X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

রাতভর উচ্চশব্দে গান-বাজনা, পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটছে শিক্ষার্থীদের

ওয়াজহাতুল ইসলাম, জাবি প্রতিনিধি
০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২:৩০আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২:৩৬

ঢাকার কাছে সাভারে সবুজ গাছপালায় ঘেরা শান্ত-স্নিগ্ধ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি)। শহরের যান্ত্রিকতামুক্ত এ ক্যাম্পাসে রয়েছে শিক্ষা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ। পড়ালেখার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সহায়ক কার্যক্রম ক্যাম্পাসকে পরিচিত করিয়েছে সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে। তবে সম্প্রতি বিভিন্ন অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে উচ্চশব্দে সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহারে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ। ক্যাম্পাস হারাতে বসেছে তার শান্ত-স্নিগ্ধ রূপ।

জানা গেছে, গত কয়েক মাস ধরে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বিভাগ তাদের দশকপূর্তি, রজতজয়ন্তী কিংবা সুবর্ণজয়ন্তী, আবাসিক হলগুলো পুনর্মিলনী, বিভাগীয় ও জেলা সমিতিগুলো বিভিন্ন কনসার্ট জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে আসছে। এসব অনুষ্ঠানে দিনের বেলা এবং রাতভর উচ্চশব্দে সাউন্ড সিস্টেমের ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটছে। ফাইনাল পরীক্ষা চলমান থাকলেও অনেক শিক্ষার্থী মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা করতে পারছেন না। উচ্চশব্দে অনেকে অসুস্থও হয়ে পড়ছেন। অনেকে মাইগ্রেনসহ নিদ্রাহীনতার সমস্যায় ভুগছেন বলে জানা গেছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ‘শৃঙ্খলা সংক্রান্ত অধ্যাদেশ ২০১৮’-এর ৫ ধারায় বর্ণিত ছাত্র-ছাত্রীদের আচরণ বিধির (ধ) উপধারা অনুসারে ‘শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে কোনও প্রকার মাইকিং, ব্যান্ডপার্টি, শোভাযাত্রা, অনুষ্ঠান আয়োজন করতে চাইলে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন লাগবে।’ আরেকটি উপধারায় অনুমতি ছাড়া সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস চলাকালে শোভাযাত্রা ও ব্যান্ড দলের বাদ্যের ব্যবহারের ওপর নিষেধ থাকলেও ক্লাস চলাকালীন সময়েই সেগুলো বেশি হচ্ছে।

একই অধ্যাদেশের (য়) উপধারায় বলা আছে— ‘আবাসিক হলে অন্যকোনও ছাত্র-ছাত্রীর পড়ালেখায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়, এমন চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা করা যাবে না।’ কেউ এগুলো অমান্য করলে এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিস সূত্রে জানা যায়, এসব আয়োজন কিংবা অনুষ্ঠানে বিভাগ, হল কিংবা সংগঠনগুলো অনুমতি নিচ্ছে না। কেউ অনুমতি নিলেও কর্তৃপক্ষের দেওয়া যথাযথ নিয়মকানুন ও শর্ত মানছে না।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলে আয়োজন করা হয় পুনর্মিলনী অনুষ্ঠান। এতে রাতভর উচ্চশব্দের গান বাজানো হয়। তার আগে বাংলা বিভাগ, ইতিহাস বিভাগ ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান, দর্শন বিভাগের রজতজয়ন্তী অনুষ্ঠান এবং বিভিন্ন জেলা সমিতির অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে রাতভর উচ্চশব্দের সাউন্ড বক্সের ব্যবহার করা হয়। এসব অনুষ্ঠানে আতশবাজির ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। এটিকে এবার পরিযায়ী পাখি শীতের মধ্যেই ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছেন পাখি গবেষকরা। এসব সমস্যায় শিক্ষার্থীরা অনেকে হল প্রভোস্ট ও প্রক্টরের কাছে অভিযোগ জানালেও কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে অনেকে অভিযোগ রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজিলাতুন নেছা হল থেকে নতুন হলে স্থানান্তরিত হওয়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আয়েশা আক্তার ইতি বলেন, ‘জাবিকে সংস্কৃতির রাজধানী বলা হয়। কিন্তু ইদানীং প্রোগ্রামগুলোতে চার-পাঁচটা সাউন্ড বক্স লাগিয়ে উচ্চস্বরে গান ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। প্রোগ্রাম থাকতেই পারে, তাই বলে সন্ধ্যা থেকে রাত ৩-৪টা পর্যন্ত চলবে, তা হয় না। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ফাইনাল পরীক্ষা থাকে কমবেশি সবার। কিন্তু সন্ধ্যার পর থেকে সারারাত উচ্চশব্দে এসব গান বাজানোর কারণে আবাসিক হলে পড়াশোনা করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। উল্টো গানের সাউন্ডে অনেকেই মাইগ্রেনসহ নানা সমস্যার মুখে পড়ছেন। অনেক অভিযোগ জানিয়েছি, কিন্তু লাভ হয় না। সবাই বলে, এখানে প্রোগ্রাম হয়, এটাই নিয়ম। মুক্তমঞ্চে রাত ১০টার পর প্রোগ্রাম পরিচালনা করা নিষিদ্ধ। কিন্তু একটা আবাসিক হলের পাশে রাত ৩-৪টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান করা হয়। এভাবে আমরা শিক্ষার্থীরা মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি হচ্ছি।’

গত কয়েকদিনে ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, নাট্য চর্চার উদ্দেশ্যে নির্মিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সেলিম আল দীন মুক্তমঞ্চটি নাট্যচর্চার চেয়ে কনসার্টের উদ্দেশ্যেই বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বেঁধে দেওয়া সময় মানছেন না আয়োজকরা। আয়োজকদের রাত ১০-১১টা পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হলেও তা চলে মধ্যরাত পর্যন্ত। অনুষ্ঠানগুলোতে ব্যবহৃত সাউন্ড বক্সের উচ্চ শব্দ ছড়িয়ে পড়ছে পুরো ক্যাম্পাসে। এতে পড়ালেখাসহ সময়মতো ঘুমাতে অসুবিধায় পড়ছেন শিক্ষার্থীরা।

এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মুরাদ চত্বরে’ প্রায়ই রাতভর উচ্চশব্দে সাউন্ড বক্সে গান বাজান শিক্ষার্থীরা। ফজিলাতুন নেছা হল সংলগ্ন জাকসু ভবনেও প্রতিনিয়ত চলে উচ্চশব্দের গানবাজনা। একই চিত্র ক্যাম্পাসের বটতলা, বঙ্গবন্ধু হল, শহীদ সালাম-বরকত হল, রবীন্দ্রনাথ হল সংলগ্ন খাবারের দোকান সংলগ্ন এলাকায়ও। দিনের বেলা যানবাহনের শব্দ আর রাতে গানবাজনা, আড্ডার উচ্চশব্দে অতিষ্ঠ সাধারণ শিক্ষার্থীরা। গত দুই মাস ধারাবাহিক এসব আয়োজনের কারণে আশপাশের আবাসিক হল ও অ্যাকাডেমিক ভবনে নষ্ট হচ্ছে শিক্ষার সঠিক পরিবেশ।

সচেতন শিক্ষার্থীদের অনেকে বলছেন, অবাধ সাংস্কৃতিক চর্চার চারণভূমি এই ক্যাম্পাস। বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন যে কারোরই অধিকার। তবে খেয়াল রাখা উচিত, এসব আয়োজন যেন কারও ক্ষতির কারণ না হয়। উচ্চ শব্দের ব্যবহার না করে তা নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যেই সীমিত রাখা উচিত। এতে নিজেরাও আনন্দ করতে পারলো আর অন্যদেরও ক্ষতি হলো না। নিজেদের জায়গা থেকে একটু সচেতন হলে ক্যাম্পাসের পরিবেশ সুন্দর রাখা কঠিন কিছু নয়।

জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সৌমিক বাগচী বলেন, ‘এটি একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়। এ জন্য এর অভ্যন্তরে অনুষ্ঠানগুলো আয়োজনের জন্য একটি নির্দিষ্ট টাইম ফ্রেম থাকা উচিত। আমরা সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো টাইম মেনে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু ইদানীং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এটি মানা হচ্ছে না। অনুষ্ঠান করছে কোনও ব্যাচ, বিভাগ কিংবা জেলা সমিতিকেন্দ্রিক সংগঠন। কিন্তু এর দায়ভার পড়ছে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর ওপর। আমরা মনে করি, এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনের একটু শক্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ, এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে প্রশাসন। ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ যেন নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রেখে যেকোনও আয়োজন করা উচিত।’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের রাতভর আয়োজন খুবই দুঃখজনক। অনেকে অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য অনুমতিও নেয় না। আবার যারা নেয়, তাদের অনেকেই নির্ধারিত শর্ত মানছে না। আমরা অনেকবার বলেছি— নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করতে। এর আগে দুটি প্রোগ্রামে আমরা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তারপর কিছুদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। এখন থেকে আবারও কঠোর হবো। নির্দেশনা ও শর্ত না মানলে আয়োজনের অনুমতি দেওয়া হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থাও করবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘অনুষ্ঠান আয়োজকদের মাথায় রাখা উচিত, তাদের আনন্দ যেন অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়। সবার কথা মাথায় রেখে আয়োজন করা উচিত। শিক্ষার্থীদের ক্লাস, পরীক্ষা, ঘুমের সমস্যার কথা বিবেচনা করা উচিত। এবার থেকে শর্ত না মানলে আমরা কঠোর হতে বাধ্য হবো।’

/আরকে/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
৯ মে পর্যন্ত বন্ধ থাকবে চুয়েট, হলে থাকতে পারবেন শিক্ষার্থীরা
হলও ছাড়েননি আন্দোলনেও নামেননি চুয়েটের শিক্ষার্থীরা
নির্দেশের পরও হল ত্যাগ করছেন না চুয়েট শিক্ষার্থীরা, বাসে আগুন
সর্বশেষ খবর
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
ফরিদপুরে দুই শ্রমিক হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতার দাবিতে খেলাফত মজলিসের মিছিল
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মশা তাড়ানোর ৫ প্রাকৃতিক উপায়
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!