নিজ দফতরের খাস কামরায় একজন অফিস সহায়কের সঙ্গে ‘আপত্তিকর’ ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় সদ্য ওএসডি (বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হওয়া জামালপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) আহমেদ কবীর এ অর্থবছরে (২০১৮-১৯) পেয়েছেন বিভাগীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার। তার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ ওঠায় দুই মাস আগে পাওয়া শুদ্ধাচার পুরস্কারের এ সনদ বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই এর প্রক্রিয়া শুরু করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
এ পরিস্থিতিতে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার সনদ পাওয়া একজন কর্মকর্তার এমন নৈতিকস্খলন হয় কী করে? জানার আগ্রহ তৈরি হয়েছে, রাষ্ট্রীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতা কী এবং কীভাবে এই পুরস্কারের জন্য কর্মকর্তা বাছাই করা হয়। এই সনদ পাওয়া কর্মকর্তাকে বাছাই করার ক্ষেত্রে কারও গাফিলতি ছিল কিনা, আলোচনায় রয়েছে সে প্রশ্নটিও।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব (সমন্বয় ও সংস্কার) এন এম জিয়াউল আলম স্বাক্ষরিত ২০১৭ সালের ৬ এপ্রিল জারি করা ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদান নীতিমালা, ২০১৭’ সংক্রান্ত এক গেজেটে জানা গেছে, ‘সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়: জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ শিরোনামে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল ২০১২ সালে মন্ত্রিসভা বৈঠকে অনুমোদন করা হয়েছে, যা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইট, গেজেট ও পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। এ কৌশল বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় শুদ্ধাচার উপদেষ্টা পরিষদ এবং অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে উপদেষ্টা পরিষদের নির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়েছে। জাতীয় শুদ্ধাচার উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের নৈতিকতা কমিটি গঠিত হয়েছে এবং নৈতিকতা কমিটির সদস্য সচিব শুদ্ধাচার ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে কাজ করছেন। সরকারের সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এ শুদ্ধাচার কৌশল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার কর্মকৌশল প্রণয়ন করছে বলেও গেজেটে বলা হয়েছে।
গেজেটে বলা হয়েছে, ‘সরকারের মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত কর্মচারীদের পুরস্কার প্রদানের উদ্দেশ্যে শুদ্ধাচার পুরস্কার নীতিমালা প্রণয়ন করা হলো। শুদ্ধাচার চর্চায় এই পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে যারা নির্বাচিত হবেন তারা হলেন ১. মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সিনিয়র সচিব বা সচিব ২. প্রতিটি মন্ত্রণালয় বা বিভাগের গ্রেড ১ থেকে গ্রেড ১০ ভুক্ত একজন এবং গ্রেড ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত একজনসহ মোট দুই জন কর্মচারী। ৩. মন্ত্রণালয় বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের মধ্য হতে একজন কর্মচারী, ৪. মন্ত্রণালয় বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাঠপর্যায়ের আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহ থেকে একজন কর্মচারী, ৫. মন্ত্রণালয় বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাঠপর্যায়ের আঞ্চলিক কার্যালয়সমূহের গ্রেড ৩ থেকে ১০-ভুক্ত একজন কর্মচারী, ৬. গ্রেড ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত একজন কর্মচারী, ৭. মাঠপর্যায়ের জেলাসমূহের মধ্য থেকে একজন কর্মচারী, ৮. মন্ত্রণালয় বিভাগ বা রাষ্ট্রীয় অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মাঠপর্যায়ের উপজেলা কার্যালয়সমূহের প্রধানদের মধ্য হতে একজন কর্মচারী।’
গেজেটের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কর্মচারী বলতে মন্ত্রণালয়, বিভাগ, বা অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বোঝাবে।’
গেজেটের ৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘ নীতিমালায় বর্ণিত সূচকের ভিত্তিতে এবং প্রদত্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে এ পুরস্কার দেওয়ার জন্য কর্মচারী বাছাই বা নির্বাচন করা হবে। পুরস্কার প্রদানের জন্য সুপারিশ করার ক্ষেত্রে শুদ্ধাচার চর্চার জন্য নির্ধারিত গুণাবলির ১৮টি সূচকের প্রতিটির জন্য ৫ নম্বর করে মোট ৯০ নম্বর এবং মন্ত্রণালয়, বিভাগ, অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, দফতর বা সংস্থা কর্তৃক ধার্যকৃত অন্যান্য কার্যক্রমে ১০ নম্বরসহ মোট ১০০ নম্বর বিবেচনা করা যেতে পারে।’
শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত ১৮টি গুণাবলি হচ্ছে- কর্মচারীর পেশাগত জ্ঞান ও দক্ষতা, সততার নিদর্শন স্থাপন করা, নির্ভরযোগ্যতা ও কর্তব্যনিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ, সহকর্মীদের সঙ্গে আচরণ, সেবাগ্রহীতার সঙ্গে আচরণ, প্রতিষ্ঠানের বিধিবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা, সমন্বয় ও নেতৃত্বদানের ক্ষমতা, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শিতা, পেশাগত স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক নিরাপত্তা সচেতনতা, ছুটি গ্রহণের প্রবণতা, উদ্ভাবনী চর্চার সক্ষমতা, বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি বাস্তবায়নে তৎপরতা, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার, স্বপ্রণোদিত তথ্য প্রকাশে আগ্রহ, উপস্থাপন দক্ষতা, ই-ফাইল ব্যবহারে আগ্রহ, অভিযোগ প্রতিকারে সহযোগিতা করা।
গেজেটে আরও বলা হয়েছে, ‘শুদ্ধাচার পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীকে উল্লেখিত সূচকের ১০০ নম্বরের মধ্যে অবশ্যই ৮০ নম্বর পেতে হবে। এটি না পেলে ওই কর্মচারী এই পুরস্কার পাওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে বিবেচিত হবেন না। আর বিবেচিত কর্মচারীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া কর্মচারী শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হবেন। সিনিয়র সচিব বা সচিবদের মধ্যে এই পুরস্কারের জন্য যোগ্য কর্মচারী নির্বাচন করবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত বাছাই কমিটি। আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধানদের মধ্য থেকে কর্মচারী বাছাইয়ের জন্য আঞ্চলিক প্রধানের নেতৃত্বে, জেলা পর্যায়ের কর্মচারী বাছাইয়ের জন্য আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধানের নেতৃত্বে, উপজেলা পর্যায়ের কর্মচারী বাছাইয়ের জন্য জেলা কার্যালয়ের প্রধানদের নেতৃত্বে পৃথক বাছাই কমিটি থাকবে।’
গেজেটে এই পুরস্কারের ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘প্রতিবছর সরকারের শুদ্ধাচার পুরস্কারপ্রাপ্ত কর্মচারীরা পুরস্কার হিসেবে একটি সার্টিফিকেট এবং এক মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পাবেন।’
এই গেজেট অনুযায়ী আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রধানদের ক্যাটাগরিতে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বাধীন কমিটি জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীরকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করে।
এ বিষয়ে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, “শুদ্ধাচার পুরস্কার প্রদান নীতিমালা ২০১৭” অনুযায়ী গঠিত ময়মনসিংহ বিভাগীয় বাছাই কমিটির ১২ জুন অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তের আলোকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বিভাগের আওতাধীন জেলা কার্যালয়ের প্রধানদের মধ্য থেকে জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীরকে বিভাগীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করে।
এর কারণ ব্যাখ্যা করে ময়মনসিংহের সাবেক বিভাগীয় কমিশনার ও বাছাই কমিটির সভাপতি মাহমুদ হাসান জানান, বিভাগের চারটি জেলার মধ্যে ময়মনসিংহ জেলার ডিসি সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস এর আগের বছর এই পুরস্কার পেয়েছেন। তাই তিনি এ বছর এই পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হননি। বিভাগের বাকি তিন জেলার (জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা) ডিসিদের মধ্যে জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীর নীতিমালায় বর্ণিত সূচক ও মানদণ্ডের আলোকে সর্বোচ্চ নম্বর পান। তাই তাকে এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়।
বিষয়টি তার (তদানীন্তন ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার মাহমুদ হাসান) স্বাক্ষরে ১২ জুন এক অফিস আদেশে সংশ্লিষ্টদের জানানো হয়।
তবে এই বিবেচনাতে গাফিলতি দেখছেন সরকারের সাবেক আমলারা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীরকে জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারের জন্য নির্বাচনের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলদের গাফিলতি ছিল। এক্ষেত্রে তারা আরও সতর্ক হতে পারতেন। সতর্ক হওয়াটা তাদের প্রয়োজন ছিল। এর দায় বাছাই কমিটি এড়াতে পারে না।’
আপত্তিকর ভিডিওর অভিযোগে অভিযুক্ত এই জেলা প্রশাসকের জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কারের সনদ বাতিলের ব্যাপারে সরকার যে হার্ডলাইনে যাচ্ছে তাও সমর্থন করেছেন তিনি। আলী ইমাম মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে জামালপুরের ডিসি আহমেদ কবীরের শুদ্ধাচার পুরস্কারের সনদ বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে তা সঠিক।
জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মোহম্মদ শফিউল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, সরকারের জারি করা শুদ্ধাচার নীতিমালার গেজেটে উল্লেখ না থাকলেও কারও শুদ্ধাচার পুরস্কার সনদ বাতিল করতে সরকারের কোথাও বাধা নাই। সরকার চাইলে কারও এই পুরস্কার বাতিল করতেই পারে।
আহমেদ কবীরের শুদ্ধাচার পুরস্কারের সনদ বাতিল করার প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, ‘আগে তদন্তটি হতে দেন। তারপর দেখা যাবে কোন প্রক্রিয়ায় এ সনদ বাতিল করা যায়।’ তিনি আরও জানান, ‘ইতোমধ্যেই আমরা সরকারের পক্ষ থেকে যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছি। ইতোমধ্যেই তাকে (আহমেদ কবীর) ওএসডি করেছি। সেখানে (জামালপুর) নতুন ডিসি দিয়েছি। তাই তার পরিবার ও সন্তানের সম্মানের কথা বিবেচনা করে ১০টি দিন আমরা অপেক্ষা করি। দেখি তদন্তে কী বেরিয়ে আসে।’
উল্লেখ্য, জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীরের একটি ‘আপত্তিকর’ ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ফেসবুকের মেসেঞ্জারে ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দিবাগত রাতে একটি ফেসবুক আইডি থেকে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়। ভিডিওটিতে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে তার অফিসের এক নারী অফিস সহায়ককে দেখা গেছে। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় ওঠে। তবে, ভিডিওটি সাজানো দাবি করেছেন জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর। এই ভিডিওর ঘটনায় অভিযুক্ত ডিসি আহমেদ কবীরকে ২৬ আগস্ট ওএসডি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার আদেশ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। ভিডিওটি পরীক্ষা এবং তা কী করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লো তা তদন্তে একজন যুগ্ম সচিবের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। কমিটিকে ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সরকারের নীতিনির্ধারকরা জানিয়েছেন, তদন্তে অভিযোগ পুরোপুরি প্রমাণিত হলে আহমেদ কবীরের পদাবনতি ঘটতে পারে, এমনকি চাকরিও চলে যেতে পারে।