X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

দুই কন্যা বেঁচে যাওয়ায় অস্বস্তিতে ছিলেন জিয়াসহ অনেকে

উদিসা ইসলাম
০৯ আগস্ট ২০২৩, ১০:০০আপডেট : ০৯ আগস্ট ২০২৩, ১০:০০

ইতিহাসের পাতায় অশ্রু দিয়ে লেখা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনটি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয় এই দিনে। ভাগ্যক্রমে তার দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেদিন দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে গিয়েছিলেন, সঙ্গে শেখ হাসিনার শিশুসন্তান জয় ও পুতুলও। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে জার্মানিতে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে তাদের দিন কাটছিল, যখন তখন তাদের এই বেঁচে যাওয়া খুনিদের জন্য অস্বস্তির কারণ ছিল। জিয়া একাধিকবার তাদের দেশে ফেরা আটকাতে চেয়েছেন, এমন প্রমাণও রয়েছে।

মৃত্যুর খবরে শত্রু হয়ে ওঠা মানুষ

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ শেখ হাসিনা, তার স্বামী ড. ওয়াজেদ মিয়া আর বোন শেখ রেহানা সেদিন ব্রাসেলসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায় ছিলেন। ব্রাসেলস থেকে তাদের প্যারিসে যাওয়ার কথা থাকলেও সেদিন যেতে পারেননি। ব্রাসেলসের সময় তখন ভোর  সাড়ে ৬টা। সানাউল হকের টেলিফোন বেজে উঠলো। তিনি জানলেন, বাংলাদেশে সেনা বিদ্রোহ হয়েছে সকালে। যে মুহূর্তে মি. হক শুনলেন যে সেনা বিদ্রোহে শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন, তখনই তাঁর দুই কন্যা এবং জামাতাকে কোনও সাহায্য করতে অস্বীকার করলেন। উপরন্তু, নিজের ঘর থেকেও তাদের চলে যেতে বলেন তিনি।

২০১৬ সালে শেখ মুজিবের প্রয়াণ দিবসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ওই ঘটনার কথা স্মরণ করে বলেছিলেন, ‘আমরা যেন ওনার জন্য বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম। অথচ শেখ মুজিবই তাকে বেলজিয়ামে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত করে পাঠিয়েছিলেন। ওটা একটা রাজনৈতিক নিয়োগ ছিল। ওই খবর পাওয়ার পরে জার্মানি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য একটা গাড়ি দিতেও অস্বীকার করেছিলেন তিনি।’

দেশের পাশে দিল্লিতে প্রবাসী জীবন

জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত মি. পুরী ১৯৭৫ সালের ১৯ আগস্ট বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে জানিয়েছিলেন, দিল্লি থেকে নির্দেশ এসেছে—শেখ মুজিবের দুই কন্যা এবং তাদের পরিবারকে সেখানে (ভারতে) পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ২৪ আগস্ট এয়ার ইন্ডিয়ার একটি উড়োজাহাজে করে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বাকি সদস্যরা দিল্লি বিমানবন্দরে নামেন। প্রথমে ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি ‘সেফ হাউসে’ তাদের রাখা হয়েছিল। পরে ডিফেন্স কলোনির একটি ফ্ল্যাটে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের।

৪ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর কন্যারা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আবাস ১ নম্বর সফদরজং রোডে পৌঁছান। দেখা হওয়ার পরে ইন্দিরা গান্ধীকে শেখ হাসিনা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘১৫ আগস্ট ঠিক কী হয়েছিল?’ সেখানে উপস্থিত একজন অফিসার শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, তার পরিবারের আর কেউ জীবিত নেই। চেষ্টা করা হয়েছিল শেখ হাসিনা যে দিল্লিতে আছেন, সেই খবরটা যাতে কেউ না জানতে পারে। তবে বাংলাদেশের সরকার তার অবস্থান জেনে গিয়েছিল।

১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। নতুন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই ‘র’-এর কাজকর্মে খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না। ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে ইন্দিরা গান্ধী আবারও ক্ষমতায় ফিরে এসেছিলেন। সেইসঙ্গে শেষ হয়েছিল শেখ হাসিনার সব দুশ্চিন্তা।

শেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে অস্বস্তিতে ছিলেন জিয়া?

২০১৭ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবসে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে লক্ষ্মীপুরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এ কে এম শাহজাহান কামালের এক প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত আমাদের বিদেশের মাটিতেই পড়ে থাকতে হয়। খুনি জিয়া আমাকে ও আমার বোন শেখ রেহানাকে দেশে আসতে দেয়নি। আমি ও রেহানা দেশে ফিরতে চাইলে আমাদের বাধা দেওয়া হয়। রেহানার পাসপোর্টের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে তা জিয়াউর রহমানের নির্দেশে বর্ধিত করা হয়নি। ওই পাসপোর্টও ফেরত দেওয়া হয়নি।’

দেশে ফেরার পরও নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হওয়ার কথা বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বলেন, ‘দেশে ফিরে আমি যখন ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে প্রবেশ করতে যাই, আমাকে ওই বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পিতামাতা, ভাইয়ের জন্য একটু দোয়া করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। পুলিশি পাহারা ও গেটে তালা দিয়ে আমার পথ রুদ্ধ করা হয়। আমি রাস্তার ওপর বসে পড়ি এবং আমাদের নেতাকর্মীদের নিয়ে মিলাদ ও দোয়া পড়ি। ১৯৮১ সালের ১২ জুন পর্যন্ত ওই বাড়িতে আওয়ামী লীগের কোনও মানুষকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।’ শেখ হাসিনা ফেরার ১৩ দিন পর চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। তারপর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িটি ফেরত পান বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮১ সালের ১২ জুন হঠাৎ করে ১ ঘণ্টার নোটিশে বাড়িটি আমাকে তাড়াহুড়ো করে হস্তান্তর করা হয়।’

১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের পর দীর্ঘদিন সামরিক স্বৈরশাসকরা বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরতে না দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটিই মুছে দিতে চেয়েছিল। জনগণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আমৃত্যু যে অটুট বন্ধন ছিল, সেটিও ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন জিয়া। ফলে প্রবাসে থাকা ‍দুই কন্যার অস্তিত্ব জিয়াউর রহমানের জন্য অস্বস্তির থাকারই কথা বলে মনে করেন গবেষকরা।

বঙ্গবন্ধু হত্যার পরপরই যদি প্রবাসী দুই কন্যা দেশে ফেরার চেষ্টা করতেন, তাহলে তারাও ওই একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন, সেই শঙ্কা ষোলআনা ছিল উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ‘বঙ্গবন্ধু চেয়ার’ ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ষড়যন্ত্রকারী জিয়াউর রহমান তাদের ফিরতে দিতেও চায়নি। কেননা, তারা বিশ্বাস করতো—একজনও যদি বেঁচে থাকে, তাহলে আবারও বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুজ্জ্বল হয়ে উঠবে। কিন্তু চার-পাঁচ বছর পার হওয়ার পরে যখন নির্বাচন করা জরুরি হয়ে পড়লো এবং নানাবিধ চাপের মুখে পড়তে হলো, তখন জিয়াউর রহমান বাধ্য হয়েছিলেন দেশে ফেরার অনুমতি দিতে। কিন্তু এই বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ওপর তারপর থেকে ২০ বার হামলা হয়েছে। সেগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
কাশ্মীর বিরোধ সমাধানে কাজ করতে চান ট্রাম্প
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত‘নাজুক যুদ্ধবিরতি’: বন্দুক নীরব, কিন্তু শান্তি কি টিকবে?
ভারত-পাকিস্তান সংঘাত: শান্তি এলেও ঝুঁকি কাটেনি
সর্বশেষ খবর
তালের শাঁস খেলে এত উপকার পাওয়া যায় জানতেন?
তালের শাঁস খেলে এত উপকার পাওয়া যায় জানতেন?
‘নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ কখনও বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না’
‘নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ কখনও বাস্তবায়ন করতে দেওয়া হবে না’
স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বিজিএমইএ গড়তে চায় ‘ফোরাম’
স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক বিজিএমইএ গড়তে চায় ‘ফোরাম’
১৮ বছরে প্রথমবার ম্যানইউর মাঠে জিতলো ওয়েস্ট হ্যাম
১৮ বছরে প্রথমবার ম্যানইউর মাঠে জিতলো ওয়েস্ট হ্যাম
সর্বাধিক পঠিত
আওয়ামী লীগ কচু পাতার পানি না: কাদের সিদ্দিকী
আওয়ামী লীগ কচু পাতার পানি না: কাদের সিদ্দিকী
ব্যাংকে টাকা আসছে নাকি বের হয়ে যাচ্ছে
ব্যাংকে টাকা আসছে নাকি বের হয়ে যাচ্ছে
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ
বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ
মহাসড়কের পাশে দুই যুবকের লাশ, একজনের গলাকাটা অপরজনের চোখ উপড়ানো
মহাসড়কের পাশে দুই যুবকের লাশ, একজনের গলাকাটা অপরজনের চোখ উপড়ানো