X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

চামড়া নিয়ে সংকট যেন কাটছেই না

শফিকুল ইসলাম
৩০ জুন ২০২৩, ১৭:৩০আপডেট : ৩০ জুন ২০২৩, ১৭:৪৯

দেশের চামড়া শিল্পের সংকট যেন কাটছেই না। ব্যবসায়ীরা নানা অজুহাতে এ সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা অজুহাতে এ খাতের উদ্যোক্তারা শিল্পটিকে অস্থির করে তুলেছেন। তৈরি পোশাকের পর বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্য হচ্ছে চামড়া। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই দেশের চামড়ার বাজারে বিরাজ করছে ব্যাপক অস্থিরতা। লাখ টাকা দামের গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে মাত্র তিনশ’ টাকায়। এমনকি ন্যায্য দাম না পেয়ে গত বছর কোরবানির পশুর চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে। এ বছর এমন খবর পাওয়া না গেলেও লবণ দিতে দেরি করায় চামড়া পচে যাওয়ার আশঙ্কা রয়ে গেছে।

অতীতে অনেক মৌসুমি ব্যবসায়ী পাড়া-মহল্লা থেকে চামড়া সংগ্রহ করে বিক্রি করতে এনে ক্রেতা না পেয়ে রাস্তায় ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। কারণ, লবণ দিতে দেরি করায় চামড়া পচে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় চামড়া শিল্পের কাঁচামাল এই চামড়ার বড় একটি জোগান আসে কোরবানির সময়। ব্যবসায়ীরাই জানিয়েছেন, এ সময় চাহিদার ৮০ শতাংশ চামড়া সংগ্রহ করা হয়। অথচ এই কোরবানির সময় দেখা যায় যথাযথ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত না করা এবং সময় মতো না কেনার কারণে প্রচুর চামড়া নষ্ট হয়ে যায়। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র মৌসুমি ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্টরা।

গত কয়েক বছর ধরে সৃষ্ট চামড়া নিয়ে এই সংকট এ বছরও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ব্যবসায়ী, মাদ্রাসা, মসজিদ কর্তৃপক্ষ ও সর্বোপরি সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে চামড়ার অবদান এখন মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। রয়েছে এ খাতে দক্ষ শ্রমিকের অভাব। প্রশ্ন রয়েছে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়েও। শ্রমিকের ন্যায্যমজুরি প্রাপ্তির বিষয়টিও প্রশ্নের মুখোমুখি। তাই তো চামড়া নিয়ে এক ধরনের অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে সংশ্লিষ্টদের। অথচ বাংলাদেশের প্রধান রফতানি পণ্যের তালিকায় থাকা তৈরি পোশাকের পরেই চামড়ার অবস্থান দ্বিতীয়। সরকারের পক্ষ থেকে এই শিল্পকে গুরুত্ব দিয়ে গত পুরো বছরকে চামড়া শিল্পের জন্য উন্নয়নের বছর হিসেবে ঘোষণা করলেও এর কোনও পরিবর্তন হয়েছে বলে চোখে পড়ে না।

সূত্র জানিয়েছে, কোরবানি ঈদের মৌসুম চলে এলেই কোরবানিদাতাদের ব্যস্ততা বাড়তে থাকে পশু কেনা নিয়ে। আর ঈদের নামাজের পর থেকে তৃতীয় দিন পর্যন্ত চলে পশু জবাই সংক্রান্ত ব্যস্ততা। সঙ্গে থাকে কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে চিন্তা। নতুন করে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চামড়ায় লবণ মাখানোর বিষয়টি। সরকার দর নির্ধারণ করে লবণযুক্ত চামড়ার। অথচ একটি চামড়ায় ৩০০ টাকার লবণ মাখানোর পর কোরবানিদাতাকে সেই চামড়া বিক্রি করতে হয় কখনও ১৫০ থেকে ৫০০ টাকায়। এমন পরিস্থিতিতে কোরবানিদাতা পশুটির চামড়ায় লবণ মাখাতে নিরুৎসাহিত হয়। একইভাবে নিরুৎসাহিত হন পাড়া-মহল্লার মসজিদ-মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। তারাও দান হিসেবে পাওয়া পশুর চামড়ায় লবণ মাখানোর দায়িত্ব নেন না। এখানেই ঘটে বিপত্তি। এ ছাড়া উপযুক্ত দাম দেওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছে আছে হাজারো অভিযোগ। এই অভিযোগ কখনও দেশীয় আবার কখনও আন্তর্জাতিক।

পশু কোরবানিদাতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পশুর চামড়া ঠিকভাবে কাটা হলো কিনা, চামড়ার উপযুক্ত দাম মিলবে কিনা কিংবা বিক্রিতে বেশি দেরি হলে চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে কিনা—এসব চিন্তা প্রায় সবার মাথাতেই ঘুরপাক খায়। অন্যদিকে চামড়া দেশের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সম্পদ ও রফতানি পণ্য। তাই ভালোভাবে চামড়া সংরক্ষণে সবসময় গুরুত্ব দেওয়া হয়। লবণের অভাবে পচে যাওয়ায় দেশের কোনও কোনও স্থানে নদীতে চামড়া ফেলে দিতে হয়েছিল। চট্টগ্রামেও ট্রাক থেকে চামড়া ফেলে দেওয়া হয়েছিল। উপযুক্ত দাম না পাওয়ায় কোরবানির চামড়া রাগে-ক্ষোভে মাটিতে পুঁতে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে।

সরকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেছেন, এবার সেই সুযোগ দেওয়া হবে না। দেশে যথেষ্ট লবণ রয়েছে। একদিনে প্রচুর লবণ লাগে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে কারসাজি করে লবণের দাম বাড়িয়ে দেয় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী। এবার তা হতে দেওয়া যাবে না। এ বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাও তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। অপরদিকে এ বছর এখন পর্যন্ত নির্ধারিত লক্ষ্য অনুযায়ী চামড়া সংগ্রহ করা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ কাজ করছে।

জানা গেছে, বড় জোগানদাতা চট্টগ্রামে এ বছর কম চামড়া সংগ্রহ করা গেছে। কোরবানিতে চট্টগ্রামের আড়তগুলোতে প্রায় সাড়ে তিন লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য থাকলেও চাহিদা মাফিক চামড়া আসেনি। কোরবানির যেসব চামড়া এসেছে তার বেশিরভাগই আড়তদাররা কিনেছেন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়। গুদামগুলোতে বড় আকারের চামড়া ৫০০ টাকায় কিনলেও এ টাকার অর্ধেকও পাননি কোরবানিদাতারা।

জানা গেছে, নানা ধরনের জটিলতায় এ খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত শ্রমিকের সংখ্যা কমছে। কোনোভাবেই এ খাতের শ্রমিকদের কাজের প্রতি আগ্রহী করা যাচ্ছে না। যারা এ কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন তারা অনেকটাই দায়ে পড়ে আছেন। অন্য কাজের অভিজ্ঞতা নেই বলে নানা ঘাত-প্রতিঘাত-সীমাবদ্ধতা নিয়ে আছেন এই কাজের সঙ্গে। আর্থিক সংকট, স্বাস্থ্য ঝুঁকি, ন্যায্য পাওনা না পাওয়া, আবাসন সংকটের মধ্যেই কাজ করছেন চামড়া শিল্পে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রম জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে এ খাতে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ২৯ হাজার, যা মোট কর্মসংস্থানের শূন্য দশমিক ২২ শতাংশ।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে এ খাতে রফতানি আয় ছিল ১১২ কোটি ডলার। ২০১৬-১৭-তে এসে তা বেড়ে ১২৩ কোটি ডলার হয়। তবে পরের দুই অর্থবছরে চামড়া শিল্পের রফতানি আয় উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা নেমে আসে ১০৮ কোটি ডলারে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও কমে হয়েছে ১০২ কোটি ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০২০-২১ অর্থবছরের এ খাত থেকে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার। যদিও এই অঙ্ক গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ বেশি। গত এক বছরে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় আয় বেড়েছে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশের মতো। 

জানা গেছে, বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের প্রধান বাজার ইউরোপের দেশগুলোয় করোনা প্রাদুর্ভাব কমে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে শুরু করায় চাহিদা বেড়ে রফতানিতে নতুন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি মানতে নারাজ দেশীয় চামড়া খাতের উদ্যোক্তারা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চামড়া ব্যবসায়ী শাহীন আহমেদ জানিয়েছে, দেশের নানা সমস্যার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা সুবিধা করতে পারছি না। এ কারণে চামড়ার চাহিদা কম। এ ছাড়া প্রতিবছরই কেনা চামড়া অব্যবহৃত রয়ে যাচ্ছে। এ কারণে চামড়ার দাম কম বলে জানিয়েছেন তিনি। তিনি জানিয়েছেন, এ শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকারি বড় পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সারোয়ার আলম জানিয়েছেন, চামড়া খাতের উন্নয়নে দরকার একটি শিক্ষিত উদ্যোক্তা শ্রেণি। দরকার সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা। দরকার নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন। প্রয়োজন দক্ষ পর্যাপ্ত শ্রমিক। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা পাওয়া গেলে এ খাতের উন্নয়ন খুব বেশি দূরে নয়।

জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, চামড়া বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় খাত। এ খাতের উন্নয়নে সরকার নানা উদ্যোগ নিচ্ছে। গত বছরের তুলনায় কাঁচা চামড়ার দাম বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন দেশে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের বিপুল চাহিদা রয়েছে। আমাদের সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারলে বছরে ৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করা সম্ভব।

/এসআই/এমএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
পোস্তায় চামড়া বেশি এলেও মেলেনি সরকার নির্ধারিত দাম
তিন লাখ ১৯ হাজার চামড়া বিক্রির জন্য প্রস্তুত চট্টগ্রামের আড়তদাররা
দেশ থেকে চামড়া পাচারের সুযোগ নেই: বাণিজ্য সচিব
সর্বশেষ খবর
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কলকাতায় নামতেই পারলো না কেকেআরের বিমান!
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় কলকাতায় নামতেই পারলো না কেকেআরের বিমান!
রাজধানীতে মাদকদ্রব্যসহ একদিনে গ্রেফতার ২৪
রাজধানীতে মাদকদ্রব্যসহ একদিনে গ্রেফতার ২৪
উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ৪১৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
উপজেলা নির্বাচনে প্রথম ধাপে ৪১৮ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
দক্ষিণ আফ্রিকায় ভয়াবহ ভবন ধস, আটকা পড়েছে অনেকে
দক্ষিণ আফ্রিকায় ভয়াবহ ভবন ধস, আটকা পড়েছে অনেকে
সর্বাধিক পঠিত
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব যার হাতে গেলো
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যে শিশুকে পাচারের অভিযোগে মিল্টনের বিরুদ্ধে মামলা
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
ছাত্রলীগ সহসভাপতি সাদ্দামের বছরে আয় ২২ লাখ, ব্যাংকে ৩২ লাখ, উপহারের স্বর্ণ ৩০ ভরি
হরিরামপুর উপজেলা নির্বাচনছাত্রলীগ সহসভাপতি সাদ্দামের বছরে আয় ২২ লাখ, ব্যাংকে ৩২ লাখ, উপহারের স্বর্ণ ৩০ ভরি