বৃষ্টি ঝরছে। আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে ক্রমাগত। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবিদ বুঝতে পারলো অফিস টাইমের এখনও ঢের বাকি। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো সে। স্নান ও সামান্য আহার সেরে জামা-কাপড় পড়ে তৈরি হলো। আজ চৈত্রের ৫ তারিখ। হাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস বলছে, সারাদিন বৃষ্টি ঝরাবে আকাশ। হঠাৎ করে মনে হলো—থাক, আজ অফিসে না যাই। শেষতক অফিসের বসের কথা মনে হতে সে চিন্তা বাদ দিল। দোনামোনা না করে নীলরঙের ছাতাটা সঙ্গী করে হাঁটা দিল সে।
আবিদ এতদিন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় ক্রিয়েটিভ রাইটারের কাজ করত। আলোচিত কয়েকটি বিজ্ঞাপনের পে-অফ লাইন তার লেখা। বিজ্ঞাপন পাড়ায় আবিদ উঠতি ক্রিয়েটিভ রাইটার হিসেবে পরিচিত। তবে বছরখানেক হয় আবিদ চাকরিটি ছেড়ে যোগ দিয়েছে বাংলাদেশ মোশন পিকচার্স উন্নয়ন সংস্থায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে আবিদের এই নতুন চাকরি নিয়ে তার পরিবার ও বন্ধু-বান্ধবরা সন্তুষ্ট। আবিদ নিজে খুশি না অখুশি তা অনুমান করা যায় না। বছর ঘুরতে চললেও তার মনের এই দোটানা ভাব কাটেনি। আবিদকে আজকাল মৌন ও কিছু একটা নিয়ে মগ্ন থাকতে দেখা যায়। বন্ধুরা তাকে টিটকিরির সুরে বুদ্ধিজীবী ও ভাবুক সম্বোধন করে। ভাব না বস্তু—কিসে আগ্রহ আবিদের—নিজেকে নিয়ে এই জিজ্ঞাসা তার বহুদিনের।
একক্ষণে ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টি কোনো বাঁধা বা ছাতা মানে না। আবিদ দৌড়ে এসে বাসস্টপে দাঁড়াল। এবার অপেক্ষা শুরু হলো কখন এসে অফিসের গাড়িটি তাকে তুলে নেবে। সকালের ঘুম চোখে এসে প্রায় প্রতিদিন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাকে। শুক্র ও শনিবার—সাপ্তাহিক ছুটির দুইদিন বাদে এই তার এখনকার রুটিন। কোনো কোনো দিন শরীর মানতে চায় না তবু তাকে ভোরবেলায় উঠে নিজেকে জোগাড়যন্ত করতে হয়। বেরোতে হয় অফিসের উদ্দেশ্যে। সকাল টু বিকেল অফিস শেষে ফের বাসায় ফিরে পরের দিনের অফিসের জন্য অপেক্ষা—এই অদ্ভুত সাইকেলে ঢুকে গেছে জীবন। কেউ একটা চাবি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এখন শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে এই অদ্ভুত সাইকেল।
গাড়ি এসে থামলে আবিদ কোনোমতে গাড়িতে উঠলো। গাড়িতে উপস্থিত অফিসের জ্যেষ্ঠ সহকর্মীদের প্রটোকল দিয়ে নির্ধারিত আসনে গিয়ে বসল। গাড়িতে ও অফিসে জ্যেষ্ঠ অফিসারদের সঙ্গে কথোপকথনকালে বাক্যের আগে ও পরে অন্তত একবার করে ‘স্যার’ সম্বোধন করতে পারলে ভালো হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত ধরে ব্রিটিশ শাসকরা ভারতে শাসন-শোষণ শুরু করেছিল। ফিরিঙ্গিরা তাদের কলোনি গুটিয়ে বিদায় নিলেও তাদের কালচারের কলোনি আমাদের মগজে পুঁতে রেখে গেছে। স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে তারা যা যা রেখে গেছে তন্মোদ্ধে একটি অন্যতম নিদর্শন হলো এই ‘স্যার’ সম্বোধন। কোনো কোনো অফিসে তো ‘স্যার-না-ভাই’ এই নিয়ে লঙ্কাকাণ্ডের খবর পত্রিকায় প্রকাশ হয়। রসিয়ে কাউকে ‘স্যার’ ডাকতে পারলে যে অনেক অফিসে অনেক মুশকিল আসান হয়ে যায় সেকথা সত্য।
গড়িতে উঠে আবিদ তার পুরোনো বন্ধু জিয়নকে হোয়াসঅ্যাপে টেক্সট পাঠাল। জার্নি ইন এ রেইনি ডে : এ স্টোরি অব এ ক্রিয়েটিভ রাইটার টু ক্লার্ক। জিয়ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্কিটেকচারে পাস করে কিছুদিন এক বদরাগী নারী বসের অধীনে কাজ করেছে। বছর খানেক পর চাকরি ছেড়ে নিজেই প্রকৌশল ব্যবসার ফার্ম খুলে বসেছে। জিয়ন আবিদের লেখালেখি সংক্রান্ত তৎপরতার সমর্থক। জিয়ন মনে করে যেকোনো পরিস্থিতিতে আবিদের লেখালেখি চালু রাখা উচিত।
কিছুক্ষণ পর জিয়নের ফিরতি মেসেজ এল। তাতে উদ্বৃত করা হয়েছে সিরীয় কবি ও কূটনীতিক নিজার কাব্বানিকে। এ ট্রাজেডি, হোয়েন এ ম্যাচিউর মাইন্ড এণ্ড এ রোমান্টিক হার্ট আর ইন দ্য সেইম বডি। প্রেমিক হৃদয় এবং বুঝমান মন একই শরীরে বাসা বাঁধলে যে ওই শরীরের মালিকের বিপদও বাড়ে তা সহজে অনুমান করা যায়। আবিদ এবার লিখলো, লিভিং এ ট্রু স্টোরি : এ ক্রিয়েটিভ রাইটার ইজ এনসাইড এ ক্লার্ক।
গাড়ি এসে থামলো অফিসের বারান্দায়। আবিদ দোতলার সিঁড়ি বেয়ে স্টোর রুমের মতো এক কদাকার কক্ষের কোণে পেতে রাখা নির্ধারিত ডেস্কে পৌঁছালো। ডেস্কের শরীরজুড়ে ডাস্ট জমেছে। জানালায় ঝুলছে মেরুন রঙের পলিস্টারের আধাছেঁড়া পর্দা। আটাশির বন্যার পর সম্ভবত এই পর্দা ধোপা বাড়িতে পাঠানো হয়নি। চাকরিতে যোগদানের পর অফিস সহায়ককে ডেকে আবিদ এগুলো দেখিয়েছে। অফিস সহায়কের সাফ জবাব—সরকারি অফিসের এটাই নিয়ম। প্রথম প্রথম এখানে এসে সবাই কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লেও কয়েকদিন পরে সব ঠিক হয়ে যায়। অপেক্ষা করুন, ধীরে ধীরে ভালো জিনিসপত্র পাবেন। যত বয়স বাড়ে সরকারি চাকরিতে তত মজাও বাড়ে।
কিছুক্ষণ বাদে চা দিয়ে গেল অফিস সহায়ক ছেলেটি। চেয়ারে হেলান দিয়ে চায়ের ধোঁয়া উঠা দেখতে দেখতে চোখ আটকে গেল দেয়ালে সাটানো চিত্রকর্মে। আগে যিনি এই ডেস্কে বসতেন এটি তার ফেলে যাওয়া চিত্রকর্ম। পরিত্যক্ত হিসেবে এখনো দেয়ালে ঝুলছে। আবিদ দেখলো সাদাকালো এই চিত্রকর্মে আর্টিস্টের সিগনেচার রয়েছে। ধূলিমলিন হলেও খুব অরিজিনাল চিত্রকর্ম। সুরিয়ালিস্টিক ধারায় আঁকা এই চিত্রে একদম উপরে আছে ঝিনুক আকৃতির এক চোখ। চোখ বেয়ে টপ টপ করে নামছে অশ্রুবিন্দু। সেই অশ্রুবিন্দুর দিকে চাতক চেয়ে আছে এক পাখি ও এক উজ্জ্বল মাছ। আর্টিস্ট সম্ভবত এই ত্রয়ীকে মুক্তিকাতর হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। তবু কে না জানে, মুক্তি খুব আপেক্ষিক উপলব্ধি। এই এখনই যার কাছ থেকে মুক্তি চাইছি পরক্ষণে হয়ত তার কাছেই যেতে হচ্ছে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়।
আবিদ অফিস সহায়ককে জিজ্ঞেস করল—পূর্বে এখানে যিনি বসতেন ছবিটি তিনি সঙ্গে নিয়ে যাননি কেন? কী সব পাগল-ছাগল ছবি এটা স্যার। এজন্যই উনি নিয়ে যাননি। আবিদ চায়ের দিকে চেয়ে বুঝতে পারলো চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। স্তিমিত হয়ে এসেছে চায়ের উদ্যম ও স্বাদ।