X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

প্রথম প্রতিবাদ হয় মারদেকা কাপে

তানজীম আহমেদ
১৫ আগস্ট ২০২১, ০৯:০০আপডেট : ১৫ আগস্ট ২০২১, ১৫:৪৯

মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপ ফুটবলে খেলতে যাওয়ার আগে জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলো বাংলাদেশ জাতীয় দল। সেই দলে ছিলেন কাজী সালাউদ্দিন-আশরাফ উদ্দিন চুন্নুরা। ২৭ জুলাই গণভবনের সাক্ষাতই যে শেষ দেখা হবে তা কে ভেবেছিল? ১৫ আগস্ট সবকিছু এলোমেলো করে দিলো। ঘাতকদের নির্মম বুলেটের আঘাতে জাতিরজনক সপরিবারে নিহত হলেন। আর এই খবরটি মালয়েশিয়া বসে শুনতে হয়েছে জাতীয় দলের ফুটবলারদের। আর তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়নি। সেদিন ছিল মারদেকার প্রতিযোগিতায় শেষ ম্যাচ। দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে খেলার আগে তাই কালো ব্যাজের পাশাপাশি লাল-সবুজ পতাকা অর্ধনমিত রেখে প্রতীকি প্রতিবাদ জানিয়েছে সবাই!

মারদেকায় খেলা দলটির অন্যতম তারকা আশরাফ উদ্দিন চুন্নু। বয়স তখন তার ১৭ কিংবা ১৮। কুয়ালালামপুর থেকে দুই ঘন্টার দূরত্বে এক ভিলেজে এই প্রতিযোগিতা আয়োজিত হয়েছিল। ১৫ আগস্ট সকালে ম্যাচের দিন এক শিখ ভদ্রলোক তড়িঘড়ি করে এসেই কাজী সালাউদ্দিনকে(বর্তমান বাফুফে সভাপতি) খোঁজেন। এর আগে তার সঙ্গে ১৯৭৩ সালে মারদেকা কাপে শিখ ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল।

সেদিন এসেই তিনিই দুঃসংবাদটি প্রথম জানান। চুন্নুর স্মৃতিতে এখনও তা পরিষ্কার,‘তোমাদের প্রেসিডেন্ট খুন হয়েছে। তার পরিবারের সদস্যরাও আর বেঁচে নেই।’

এমন খবর শুনে সবাই যেন জোর ধাক্কা খেলেন।বিশ্বাসই হতে চাইছিল না। তাই তো কাজী সালাউদ্দিনের পরামর্শে সবাই তখন ওই শিখ ভদ্রলোকের গাড়িতে করে দূতাবাসের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ওই দলে আবাহনীর ছয়জন খেলোয়াড় ছিলেন। দূতাবাসে গিয়ে দেখলেন রাষ্ট্রদূতের মন বেশ খারাপ। তিনিও বললেন ‘বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের বার্তা পাওয়া গেছে। দেশে মিলিটারি ক্যু হয়েছে।’ তখন আর কারও মধ্যে আর অবিশ্বাস থাকেনি। তবে শেখ কামাল বেঁচে আছেন কিনা তখনও জানা যায়নি।

বিকালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ম্যাচই খেলতে চায়নি বাংলাদেশ। কিন্তু ফিফা আয়োজিত ম্যাচ বিধায় না খেললে সাসপেন্ড হওয়ার আশঙ্কা থাকে তাই খেলতে হয়েছে। তবে সেখানে অভিনব প্রতিবাদ করেই মাঠে নেমেছিল লাল-সবুজ দল।

সেই প্রতিবাদে জাতীয় দলে আবাহনীর ছয়জন খেলোয়াড় ছাড়াও অন্যরাও সামিল ছিলেন। তারাও সালাউদ্দিন-চুন্নুদের সঙ্গে শোকাহত।

আবাহনী লিমিটেডের বর্তমান পরিচালক আশরাফ উদ্দিন চুন্নুর ভাষায়, ‘আমরা কোনওভাবেই ম্যাচটি খেলতে চাইনি। দেশে এত বড় ঘটনা ঘটে গেছে। এরপর কীভাবে খেলি। কিন্তু পরিস্থিতির কারণে খেলতে হয়েছে। তবে আমরা আয়োজকদের রাজি করিয়েছে কালো ব্যাজ পড়ে খেলবো। খেলার সময় মাঠের বাইরে আমাদের লাল-সবুজ পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। ওরাও সহমর্মিতা জানিয়ে আমাদের সব দাবি মেনে নিয়েছে। ম্যাচটি কোনোমতে খেলে চার গোলে হেরেছিলাম।’

পরবর্তীকালে জেনেছিলেন আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালও নিহত হয়েছেন। তখন আফসোস যেন আরও বেড়েছে। জাতীয় দলের খেলা দেখতে বঙ্গবন্ধুর বড় পুত্রের মালয়েশিয়াতে আসার কথা ছিল। কিন্তু পরীক্ষা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আসার কথা থাকায় শেখ কামাল আসতে পারেননি।

দেশের সাবেক তারকা ফুটবলার আশরাফ উদ্দিন চুন্নু হৃদয়ভারাক্রান্ত মনে বলেছেন, ‘শেখ কামাল ভাই আমাদের সঙ্গে মালয়েশিয়া আসলে হয়তো বেঁচে যেতেন। এভাবে মৃত্যুকে বরণ করতে হতো না। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য। আমরা তাকে অল্প বয়সে হারিয়েছি। আজ তিনি বেঁচে থাকলে আমাদের ক্রীড়াঙ্গন আরও এগিয়ে যেতে পারতো।’

মারদেকা প্রতিযোগিতা থেকে দেশে ফিরতে বেশ সময় লেগেছে কাজী সালাউদ্দিন-চুন্নু-আশরাফদের। ততদিন পর্যন্ত আয়োজকরা তাদের ভালোই রেখেছে। তবে একসময় ২৯ আগস্ট দেশে ফিরতে হয়েছে ভীতি নিয়ে। এয়ারপোর্ট থেকেই জেরা শুরু। বিশেষ করে আবাহনীর খেলোয়াড়দের। কাজী সালাউদ্দিনের চুল কেন বড়? এমন প্রশ্নের উত্তরও দিতে হয়েছে। এছাড়া তাৎক্ষনিক লাগেজও পাওয়া যায়নি।

আবাহনী ক্লাবের ওপর দিয়ে ঝড়ও বয়ে গেছে। কেউ ক্লাবে যাওয়ার সাহসও পাচ্ছিলেন না। তবে সেপ্টেম্বরেই লিগ শুরুর ঘোষণা দেওয়ায় সবাই একত্রিত হতে থাকেন। তখন ক্লাবে কেউ থাকতেন না। বিভিন্ন ক্লাবে থেকে অনুশীলন করেছেন। রুটি-কলা খেয়ে দলের জন্য খেলেছেন।

আশরাফ উদ্দিন চুন্নু বলছিলেন, ‘মাঠের পাশে বটগাছের নিচে বসে অনুশীলনের পর রুটি-কলা খেয়ে কোনওমতো টিকে ছিলাম। তারপর যে যার ঠিকানায় ফিরে যেতাম। কেউবা অন্য ক্লাবে আর কেউবা নিজেদের বাসায়। সেই বছর অনেক কষ্টে লিগে খেলেছি। আমরা কোনওভাবেই শেখ কামালের হাতেগড়া আবাহনী ক্লাব শেষ হতে দেইনি।’

এভাবে লিগ শেষ করার পর ছিয়াত্তর সালে আবাহনী ক্লাব যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পায়। কর্নেল কাজী শাহেদ আহমেদ অন্যদের সঙ্গে মিলে ক্লাবের ধরেন হাল। তিনি অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা নির্বিঘ্নে খেলো। কোনও সমস্যা নেই, আমি সব দেখছি।’

সেইসময় সেনাবাহিনীর একজন কর্নেলকে সামনে পেয়ে সবার মনের ভয় একটু একটু করে কাটতে শুরু করে। আশরাফ উদ্দিন চুন্নু বলেছেন, ‘১৯৭৬ সালে একজন রানিং কর্নেল আমাদের ক্লাবের পরিচালনায় আসায় আমরা যেন নতুন করে পথ চলায় উদ্দীপনা পাই। এরপর আমাদের আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তবে ৭৫ পরবর্তী ক্লাবের ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গেছে তা কোনওভাবেই ভোলার নয়।’

/এফএএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’
‘মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ’
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী মারা গেছেন
সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী মারা গেছেন
ইউক্রেনের শান্তি আলোচনায় আমন্ত্রণ পায়নি রাশিয়া: সুইজারল্যান্ড
ইউক্রেনের শান্তি আলোচনায় আমন্ত্রণ পায়নি রাশিয়া: সুইজারল্যান্ড
দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে ঋণের শর্তে আটকে ফেলেছে: ক্যাব
দাতা সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে ঋণের শর্তে আটকে ফেলেছে: ক্যাব
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ
তীব্র তাপপ্রবাহ যেখানে আশীর্বাদ