X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপদ মাছের সন্ধানে বাংলাদেশ

শফিকুল ইসলাম
২৪ জুলাই ২০২৩, ২৩:৫৯আপডেট : ২৪ জুলাই ২০২৩, ২৩:৫৯

মানুষের খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা পূরণে মৎস্য খাতের অবদান সর্বজন স্বীকৃত। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা উৎপাদন বাড়াতে মাছের খাবারের সঙ্গে খারাপ জিনিস মেশায়। এতে মাছের পুষ্টিগুণ মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক হয়ে ওঠে। এ জন্যই এ বছর থেকে মানুষের জন্য নিরাপদ মাছ উৎপাদনের দিকে নজর দিয়েছে সরকার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানিয়েছে, মাছের খাবারের সঙ্গে মানুষের স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকর কেমিক্যাল মেশানো অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কার্যক্রম শুরু করেছে সরকার। এসব অসাধু ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অনেক জায়গায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খামারিদের সচেতন করা হচ্ছে। স্থানীয় পর্যায়ে ফিশারিজ অফিসাররা আকস্মিক পরিদর্শন করছেন। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

জানা গেছে, ২০৪১ সালে বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৮৫ লাখ মেট্রিক টন নির্ধারণ করা হয়েছে। সোমবার (২৪ জুলাই) থেকে শুরু হওয়া ‘জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ ২০২৩’ উপলক্ষে এবারের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘নিরাপদ মাছে ভরবো দেশ, গড়বো স্মার্ট বাংলাদেশ’। মৎস্য সপ্তাহ চলবে আগামী ৩০ জুলাই পর্যন্ত।

মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০৪১ সালে বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮৫ লাখ মেট্রিক টন, যা বর্তমান উৎপাদনের তুলনায় ১ দশমিক ৮ গুণ বেশি। উৎপাদিত মাছ যাতে মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। ২০২০ সালে মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ আইন করা হয়েছে। সমুদ্র সীমাসহ অন্যত্র যারা মাছ আহরণে সম্পৃক্ত, তাদের প্রতিটি নৌযানে যান্ত্রিক পদ্ধতি সংযোজন করা হচ্ছে। যাতে তাদের মনিটরিংয়ের আওতায় রাখা যায়। পাশাপাশি কোনও মৎস্য নৌযান দুর্ঘটনায় পড়লে, তাদের অবস্থান জানার জন্যও এই পদ্ধতি কাজে লাগানো হচ্ছে। এভাবে মৎস্য খাতে ডিজিটালাইজড পদ্ধতি যুক্ত করা হয়েছে।

এবারের মৎস্য সপ্তাহ উপলক্ষে কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। স্মার্ট মৎস্য খাতে উৎপাদন, বিপণন, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রফতানির প্রক্রিয়ায় স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

সূত্র আরও জানিয়েছে, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাছ উৎপাদন এবং দেশ-বিদেশে সরবরাহের জন্য সরকার দেশে আন্তর্জাতিক মানের পরীক্ষাগার তৈরি করা হয়েছে। পরীক্ষার মাধ্যমে বিদেশিদের চাহিদা অনুযায়ী মাছ রফতানি করা হচ্ছে। অপরদিকে বিদেশ থেকে মাছের জন্য যেসব খাদ্য উপাদান আসে, সেগুলোও পরীক্ষা করা হচ্ছে। যাতে মাছ উৎপাদন, আহরণ ও বিপণনে অস্বাস্থ্যকর কোনও উপাদান প্রবেশ করতে না পারে। শুধু মাছ উৎপাদন নয় বরং স্বাস্থ্যসম্মত ও খাবার উপযোগী নিরাপদ মাছ উৎপাদন সরকারের লক্ষ্য। আগে সরকারের লক্ষ্য ছিল মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি। এখন সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে দেশে স্বাস্থ্যসম্মত ও নিরাপদ মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

মৎস্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, পৃথিবীর ৫২টি দেশে বাংলাদেশের মাছ রফতানি হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় ৭০ হাজার মেট্রিক টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানির মাধ্যমে বাংলাদেশের আয় হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। মাছ রফতানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। গ্রামাঞ্চলে মাছ উৎপাদনের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল হচ্ছে। মৎস্য খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এক কোটি ৯৫ লাখ মানুষ সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে। ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে। মিঠা পানি ও বদ্ধ জলাশয়ের মাছ উৎপাদনেও ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মৎস্য আহরণে বাংলাদেশ এখন তৃতীয়, বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম ও তেলাপিয়া উৎপাদনে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের জলসীমায় প্রচলিত ও অপ্রচলিত মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সরকার কাজ করছে। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ও গবেষকরা ৩৯ প্রজাতির দেশীয় বিলুপ্তপ্রায় মাছ ফিরিয়ে এনেছে। দেশীয় মাছ বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য ময়মনসিংহে লাইভ জিন ব্যাংক করা হয়েছে। জাতীয় মৎস্য সপ্তাহে মুক্ত ও বদ্ধ জলাশয়ে মাছের পোনা অবমুক্তকরণের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মাছ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়া কালচার ২০২২’ প্রতিবেদন অনুযায়ী, চাষের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় অবস্থানে (ছয় বছর ধরে পঞ্চম অবস্থানে ছিল)। এছাড়াও স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। ইলিশ আহরণে প্রথম (বর্তমানে ইলিশের মোট উৎপাদন ৫.৭১ লাখ মেট্রিক টন) অবস্থানে রয়েছে।

মৎস্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে রফতানি করা মৎস্যজাত পণ্যের প্রায় ৭০ ভাগ ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্টস। বাংলাদেশ থেকে সাধারণত আইকিউএফ, কুকড, ফিস ফিলেট ভ্যালু অ্যাডেড মৎস্য জাতীয় পণ্য রফতানি হয়।

জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে মূলত গলদা, বাগদা, হরিণাসহ বিভিন্ন প্রজাতির চিংড়ি, স্বাদু পানির মাছ যেমন- রুই, কাতলা, মৃগেল, আইড়, টেংরা, বোয়াল, পাবদা, কৈ প্রভৃতি এবং সামুদ্রিক মাছের মধ্যে ভেটকি, দাতিনা, রূপচাঁদা, কাটল ফিস, কাঁকড়া রফতানি হয়ে থাকে। এছাড়াও শুঁটকি, মাছের আঁইশ এবং চিংড়ির খোলসও রফতানি হয়ে থাকে। প্রাকৃতিক উৎস থেকে আহরিত কাঁকড়া ও কুঁচিয়া বিদেশে রফতানি করা হচ্ছে।

এদিকে ২৩ জুলাই (রবিবার) মধ্যরাতে উঠে গেছে সমুদ্রে মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা। জেলেরা এখন সাগরে জাল ফেলার কাজে ব্যস্ত। দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় গত ২০ মে থেকে ৬৫ দিন সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছিল সরকার। ২৩ জুলাই পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা ছিল। সামুদ্রিক মাছের প্রধান প্রজননকালে ৬৫ দিন সাগরে মাছ ধরা বন্ধ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হচ্ছে মাছের নির্বিঘ্ন প্রজনন নিশ্চিত করে মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধি করা। এসময় সব বাণিজ্যিক মাছের ট্রলার সমুদ্রে যাওয়া বন্ধ রাখা হয়। যান্ত্রিক ও আর্টিসানাল মাছ ধরার নৌযান ঘাটে বাঁধা থাকে। স্থানীয় প্রশাসন, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড ও সশস্ত্র বাহিনী মাছ ধরা বন্ধ রাখার কাজে সহায়তা করে। কোনও জেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে সমুদ্রে গেলে জেল-জরিমানার পাশাপাশি তার নিবন্ধন বাতিল ও জাল-ট্রলার বাজেয়াপ্ত করারও বিধান রয়েছে। তবে মৎস্য আহরণ বন্ধ থাকার এ সময়ে বেকার হয়ে পড়া সমুদ্রগামী নিবন্ধিত সব জেলেকে সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়।

জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি মাছের বহুমুখী ব্যবহারে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে। মাছ থেকে চিপস, কেকসহ অন্যান্য মৎস্যজাত পণ্য তৈরি করলে মাছের ভোক্তাও বৃদ্ধি পাবে। এভাবে মাছের বহুমুখী ব্যবহার প্রক্রিয়াকে সরকার উৎসাহিত করছে। মাছের বহুমুখী ব্যবহার নিয়ে যারা কাজ করতে চায়, তাদের সহজ শর্তে ও স্বল্প সুদে কৃষি ঋণ দেওয়া হচ্ছে। তাদের উৎসাহিত করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সরকার নানারকম সহায়তা প্রদান করছে।

তিনি জানিয়েছেন, কিছু ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা মাছের খাবারে খারাপ জিনিস মেশায়। তাদের ব্যাপারে অনেক জায়গায় মোবাইল কোর্টের ব্যবস্থা করেছি, খামারিদের সচেতন করেছি। স্থানীয় পর্যায়ে ফিশারিজ অফিসাররা হঠাৎ ভিজিট করছেন। যেখানে এ রকম অবস্থা দেখা যাচ্ছে সেখানেই পদক্ষেপ নিচ্ছি। এক্ষেত্রে আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন তাদের আরও তৎপর হওয়া দরকার।

/এমএস/
সম্পর্কিত
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
কোরবানির পশু আমদানির পরিকল্পনা নেই: প্রাণিসম্পদমন্ত্রী
গবেষণার মাধ্যমে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের আহ্বান প্রাণিসম্পদমন্ত্রীর
সর্বশেষ খবর
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
কেনিয়ায় বন্যায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৮১
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
বিদেশফেরত যাত্রীকে নিয়ে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় ৫ জন নিহত
বিদেশফেরত যাত্রীকে নিয়ে ফেরার পথে ট্রাকচাপায় ৫ জন নিহত
মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত, রাজবাড়ীতে রেল যোগাযোগ বন্ধ
মালবাহী ট্রেন লাইনচ্যুত, রাজবাড়ীতে রেল যোগাযোগ বন্ধ
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!
সিয়াম-পরীর গানের ভিউ ১০০ মিলিয়ন!