এক.
একটা সার্কাসের হাতি যখন গ্রামে কলাগাছের খোঁজে ঘুরছিল তখন সেই হাতির পিছে পিছে আমিও ঘুরতাম। মূলত হাতির পিছন পিছন থাকা বাচ্চা হাতির কারণে শুধু আমি না, আমার মতো টু-থ্রিতে পড়া প্রায় সবাই ঘুরত। আর একটা লোক থাকত সব সময়, সে ঘুরঘুর করা ছেলেদের কাছে আইসক্রিম বেচত। কয়েক দিনের মধ্যেই সেই আইসক্রিমওয়ালার সঙ্গে আমি সার্কাসের আস্তানায় ভেতরে ঢুকে পড়েছিলাম। ঢুকে দেখি, ভেতরে শুধু একটা হাতি না, কয়েকটা হাতি আছে, আরও বাচ্চা হাতি আছে। বাঘ, বানর ভালুকও আছে। সার্কাসের বাঘটা অত ভয়ানক না। বানরগুলো বরং ভয়ানক। কাছে গেলে কামড়াতে আসে। কালো একটা ভালুক শিকলে আটকানো। বয়স বেশি হবে না ভালুকটার, ছোট সাইজ। শিকলটা কামড়ে ভাঙার চেষ্টা করছিল। আইসক্রিমওয়ালা ভালুকটারে একটা লাঠি দিয়া খোঁচা দিল। আমারও খোঁচা দেয়ার ইচ্ছা হচ্ছিল। কিন্তু মনে হলো, ভালুকটা মানুষের মতোই বলছিল, খোঁচা দিও না। আমি একে একটা আইসক্রিম দিলাম। গপ করে নিয়ে চুষতে লাগল। মনে হলো, খুব মজা খুব মজা, বলতেছে; মানুষের মতোই। এই ভালুকটা কি কথা বলতে পারে? আমি স্পষ্ট শুনেছিলাম, এটা মানুষের মতো কথা বলতেছিল। আরেকটা আইসক্রিম চাইল। আমার পকেটে চার আনা আছে। গোলাপি আইসক্রিমের দাম চার আনা, কমলাটার দাম আট আনা। দেখি আইসক্রিমওয়ালাই নাই। বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টিও শুরু হয়েছিল। আমি আরেক দিন খাওয়ানোর কথা বলে দৌড়ানো শুরু করলাম। ভালুকটা আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। রাতে জ্বর আসল প্রচণ্ড। জ্বরে নাকি আবোল তাবোল বলতাম আর হাস্যকর টাইপের স্বপ্ন দেখতাম। একবার দেখি হাতির পিছে চড়ে নানাবাড়ি যাইতেছি, আরেকবার দেখি, ভালুকটার সঙ্গে এরোপ্লেন চালাইতেছি। জ্বরের কারণে সার্কাসের হাতির পেছনে ঘোরা বন্ধ হয়ে যায়। এর মধ্যে আব্বা খবর দিল, সার্কাসের দলে রাতে আগুন লাগছিল। কয়েকটা পশুপাখি মারা গেছে। একটা বাচ্চা হাতি মারা গেছে, একটা ভালুকও। আগুনে কি ভালুকটার সাহায্যের দরকার পড়ে নাই? ও তো এক করম বাংলায় কথা বলতে পারত। বিষয়টা আর কেউ বলেনি। নাকি আমার কাছেই মনে হইছিল, ভালুকটা বাংলা বলতে পারে।
সেই তিরানব্বই কি চুরানব্বই সালের পর, আমাদের গ্রামের মাজারের ওরসে আর কোনোদিন সার্কাস পার্টি আসে নাই। যদিও এরপর প্রায়ই আমি ভালুকটারে স্বপ্ন দেখতাম। দেখতাম আমার সঙ্গে কথা বলতেছে। প্রায় প্রতিরাতেই, প্রায় দিনই। আমার কল্পনার মধ্যে এমনভাবে ভালুকটা ঢুকে গিয়েছিল, ডাক্তারের পরামর্শে কুমিল্লা শহরে গিয়ে চিড়িয়াখানায় একটা ভালুক দেখানো হলো। সে ভালুকটা ছিল গোমরামুখো। কোনো কথা বলেনি। এরপর আব্বা হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার দেখায়। ডাক্তার বলেছিল, পশুপাখিরা তাদের মতো কথা বলে। মানুষের কথার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নাই। সেবার হোমিওপ্যাথির পুরিন্দায় আমার ভালুকের সাথে কথা বলা রোগ সেরে গিয়েছিল।
দুই.
বহুবছর পর, এই কথা মনে হলো হবিগঞ্জে গিয়ে। হবিগঞ্জ এলাকায় আমাকে নিয়ে এসেছে, পলা। নিয়ে এসেছে বলা ভুল হবে। বলা যায় আমিও আগ্রহ নিয়ে এসেছি সাতছড়ি ন্যাশনাল পার্কে বার্ডিং করব বলে, ওখানকার ধনেশ পাখির ফটোগ্রাফি এমবিয়েন্স হয় ওয়ার্ল্ডক্লাস। আরেকটা কারণ হয়তো পলা নিজেই। ভিতরে ভিতরে ওর সঙ্গ কামনা করি কি না জানি না, তবে ওর নিউজ এজেন্সি যখন ওকে নিউজ কাভার করতে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য বলল, আর ও যখন আমাকে পাশে চাইল, আমি না করতে পারিনি। টেলি থেকে ওয়াইউ সব ল্যান্স নিলাম। এক্স-কলিগ, কী বুঝে আমাকে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য ডাকল বুঝতে পারিনি।
যাওয়ার পথে পলা জানাল, এটা প্লেজার ট্রিপ না। গত সপ্তাহে এই এলাকায় নাকি দুইটা ঘটনা ঘটেছে, একটা হলো, এক হাসপাতালের ওয়ার্ডবয় ভর্তি অবস্থায় এক করোনা রুগিকে রেইপ করেছে। আরেকটা তো আরও ভয়ানক, করোনায় মৃত এক বাবার লাশ নিতে মা গিয়েছিল ঢাকায়, সেই ফাঁকে একা ঘরে থাকা মেয়েকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এই দুটো কেইসের বিষয়ে এজেন্সি হেড কোয়ার্টার ফলোআপ চায়। পলা এসব কেইসের বাইরে কিছু ভাবতে পারছে না।
তাই হবিগঞ্জে পৌঁছে সকাল সকাল আমরা হাসপাতালে গিয়েছিলাম, যেখানে ঘটনা ঘটেছিল। ক্যামেরা দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ প্রথমে ঢুকতে দেয়নি। পরে ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি থেকে এসেছি বলে অনুমতি নিয়ে করোনা ওয়ার্ডের কাছাকাছি যাওয়া গেল। হাসপাতালের কেউ ঘটনার কথা স্বীকার করছে না। এমনকি রুগির ঠিকানা জোগাড় করতেও কষ্ট হলো। হাসপাতালের আশপাশের লোকজন এমন ঘটনা শুনেনি। হাসপাতালের সামনে কলারুটির আর পানের দোকানদাররা—কেউ এমন ঘটনা শুনেনি। তবে অফিস থেকে জানা গেল, ভিকটিমের বাড়ি সাতছড়িতে, ন্যাশনাল পার্ক থেকে খুব দূরে না। পরদিন সকালে ভিকটিমের বাড়ির লোকজন এমনকি গ্রামের কেউ বিষয়টি স্বীকার করল না। বলল, এমন ঘটনা এই গ্রামের কারও সঙ্গে কখনোই ঘটেনি।
গ্রাম জুড়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে হাসপাতালে রেইপ, এমনকি এই গ্রামের কোনো গৃহবধূ নির্যাতনের তথ্য পাওয়া গেল না। তাহলে, হাসপাতাল ভিকটিমের বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়েছে? পলার কথা হলো, সম্ভব না। সেই তারিখে যেসব রুগিরা করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি ছিল, তাদের মধ্যে মহিলা ছিল একজনই। দ্বিতীয় যে ঘটনাটি ঘটেছে, সে বিষয়ে পলা কোনো ক্লু উদ্ধার করতে পারেনি। এটি আবার ঘটেছে দূরের গ্রামে। সেখানেও সবার এক কথা। কে এই কাণ্ড করেছে, অনুমান করাও যাচ্ছে না।
তবে এই গ্রাম ঘুরতে গিয়ে একটা বিষয় জানা গেল, এক লোক আছে, জানা-অজানা বিষয়ে সব কথা বলতে পারবে। এমনকি মানুষের মনের কথাও সে বলে দিতে পারে। সবাই জানে, সে পশুপাখির সঙ্গে কথা বলতে পারে, ওদের কাছ থেকে এসব জেনে বলে দেয়। লোকটা একটা ভালুকও পোষে। শুধু ভালুকটা না, হবিগঞ্জ শহরের পাড়ার কুকুর বিড়াল না, সাতছড়ির এই জঙ্গলার পাখপাখালিরা তার কথা শুনে, সেও তাদের কথা বোঝে। এই ভালুকওয়ালা সাতছড়ি জঙ্গলে বিড়ি-সিগারেট বেচে।
কাজের কাজ না হওয়ায় পলার মেজাজ এমনি তেতে আছে, আর এই গালগল্প শুনে আরও ক্ষেপে গেল। তবে, এ কথা শুনে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ল। পলার কাছে এসব কথা ভাওতাবাজি। আমি আমার ছোটবেলার অভিজ্ঞতা দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, কোনো কোনো প্রাণী মানুষের মতো কথাটথা বলতে পারে। কিন্তু পলার সহজ কথা—এই অঞ্চলটাই বাটপারে ভরা। বন্য প্রাণী অধিকার আইনের প্রয়োগও খুব শিথিল এখানে। রিপোর্ট করা যায় কি না ভাবছে।
তবে পলার অ্যাসাইনমেন্টে কাজে লাগুগ না লাগুক, সাতছড়িতে সিগারেট বেচা লোকটার দেখা পাওয়া আমার দরকার। বছরের পর পছর পশুপাখিদের সঙ্গে থেকে ওদের কথাবার্তা বোঝার দাবি করা, বাড়তি কিছু না। অনেক সময় এটাই স্বাভাবিক, অলৌকিক কিছু না।
তিন.
জঙ্গলে প্রবেশ, করোনার কারণে বন্ধ রেখেছে। তবু লোকজন ঢোকে। এই ফাঁকে আমরাও। উদ্দেশ্য সিগারেট বিক্রেতা ভালুকওয়ালা। আর ধনেশ পাখির ছবি নেয়ার সাধ তো আছেই। সাতছড়ি ন্যাশনাল পার্কের কয়েকটি জায়গায় খুঁজলাম। দুপুর অবধি ভালুকওয়ালার সন্ধান দিতে পারল না কেউ। ধনেশ পাখিরও খোঁজ পেলাম না। তবে এই অছিলায় পলার সঙ্গে রিলাক্সড মুডে কথাবার্তা হলো। তবে কোনো অর্থেই সে স্বীকার করল না তার স্বামীর সঙ্গে গ্যাপ যাচ্ছে। বনের মধ্যে একটা ওয়াচ টাওয়ার আছে। ওঠার পর দারুণ একটা অনুভূতি। এ কয়েক দিনের ধকল এক নিমেষেই চলে গেল।
শহর থেকে এতদূরে সাতছড়িতে এমন নিরিবিলতে, পলার মতো সুন্দরীর সঙ্গ পাওয়া কঠিন। তাকে কথায় মুগ্ধ করা আরও কঠিন। দু-একটা পোর্ট্রেটের নামে মুখ থেকে মাস্ক খুললে মূলত একটা দেয়াল সরে গেল। অমনি আমার মধ্যেও কোত্থেকে যেন এক পুরনো বাসনা জেগে উঠল। আর ধনেশ পাখিদের প্রেমের গল্পটা শুরু করলাম। পাকড়া ধনেশেরা কীভাবে উড়ন্ত অবস্থায় প্রেম করে সে দৃশ্যটা, ও দারুণভাবে নিল। ওর চোখ আমি স্পষ্ট দেখছিলাম, ও যেন উড়ছিল।
কে যেন বলে উঠল, স্যার চা খাবেন, কফিও আছে। একজন সিগারেট নিয়ে ঘুরছে। দর্শনার্থী আর ফটোগ্রাফারদের কাছে সিগারেট বেচাই কাজ। দূরত্ব বজায় রেখে এদেরকে পাখির কথা জিজ্ঞেস করা মাত্রই বলা শুরু করল, পাইবেন কীভাবে। সব নাগা রাজার জঙ্গলে চলে গেছে। গত সপ্তাহে আপনার মতো একজন ক্যামেরাওয়ালা, ছবি তুলতে গিয়া ধনেশ পাখির বাসার কাছে চলে গেছিল। ওরা ভয় পাইছে। এরপর পাখিরা লুকায়া গেছে। একজন গড়গড় করে বলতে থাকল। কফি নেন স্যার। করোনার পর থাইক্যা স্যার রুজি-রোজগার নাই।
আচ্ছা, আপনি ভালুকওয়ালা চা বিক্রেতাকে চিনেন? চিনব না আবার, ওই নিচে, আসতেছে। চা বিক্রেতা চলে আসায়, পলার সঙ্গে প্রেম শুরুর একটা দারুণ মুহূর্ত নষ্ট হওয়ায় মনটা খারাপ, পলা যদিও অত সহজে পটার মেয়ে না। তবে ভালুকওয়ালার দেখা পাওয়ায় একটু অন্যরকম লাগছে।
এই যে সুলমান বাশশা, ও ভালুক পালে। শুধু ভালুক না, ও জঙ্গলার সব পশুপাখির পাহারাদার। সব পাখির কথা কিন্তু ও বুঝে। ওর কথাও পাখিরা বুঝে। আপনারে শুধু ধনেশ পাখি না সব পাখির খবর দিতে পারব। আমি বুঝতে পারলাম, ওরা এভাবে পটিয়ে রোজগার করে। সাতছড়িতে ছবি তোলার কিছু নিয়ম আছে বুঝলেন। পাখির বাসার ছবি তোলা নিষেধ, বাচ্চা পাখির ধারেকাছে যাওয়া যাইব না। গাইড হিসেবে ওরে নেন। সাতছড়ি তো সাতছড়ি, নাগা রাজার জঙ্গলার পশুপাখিরাও এখানে ঘুরতে আসে, ওদের সবাইকে সুলমান বাশশা দেখাই দিব। আমার মনে হলো, চতুর লোকদের পাল্লায় পড়েছি যদিও এদের কথা মজা লাগছে। তবে ক্যামেরার গিয়ারগুলো যদি খোয়া যায়। লেন্সের মূল্য কয়েক লাখ, লেন্সটা তাও বিবিসির ওয়াইল্ড লাইফ প্রজেক্টের। ওদের কাছ থেকে একটা সিগারেট কিনলাম।
ঘুরে ঘুরে কয়েকটা দারুণ চন্দনা টিয়া আর হিল ময়নার ছবি নিলাম। দারুণ শট হলো, একেবারে বুকেহ শট, শার্প ছবি। পলার কয়েকটা ছবি নিলাম। তবে কোনো ধনেশ পাওয়া গেল না। এইখানে ধনেশ পাবেন না, সিগারেট বেচা দুইজন যেচে কথা বলতেছে। ওদের মতলবে আমি এখনও ভয় পাচ্ছি না। তবে ক্যামেরা ছিনতাই করে সুবিধা পাবে না। জিপিএস অন করা আছে। পলার নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা ভয়।
ওদের সঙ্গে ভাব জমাতে আরও দুটো বেনসন নিলাম, যদিও সিগারেট ছেড়েছি বছর চারেক আগে। সিগারেট দেয়ার সময় বলা শুরু করল, ধনেশরা লুকিয়ে থাকে পাতার আড়ালে। ও সুলমান বাশশা, তেলেসমাতি জানে, ও ওদের ডেকে আনতে পারব, ওর কথায় ধনেশ পাখি ওঠ-বস করে। বললে নাচও দেখাবে। কী যে সুন্দর নাচে আপনি বিশ্বাস করবেন না, যদি না দেখেন। আপনি চাইলে এখনই দেখাতে পারি। আমি সায় দিলাম। ওরা আমাদের ভেতরের আরেকটা ওয়াচ টাওয়ারে নিয়ে গেল। আমার মধ্যে আধা বিশ্বাস, আধা অবিশ্বাস। লোক ঠকিয়ে হয়তো এরা অভ্যস্ত, কিন্তু সত্যিই মিরাকল কিছু থাকতে পারে। পলা নিশ্চিত এটা শতভাগ ভাওতাবাজি।
আপনি নাকি জানা-অজানা সব কথা বলতে পারেন? জি, কিছুটা। পশুপাখিরা যতটুকু টের পায় ততটুকু। ওদের ভাষা আমি জানি। আচ্ছা বলেন তো, হাসপাতালের রেইপ নিয়ে কেউ কিছু বলছে না কেন। এ বিষয়ে আমি কিছু বলব না। বলা যাবে না। ধরেন, সালগ্রামের মাইয়্যাটারে কারা কারা মারছে—আমি জানি। এইটা জানা কিন্তু কেরামতি না। কিন্তু বলা যাবে না। আসলে, সবাই জানে, কেউ বলবে না।
টাওয়ার থেকে উত্তরে পূর্ব কোণায় একটা হলদে পাতার গাছ দেখিয়ে বলল, ওখানেই কয়েকটা ধনেশ আছে। এখন ডাকলেও আসবে না। এখন দুপুর কড়া রোদের কারণে ঘুমাচ্ছে। কাল ভোরে আসেন, আমি বলছি, ওরা উড়বে, দারুণ ছবি তুলতে পারবেন। আজ আর কাজ হবে না। ওদের বাহাদুরি ধরা পড়ে গেছে। পলা খুবই বিরক্ত। তবু সুলমানকে আমার ভালোই মনে হলো। ও বলল ওর যাতে ছবি তুলি। তুললাম। ওর কথামতো সকালে আবার আসব, ঠিক করলাম। পলা যদিও একমত না।
সন্ধ্যা হওয়ার আগেই হবিগঞ্জ সদরে রেস্টহাউজে ফিরলাম। রাতে খাবার খেতে বেরুচ্ছি দেখি সুলমান বাদশারা রেস্টহাউজের সামনে দাঁড়িয়ে। ওরা তো জানার কথা না। আমরা কোথায় উঠেছি। ব্যাপারটা ভয়ানক। তবু হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলাম জায়গা চিনলেন কীভাবে। আমরা সব চিনি। স্যার, সুলমান আপনার কথা ধনেশ পাখিদের বলে দিয়েছে। সকালে যাবেন, হলুদ পাতার গাছটা থেকে আরকেটু সামনে দেখবেন অনেকগুলো বটগাছের সারি। ওখানে অনেক পাখি আসবে। সাথের জন বলল, স্যার, ও কিন্তু সত্যি পশুপাখির কথা বুঝতে পারে। আপনেরা সাংবাদিক, যদি ওর কথা টিভি পত্রিকায় ছাপেন। ও কাজকর্ম কইরা খাইতে পারবে। করোনার সময় থাইক্যা আমাদের ঘরে কোনো খাওন নাই। ও মনে করেন হুদহুদ পাখির সঙ্গেও কথা কয়, আবার পিঁপড়াদের চলনও বোঝে। প্রচণ্ড খিদেয় ওদের এমন কথা শুনে বিরক্ত হলাম। ওদের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারলাম। ওদের নিয়ে যাতে নিউজ করি। আমার মাথায় পাকড়া ধনেশের নাচের শট। ওরা কোথায় হেল্প করবে, উলটো আবদার ইন্টারভিউ নেয়ার জন্যে। পলা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে ওর রুম থেকে আসল। রাতের খাবারের পর একটা ইন্টারভিউর মতো নেয়া হলো। পুরোটা জুড়ে ভালুক আর তার মায়ের গল্প।
ভালুকটা যখন বাচ্চা, পাহাড়ি ঢলের সময় তাকে পেয়েছিল। ভালুকের বাচ্চাটা সুলমানের কাছেই আছে কয়েক বছর খানেক ধরে। এলাকার সবাই দেখেছে, সে ভালুকটার কথা বোঝে। সুলমান বাদশার মাও ভালুকটার কথা বোঝে। আসলে, সুলামানের এই কেরামতি পুরোটাই তার মায়ের দোয়া। সুলমানকে পেটে নিয়ে তার মা নাকি সুরা সাদ আর সুরা নামল পড়ে তার জন্য দোয়া করত। সুলমান যাতে বাদশা হয় আর সবার কথা বোঝে। আল্লাহ তার মায়ের একটা কথা কবুল করছে।
সুলমান বাদশারা চলে গেল। কথা দিলাম নিউজ হবে। চলে যাওয়ার পর পলা অ্যানিমেল বিহেইভিয়ার ও হিউম্যান ইন্টার-অ্যাকশন নিয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাগুলো দিতে শুরু করে। পলা আর আমি আগের অফিসেও এমন তর্ক করতাম। দুজন গল্প করতে ভালোই লাগে। আসলে ও প্যারিস ইউনিভার্সিটিতে শেখা বিদ্যাগুলো ঝাড়ছিল। পলা কিছুতেই সুলমান বাদশার এই গালগল্প নিতে পারছে না। ওর কথা হলো, যে সোসাইটি একটা প্যানডেমিককে জাস্ট বিলিফের ওপর ভর দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, তারা আশ্রয় হিসেবে এমন সব গালগল্পে ডুবে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। রাত বাড়লে তর্ক চালাতে পলার রুমে ঢুকে পড়েছিলাম আমি। প্রথমবার। আর পলাও ভেতর থেকে ছিটকিনি বন্ধ করেছিল। প্রথমবার এক ভীষণ নির্ঘুম রাত কাটল।
চার.
ভোরবেলা সাতছড়ি দেখতে স্বর্গের মতো লাগে। সূর্যের হলুদ আলো সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরনার মতো নামে। আর পাখির ডাক— শত শত না হাজার হাজার পাখি ডাকছে মনে হবে। পলা বলল, সকালেই পাখিরা বের হয়, এটা ন্যাচারাল। খায়, নাচে। অনেকক্ষণ হাঁটার পর, ভেতরে যেখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, তার থেকেও দূরে, এক সবুজ ফাঁকা জায়গায় পৌঁছলাম। পৌঁছেই থ। একসারি বটগাছ। শতাধিক পাকড়া ধনেশ বটগাছের ডালে ডালে বসে আছে, উড়ছে। গতরাত ঘুম হয়নি দুজনেরই। দুজনের শরীরে ক্লান্তি। চোখ বুজে আসা ঘুম আর রাতভর বহুদিনের ইচ্ছাপূরণের বিস্ময় নিয়ে দেখছি, পাখিরা কীভাবে উড়ছে। এই পাখির ওড়াউড়ি, দিনের আলোয় পলার হাত ধরার মতোই মিথ্যা, আবার সত্য। পলার চোখেও বিস্ময়, বিশ্বাস করতে পারছে না, এত ধনেশ কোত্থেকে এলো। ধনেশের উড়ন্ত প্রেমের একটা ফুটেজ আমার সারা জীবনের আকাঙ্ক্ষা। আমি ক্যামেরা বের করব—এমন সময় দেখি সুলমান বাদশা হাজির। ইশারায় নিষেধ করল। নিচু স্বরে বলল, ছবি তুইলেন না। আমি ওদের এখানে এ কথা বলেই এনেছি। এদের প্রচার দরকার নাই। আপনি ছবি তুলে ফেইসবুকে দিবেন। শত শত ক্যামেরা নিয়া মানুষজন এদের ছবি তুলবে। হাউকাউ করবে। অনেকে বলতেছে এই জঙ্গলরে টুরিস্ট স্পট বানাবে। এই জঙ্গল টুরিস্টের না, পশুপাখির। এরা হাউকাউ পছন্দ করে না। আমার কথা শুনে, কারণ আমি এদের চোরাকারবারি থেকে বাঁচাই রাখছি। ধনেশ পাখির চোরাকারবারির কিন্তু অভাব নাই। কারবারিদের দেখলে আমি এদের ইঙ্গিত দেই। ওরা চলে যায় দূরে। আমি এদের পাহারা দেই।
আজকে ওরাও আপনাদের দেখতে এনেছি। আমি কিন্তু সত্যিই ওদের কথা বুঝি। টিভিতে আমারে কিন্তু দেখাইবেন। শুনেন, পিঁপড়ারাও আমার কথা বুঝে। যদি বিশ্বাস না করেন, এই মুখে বলব, দেখবেন সব ধনেশ পাখি উড়ে যাবে। সুলমান বাদশা মুখে কী বলল, আর অমনি সব উড়া দিতে শুরু করল। উড়ে উড়ে চক্কর দিতে লাগল। আর সত্যি উড়তে উড়তে সব উত্তরে হাওয়া হয়ে গেল।
পাঁচ.
এরপর আর ধনেশের ছবি তোলা হয়নি। পলাও এই পাখিদের খবর কোথাও দিতে নিষেধ করেছে। তবে দুটো রেইপ কেইসেই অপরাধীর নামসহ স্টোরি তৈরি করে ছেপেছিল। পলা সুলমান বিষয়ক কোনো নিউজ এখনও করেনি। পলাকে ফোনে রিচ করা যাচ্ছে না। ও যদি, ধনেশ পাখিগুলো কেন উড়ে গিয়েছিল এ বিষয়ে একটা নিউজ করত, দারুণ হতো। আমার ক্যামেরা ব্যাগে ওর মোবাইল চার্জার, পারফিউম, অন্তর্বাসের মতো ওর কয়েকটা ব্যক্তিগত জিনিস রয়ে গেছে ক্যামেরার ব্যাগজুড়ে, একটা সুবাস রয়েছে এখনও। ফেরত দেব কীভাবে ভাবছি।
গতকাল শুনেছি পলা স্বামীর সঙ্গে থাইল্যান্ড ঘুরতে গিয়েছে। ইন্সটাগ্রামের ছবিতে ওরা বেশ ভালোই আছে। আর সুলমান করোনায় আক্রান্ত মাকে নিউজটা দেখাবে বলে ফোন করে যাচ্ছে। সম্ভবত সুলমান বাদশা বা ধনেশ পাখিগুলো কেন উড়ে গিলেছিল—এই সংক্রান্ত কোনো নিউজ পলার কখনোই করা হয়ে উঠবে না।