হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার (৭ অক্টোবর) সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি এই টার্মিনালের উদ্বোধন করেন।
এদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে নবনির্মিত টার্মিনাল তিন পরিদর্শন করেন। এসময় বাংলাদেশ বেসামারিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান নতুন এই টার্মিনালের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ঘুরিয়ে দেখান। এসময় বিমান প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তারা তার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন।
নতুন টার্মিনালে অটোমেশন সিস্টেমে কীভাবে বোর্ডিং পাস হবে, তাও করে দেখানো হয়। এসময় প্রধানমন্ত্রীকে একটি ডামি বোর্ডিং পাসও দেওয়া হয়। পরে প্রধানমন্ত্রী ইমিগ্রেশন কাউন্টারও পরিদর্শন করেন। সেখান থেকে তিনি ‘প্রি-বোর্ডিং সিকিউরিটি স্ক্যানিং’ জোনে যান। সেখান থেকে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় বোর্ডিং ব্রিজে। এসময় তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণের বিভিন্ন স্থিরচিত্র দিয়ে সাজানো একটি ফটোগ্যালারি পরিদর্শন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান মঞ্চে যান। এসময় মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, জাপান সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সংসদী ভাইস মিনিস্টার মাশাহিরো কুমুরা, জাপান সরকারের ভূমি অবকাঠামো ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার ইয়োহারা, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী, ঢাকা ১৮ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসান, সামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোকাম্মেল হোসেন ও বাংলাদেশ বেসামারিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান প্রমুখ।
এসময় দর্শক সারিতে প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও সংসদ সদস্যসহ বিশিষ্টজনরা উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ভৌগলিক অবস্থানের কারণে একসময় বাংলাদেশই হবে সারা বিশ্বের যোগাযোগের হাব। কক্সবাজার বা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, এটাই হবে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহনের হাব। সেটাই আমরা বিশ্বাস করি। সেভাবেই আমরা তৈরি করতে চাচ্ছি।’
বিভিন্ন সময়ে আকাশপথে যোগাযোগের রুট পরিবর্তন হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন, একসময় আন্তর্জাতিক হাব ছিল হংকং। এরপর হলো সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, এখন দুবাই। আমি বিশ্বাস করি, একসময় আমাদের কক্সবাজার বা হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর হবে আন্তর্জাতিক হাব। রিফুয়েলিংয়ের জন্য অনেকেই এখানে আসবে, থামবে; বাংলাদেশের সৌন্দর্য উপভোগ করবে। আর কক্সবাজারে নামলে তো আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ বালুকাময় সি বিচ সেটাও সবাই উপভোগ করতে পারবে। সেভাবেই আমরা গড়ে তুলতে চাই।’
বাংলাদেশ বেসামারিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান বলেন, ‘ইতোমধ্যে এই টার্মিনালের প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পের (প্রথম পর্যায়) আওতায় শুধু টার্মিনাল ভবিই নয়, আমদানি ও রফতানি কার্গো ভবনও নির্মাণ করা হয়েছে। করোনার সময়ও টার্মিনালের নির্মাণ কাজ থেমে থাকেনি।’ টার্মিনালের পাশপাশি আমদানি ও রফতানি কার্গো কমপ্লেক্সের নির্মাণ কাজও শেষ পর্যায়ে বলে জানান বেবিচক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, ‘আগামী বছরের মার্চ বা এপ্রিলের দিকে কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার করা যাবে।’
কী আছে তৃতীয় টার্মিনালে? কী কী সুবিধা থাকবে যাত্রীদের জন্য? আসুন, জেনে নেই।
প্রকল্পের নাম: শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)।
কত তলা: তৃতীয় টার্মিনালটি তিন তলা বিশিষ্ট।
প্রথম তলা: ব্যাগেজ হ্যান্ডেলিং সিস্টেম, ভিভিআইপি, ভিআইপি ইত্যাদি।
দ্বিতীয় তলা: বহির্গমন লাউঞ্জ, ক্যান্টিন, বোর্ডিং ব্রিজ।
তৃতীয় তলা: বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, বিদেশগামী যাত্রীদের ইমিগ্রেশন, চেক ইন কাউন্টার, সিকিউরিটি সিস্টেম ইত্যাদি।
ভিভিআইপি যাত্রীদের জন্য: তৃতীয় টার্মিনালে ভিভিআইপি ও ভিআইপি যাত্রীদের জন্য আলাদা করে বিশেষ ব্যস্থাপনা থাকবে। টার্মিনালের দক্ষিণ প্রান্তে ৩ হাজার ৬৫০ বর্গমিটার জায়গাজুড়ে রয়েছে এই আয়োজন।
টার্মিনালের আয়তন: তৃতীয় টার্মিনালের আয়তন ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গ মিটার। বর্তমান দুটি টার্মিনালের আয়তন এক লাখ বর্গ মিটার।
ট্রানজিট: ট্রানজিট যাত্রীরা প্রধান বহির্গমন লাউঞ্জ ব্যবহার করবে, যার আয়তন ৪০ হাজার বর্গ মিটার।
যাত্রী ধারণ ক্ষমতা: তৃতীয় টার্মিনালের যাত্রী ধারণ ক্ষমতা বছরে এককোটি ৬০ লাখ। বর্তমানে দুটি টার্মিনালে বছরে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৮০ লাখ।
আগমনী যাত্রীদের জন্য লাগেজ বেল্ট: তৃতীয় টার্মিনালে যাত্রীদের লাগেজ বেল্ট থাকবে ১৬টি। বর্তমানে দুটি টার্মিনালে লাগেজ বেল্ট আছে ৮টি।
আগমনী যাত্রীদের জন্য কাস্টম: বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বর্গমিটার আয়তনের একটি কাস্টম হল থাকবে। সেখানে ৬টি চ্যানেল থাকবে।
চেক ইন কাউন্টার: তৃতীয় টার্মিনালে চেক ইন কাউন্টার থাকবে ১১৫টি, এরমধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি।
ইমিগ্রেশন কাউন্টার: তৃতীয় টার্মিনালে ইমেগ্রেশন কাউন্টার মোট ১২৮টি। এরমধ্যে স্বয়ংক্রিয় ১৫টি। মোট ১২৮টি কাউন্টারের মধ্যে বহির্গমন ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৬৬টি, আগমনী ইমিগ্রেশন কাউন্টার ৫৯টি এবং ভিভিআইপি ৩টি।
বোর্ডিং ব্রিজ: বর্তমান দুটি টার্মিনালে আছে ৮টি বোর্ডিং ব্রিজ। তৃতীয় টার্মিনালে প্রথম পর্যায়ে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ থাকবে। পরবর্তী সময়ে আরেকটি সম্প্রসারণ প্রকল্পের আওতায় আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ যুক্ত করা হবে।
লিফট: ৪১টি। এরমধ্যে প্যাসেঞ্জার লিফট ৩৪টি ও সার্ভিস লিফট ৭টি
এসকেলেটের: ৩৫টি, মুভিং ওয়াকওয়ে: ১৪টি
হোল্ড ব্যাগেজ এক্সরে মেশিন: ২৭টি, কেবিন ব্যাগেজ এক্সরে মেশিন: ৪০টি
বডি স্ক্যানার: ১১টি, মেটাল ডিটেক্টর: ৫২টি
উড়োজাহাজ পার্কিং বে: বর্তমানে আছে ২১টি। তৃতীয় টার্মিনালে পার্কিং বে রয়েছে ৩৭টি।
মাল্টি লেভেল কার পার্কের ধারণ ক্ষমতা: বর্তমানে বহুতল কার পার্কি ভবনে ৩০০টি গাড়ি রাখা সম্ভব। তৃতীয় টার্মিনালের কার পার্কিংয়ে ১২৩০টি গাড়ি রাখা যাবে।
আমদানি কার্গো ভবনের আয়তন: বর্তমান কার্গো ভবনের আয়তন ১৩ হাজার ৭০০ বর্গমিটার। নতুন টার্মিনালের ভবনের আয়তন ২৭ হাজার বর্গমিটার।
আমদানি কার্গো ভবনের ধারণ ক্ষমতা: বর্তমান ভবনের ধারণ ক্ষমতা বছরে ৮৪ হাজার ৩৭৯ টন। নতুন ভবনের ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ ৭৩ হাজার ৪৭০ টন।
রফতানি কার্গো ভবনের আয়তন: বিদ্যমান ভবনের আয়তন ১৯ হাজার ৬০০ বর্গমিটার। নতুন ভবনের আয়তন ৩৬ হাজার বর্গ মিটার।
রফতানি কার্গো ভবনের ধারণ ক্ষমতা: বর্তমানে বছরে ধারণ ক্ষমতা ২ লাখ ৪৬০ টন। নতুন ভবনে ধারণ ক্ষমতা ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৪১ টন।
অন্য টার্মিনালের সঙ্গে সংযোগ: বর্তমানের দুটি টার্মিনালের সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের কোনও সংযোগ থাকবে না। তবে পরবর্তী সময়ে প্রকল্পে করিডোর নির্মাণ করা হবে।
সড়কের সঙ্গে তৃতীয় টার্মিনালের সংযোগ: ঢাকা- ময়মনসিংহ হাইওয়ের সঙ্গে মূল সড়ক ছাড়াও এলিভেটেড ড্রাইভওয়ের মাধ্যমে যুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া মেট্রোরেলের একটি স্টেশন মাটির নিচে করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেল স্টেশনের সংযোগের জন্য টানেল নির্মাণ করা হয়েছে।