাদ্যে স্বাদ তৈরি করি বিধায় মানুষ ইন্ডিয়া-তুরস্ক-চায়না কিংবা ফ্রান্স থেকে হইলেও আমারে নিয়া আসে, খায়। শুধু এই খিচুড়ি না, খাদ্যের প্রধান উপাদান আমি।

পেঁয়াজের কথা শুনে মরিচ ভেংচি কাটে, এহ্ আইছে বাল ফেলা...মানুষ মনে হয় খালি ওনারেই খায়—ভাত-মাছ কিছু খায় না। মরিচের কথা শুনে পেঁয়াজ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। মরিচের পাশে থাকা রসুন হাসতে হাসতে মরিচকে থামিয়ে দেয়, এ তুই থাম। এরপর পেঁয়াজকে বলতে বলে, এ তুই বল।

পেঁয়াজ আবার বলতে থাকে, আমার গুরুত্ব কেন বেশি তা কথায় নয় কাজে প্রমাণ দেই। আমি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ; উন্মুক্ত র‌্যাডিকেলের বিরুদ্ধে কাজ করে মানুষের কোষের স্বাস্থ্য ভালো রাখি। আমার মধ্যে কুয়ারসেটিন নামক যে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে তা হৃদযন্ত্রের কার্যকারিতা ভালো রাখে, রক্তের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। শুধু তাই নয়, আমার মধ্যে আছে সালফার যৌগ এবং ফ্লাভানয়েড অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা মানুষকে ক্যান্সার থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করে।

পেঁয়াজের কথা শেষ হতেই মরিচ আবার বিড়বিড় করে বলে, হ ডিসপেনসারিতে যাওয়ার দরকার নাই, খালি তোরে খাইলেই হবে, আইছে হালার পোলা!

মরিচের কথাটি পেঁয়াজ নোটিশ করে, একটু থামে, কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে আবার বলা শুরু করে, অমলেট, সালাদ কী সুপ—আমার ব্যবহার যত্রতত্র। মানুষের সর্দি-কাশিতেও আমার উপকারিতা অপরিসীম। ও আর একটা কথা তো বলতেই ভুলে গেছি, আমার ভেতরে থাকা কোয়ারসেটিন নামক উপাদান মানুষকে ঘামাচি থেকেও রক্ষা করে।

পেঁয়াজ কথা শেষ করেই সগর্বে মরিচকে বলার জন্য আহ্বান জানায়, খুব তো ফটফটালি...এবার ক...

পেঁয়াজের কথা শুনে মরিচ গরম নিশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করে, ভাইলোক...সমাজে কিছু মূর্খ আছে যারা জানে না যে তারা মূর্খ।

পেঁয়াজকে উদ্দেশ্য করে মরিচের এরূপ কথায় উপস্থিত সবার মধ্যে হাসির রোল পড়ে। মরিচ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলা শুরু করে, ভাইলোক...সৃষ্টিকর্তা যদি মূর্খদের কথা কানে তুলতেন তাহলে হয়তো এই পৃথিবীতে আমাদের জন্মই হতো না। আপসোস...সৃষ্টিকর্তা মূর্খদের কথা কানে তোলেননি, তাই আমরা সগর্বে পৃথিবীতে জন্মেছি। ভাইলোক আমি মরিচ, আমাকে আপনারা সবাই চেনেন-জানেন। এরপরেও কতিপয় মূর্খের জন্য আজকে আমাকে নিজের ঢোল নিজেকেই পেটাতে হচ্ছে। যাইহোক ভাইলোক, যদি স্বাদের কথা বলতেই হয় তবে কিন্তু তা আমাকে বাদ দিয়ে নয়। মানুষ খিচুড়ি খায় মূলত দুটি কারণে। এক, পুষ্টিগুণের জন্য, আর দুই হলো টেস্ট ভেরিয়েশনের প্রয়োজনে। প্রথমে টেস্টের বিষয়ে আসি। ভাইলোক, একবার ভাবুন তো, খিচুড়িতে আমাকে অংশগ্রহণ করতে দেয়া হলো না—তাহলে পরিস্থিতি কেমন হবে? আমি নিশ্চিত যে আপনারা অলরেডি বুঝে গেছেন, খিচুড়ি আর খিচুড়ি থাকবে না, ওটা হবে পানসে খাবার। আর যদি পুষ্টিগুণের কথায় আসি, তবে ভাইলোক কান খুলে শুনুন, আমার ভেতরে আছে ভিটামিন এ এবং সি। মূর্খরা কি জানে ভিটামিন এ এবং সি জিনিসটা কী? আমার মনে হয় তারা জানে না। তাই তাদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ভিটামিন এ চোখের দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। এছাড়া হাড়, দাঁত এবং কিউমাস ঝিল্লি শক্ত করে। আর ভিটামিন সি স্কার্ভি রোগ সারায় এবং যাবতীয় চর্ম রোগের জন্য উপকারী। ভাইলোক, আপনারা জেনে খুশি হবেন যে, আমার ভেতরে আছে ক্যাপসাইসিন, যা নাকে রক্ত প্রবাহ সুগম করে, সর্দি-কাশি এবং সাইনাসের জটিলতা সারাতে ক্যাপসাইসিন খুব উপকারী। শুধু তাই নয় ভাইলোক, আমার ভেতরে আছে বেটা-ক্যারোটিন নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা হৃদযন্ত্রের জন্য অত্যন্ত উপকারী। ভাইলোক, এ কথা অনস্বীকার্য যে এই যান্ত্রিক সভ্যতার যুগে মানুষের ডিপ্রেশন ক্রমবর্ধমানহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মানুষের ডিপ্রেশন দূর করার জন্য আমার ভেতরে আছে এন্ডোরফিনস, যা মন ভালো রাখার জন্য এনজাইম বৃদ্ধি করে। ভাইলোক, আমার গুণের কথা বলে শেষ করা যাবে না, আমি ডায়েটারি ফাইবারে পরিপূর্ণ, তাই মানুষের খাদ্য হজমে সহায়তা করি। এছাড়া আমার ভেতরে আছে খাদ্য শক্তি শর্করা, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং ম্যাঙ্গানিজসহ নাম না জানা হাজারও উপাদান। সুতরাং আমার গুরুত্ব কত তা সহজেই কিন্তু অনুমেয়।

মরিচের কথার পর রসুন দাঁড়িয়ে আদাকে অহ্বান করে কথা বলার জন্য। মরিচের আহ্বানের পর আদা উঠে দাঁড়ায়, গম্ভীর স্বরে বলা শুরু করে নিজের কথা, এখানে কি আর কথা বলার মতো অবস্থা আছে! একটি গুণ বর্ণনার সভাকে সাবকন্টিনেন্টের রাজনৈতিক মঞ্চ বানালে তো আর কথা বলার মতো অবস্থা থাকে না।

আদার কথা শুনে পেঁয়াজকে বেজায় খুশি দেখায়। সে মিটমিট করে হাসে। কিন্তু কথা শেষে আদার নীরবতা দেখে সে বিচলিত হয়। তবে পেঁয়াজও কোনো কথা বলে না। আদার নীরবতা দেখে রসুন এবং লবণ সমবেত কণ্ঠে বলে ওঠে, আদা ভাই বলেন...অভিমান করে কী করবেন; আমরা আমরাই তো।

আদা বলা শুরু করে, ঝামেলা তো ওখানেই রে ভাই—ঝামেলা আসলে আমরা-আমরাই হয়। দূরের কেউ তো ঝামেলা করে না—ঝামেলা বাধায়। সে যাইহোক, সম্মানিত উপস্থিতি, আমি আদা। এই খিচুড়িতে আমি যে প্রধান—আমি তা বলব না। তবে এই খিচুড়িতে আমি অনিবার্য। আমাকে ছাড়া এই খিচুড়ি আসলে খিচুড়ি হয়ে উঠবে না। সব উপাদানের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করে আমি মূলত খাদ্যকে একটি গ্রহণযোগ্য মাত্রা দান করি। সুতরাং বুঝতেই পারছেন—আমাকে ছাড়া খাদ্য মাত্রাহীন হয়ে যায়। এখানে যেহেতু সবাই নিজের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে পুষ্টিগুণের বর্ণনাও করছে, তাই বলছি, আমার ভেতরে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রাইনো নামক ভাইরাস দমনে সহায়তা করে। আর এই রাইনো ভাইরাস মানুষের সর্দি-কাশির জন্য দায়ী। আমার ভেতরে জিঞ্জেরোল নামক জৈব রাসায়নিক উপাদান আছে যা প্রদাহ প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। শুধু তাই নয়, জিঞ্জেরোল মলাশয়ের ক্যানসার প্রতিরোধে খুবই কার্যকর।

আদার কথা শেষ হতেই মরিচ ‘ওয়াক’ করে বমি করে দেয়, ধুর মিয়া—খাবারের মধ্যে কী সব মলাশয়-টলাশয় নিয়া আসতেছেন...ছি!

মরিচকে থামিয়ে দিয়ে আদা সগাম্ভীর্যে বলতে থাকে, মিয়া মলাশয়কে অবহেলা করো! মলাশয় না থাকলে...হ্যাঁ... মানুষের খাবারের প্রয়োজনও হতো না...তুমি ল্যাওড়া এগুলা বুঝবা কী!

—হ তুমিই সব বোঝো, তুমি তো সব জান্তা শমসের!—আদার তিরস্কারের জবাবে মরিচ ঠোঁট বাঁকিয়ে উত্তর করে।

পরিস্থিতি ঝগড়ার দিকে অগ্রসর হলে, হলুদ চেঁচিয়ে ওঠে, দাঁড়িয়ে সবাইকে শান্ত করে। সবাই শান্ত হবার পর আদা আবারও বলা শুরু করে, সম্মানিত উপস্থিতি, আমার ভেতরে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ডিম্বাশয়ের টিউমার এবং ক্যানসার প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। এছাড়া আমি মানুষের রক্তে লিপিড কমাতে সহায়তা করে থাকি। প্রিয় উপস্থিতি, আপনারা জানেন, প্রাচীনকাল থেকে আমি হৃদরোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছি, শুধু তাই নয়, মানুষের যাবতীয় ব্যথা উপশম করার পাশাপাশি মহিলাদের ঋতুস্রাবকালীন ব্যথা উপশমের ক্ষেত্রে আমি ইবুপ্রোফেন ওষুধের মতোই কার্যকর। আমার গুণ আসলে বলে শেষ করার মতো নয়, মানুষের বমি ভাব দূর করতে এবং ক্ষুধামন্দা ভাব কাটাতে এমনকি স্মৃতিশক্তি সংরক্ষণেও আমি সমভাবে কার্যকর। প্রিয় উপস্থিতি, আমার বক্তব্য শেষ করছি, সম্মান গ্রহণ করুন। ধন্যবাদ।

আদার দীর্ঘ বক্তৃতার পর অনেকেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। অপরাপরের মতো হলুদও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, শরীর টানা দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। হলুদ দাঁড়াতেই মরিচ-লবণেরা শিস বাজিয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে, হেই বিউটি বেগম—শাবাশ।

হলুদ মৃদু হেসে হাত উঁচিয়ে সবাইকে শান্ত করে। সবাই শান্ত হলে হলুদ বলতে থাকে, আমি হলুদ, বুঝতেই পারছেন সৌন্দর্য এবং উৎসবের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কতটা নিবিড়! তবে আমি শুধু রূপেই সেরা নই, আমার গুণও কিন্তু কোনো অংশে কম যায় না! এই খিচুড়িতে আমিই প্রধান। বুলন কেন?

হলুদের প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গেই মরিচ-লবণেরা সমবেত কণ্ঠে বলে ওঠে, কেন? কেন?

হলুদ মুচকি হেসে বলতে থাকে, শোনেন পণ্ডিতেরা, আপনারা এই যে খিচুড়ির উপাদান হয়েছেন, আমি না থাকলে তা কিন্তু খিচুড়ি হতো না, হতো—সাদা ডাল-ভাত! এবার অপরাপর গুণের কথায় আসি, আমার আছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে। আমার ভেতরে থাকা কারকিউমিন কিন্তু যে কোনো ধরনের ক্ষত-প্রদাহ সারাতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, কারকিউমিন ধমনিতে ফ্যাট জমতে বাধা প্রদান করে এবং এটি হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। আপনারা জেনে অবাক হবেন যে, কারকিউমিন মানব মস্তিষ্কে নতুন নিউরন তৈরিতে সহায়তাও করে।

হলুদের এরূপ কথার পর মরিচ-লবণেরা জোরে তালি বাজায়। হলুদ হাত উঁচিয়ে সবাইকে শান্ত করে। সবাই শান্ত হলে হলুদ আবার বলা শুরু করে, শোনেন পণ্ডিতেরা, নিয়মিত আমাকে খেলে প্রি-ক্যানসার যুক্ত পলিপ ৬০ পার্সেন্টেরও বেশি কমে যায়। এবার আপনাদেরকে সবচেয়ে অবাক করা তথ্য দেই, তা হলো, আমি মেলানোমা নামক হরমোন প্রতিরোধ করতে সহায়তা করি। আর এই মেলানোমা হরমোন কী জানেন? এই মেলানোমা হরমোন এনজাইটির সঙ্গে যুক্ত, যা মানুষকে আত্মহত্যা করতে উদ্বুদ্ধ করে। এবার আপনারাই বলেন, মানুষ যদি না-ই বাঁচে, তাহলে খাবে কী? ঘোড়ার ডিম?

হলুদের কথা শুনে চাল এবং ডাল ঠোঁট বাঁকিয়ে মিটমিট করে হাসে। এরপর উপস্থিত মঞ্চে রসুন, লবণ, চাল, ডাল, দইসহ সবাই একে একে বক্তৃতা করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে থাকে। একক এই দাবিগুলো ক্রমাগত দীর্ঘ হলে, শুরু হয়ে যায় পারস্পারিক মতবিরোধ। শুরু হওয়া সেই মতবিরোধ একসময় গ্রুপিং-এ রূপ নেয়, চলে হট্টগোল। শুরু হওয়া সেই হট্টগোলে, যে যাকে যেভাবে পারে নির্দয়ের মতো আঘাত করতে থাকে। একে অপরকে আঘাতের ফলশ্রুতিতে, বড় পাত্রে রাখা খিচুড়িগুলো যেন রান্নাঘরময় হয়ে যায়। রান্নাঘরের ভেতরের দৃশ্য দেখে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা টনি মিয়ার যেন বুক ফেটে কান্না আসে, চোখ ভিজে যায়। ভিজে যাওয়া টনি মিয়ার চোখ পানিতে টলটল করতে থাকে। টনি মিয়ার চোখের পানি শুধু পতনের অপেক্ষ করে। শরীর ঘুরিয়ে দেয়ালে হেলান দেয় টনি মিয়া কাঁদে। তার চোখ দিয়ে অঝোরেই ঝরতে থাকে লবণাক্ত পানি, সেই সঙ্গে থরথর করে কাঁপতে থাকে টনি মিয়ার শরীর!

বাইরে বৃষ্টি তখন থেমে এসেছে। অতিথিরাও সব চলে এসেছেন যে যার মতো। ব্যালকনিতে মগবুলের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, স্যার রাষ্ট্রপতি মহোদয় চলে এসেছেন...স্যার...

ব্যালকনিতে মগবুল বারংবার ডাকলেও টনি মিয়ার খেয়াল সেদিকে নেই। দেয়ালে হেলান দিয়ে তখনও নীরবে কেঁদে চলে টনি মিয়া। তার সে কান্না ভাষায় প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। স্রষ্টার সামনে সৃষ্টি বিনাশের যে বেদনা, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো কোনো ভাষা যে জগতে নাই! এ বেদনা হয়তো তারাই বোঝে, যারা মেতেছে সৃষ্টির নেশায়। দেয়ালে হেলান দিয়ে টনি মিয়া শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর কী যেন ভেবে চলে অবিরাম। অবিরাম ভেবে চলা টনি মিয়ার সে ভাবনা, ক্রমাগত শাখা-প্রশাখাও বিস্তার করতে থাকে। কিছু সময়ের ব্যবধানে, টনি মিয়ার সে ভাবনা যেন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র এবং পৃথিবী অতিক্রম করে ছুটে চলে মহাকালের দিকে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শর্তসাপেক্ষে জেল থেকে রেহাই পেলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার
শর্তসাপেক্ষে জেল থেকে রেহাই পেলেন অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার
দ্রুত আ.লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত না এলে আবারও ‘ঢাকা মার্চ’: নাহিদ ইসলাম
দ্রুত আ.লীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত না এলে আবারও ‘ঢাকা মার্চ’: নাহিদ ইসলাম
মাদ্রাসাসহ সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি
মাদ্রাসাসহ সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবি
ভারত-পাকিস্তান ড্রোন যুদ্ধ: দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতের নতুন অধ্যায়
ভারত-পাকিস্তান ড্রোন যুদ্ধ: দক্ষিণ এশিয়ায় সংঘাতের নতুন অধ্যায়
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
তিন শিক্ষক আর পাঁচ শিক্ষার্থী দিয়ে চলছে সরকারি বিদ্যালয়
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
রাতভর নাটকীয়তার পর সকালে গ্রেফতার আইভী, দিলেন ‘জয় বাংলা’ স্লোগান
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
যেভাবে বানাবেন কাঁচা আমের টক-মিষ্টি-ঝাল আমসত্ত্ব 
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: কিশোরগঞ্জের এসপি প্রত্যাহার
আবদুল হামিদের দেশত্যাগ: কিশোরগঞ্জের এসপি প্রত্যাহার