রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেছেন, প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট (পিজিআর) প্রতিষ্ঠার মাত্র ৪২ দিনের মাথায় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী ঘাতকচক্রের হাতে ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হন। সেদিন আমরা তাকে রক্ষা করতে পারিনি। জাতি হিসাবে সেটা ছিল আমাদের চরম ব্যর্থতা। আমরা আমাদের জাতির পিতাকে, আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টাকে রক্ষা করতে পারিনি, সেটা ছিল আমাদের অমার্জনীয় অপরাধ। সেদিন যদি পিজিআর আজকের মতো সুসংগঠিত ও চৌকস হতো, তাহলে হয়তো বা ১৫ আগস্ট কালরাতে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করতে পারতো না ঘাতক দল। বঙ্গবন্ধুকে আমাদের অকালে হারাতে হতো না। বাঙালি ও বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ইতিহাস অন্যরকম হতে পারতো। দেশ পরিণত হতো জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায়।
শনিবার (৬ জুলাই) প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পিজিআরে কর্মরত সব অফিসার, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং অন্যান্য পদবির সদস্যদের উদ্দেশ্যে দরবারে এসব কথা বলেন তিনি।
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি খাতে সুনির্দিষ্ট উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে কাজ শুরু করেন। অর্থনৈতিক সংস্কার ও পুনর্গঠনের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর উন্নয়নে এবং জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতেও বঙ্গবন্ধু যুগোপযোগী কর্মসূচি নিয়েছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যেই দেশ অনুন্নত থেকে স্বল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়। অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রীয় অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই দিনটি প্রতিটি গার্ডস সদস্যের কাছে বিশেষ। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য একজন কর্মী হিসাবে তাঁর হাতে গড়া পিজিআরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দরবারে বক্তৃতা করতে পারা আমার কাছে অনেক মর্যাদার, অনেক আবেগ ও আনন্দের। তাই আজকের দরবারে আসতে পেরে আমি গর্বিত। যে নেতার নেতৃত্বে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে কথা বলি, সে নেতার হাতে গড়া পিজিআরের সদস্য হিসাবে আপনারা দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করছেন। নিঃসন্দেহে এটি খুবই আনন্দ ও গৌরবের একটি বিষয়। এজন্য সব সময় নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবেন।
পিজিআর সদস্যদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা প্রদান এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রাচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আপনাদের অন্যতম গুরুদায়িত্ব। আপনাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ অন্যদিকে তেমন গৌরবময়। আপনাদের সাফল্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি জাতিকেও গৌরবান্বিত করে। বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ছাড়াও অনেক দেশের ভিআইপি ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আপনারা দেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করেছেন। একটি সুশৃঙ্খল, পূর্ণাঙ্গ এবং স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টকে বর্তমান অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করার কারিগর হিসেবে প্রাক্তন সদস্যদের অবদানকে আমি শ্রদ্ধাসহ স্মরণ করছি।
রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধানে পিজিআরকে একটি অনন্য প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, পিজিআরের সার্বিক উন্নয়নকে সরকার অগ্রাধিকার দেয়। আপনাদের দায়িত্বের পরিধির বিস্তৃতি বিবেচনায় প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের সাংগঠনিক কাঠামো ইতোমধ্যে বাড়ানো হয়েছে। ভবিষ্যতেও এই রেজিমেন্টকে আরও সুসংহত ও আধুনিক করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে। পিজিআরের উত্তরোত্তর উন্নয়ন ও কল্যাণে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আমার আন্তরিকতা ও সহযোগিতা সব সময় আপনাদের সঙ্গে থাকবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট আমাদের গর্বের সেনাবাহিনীরই আরেকটি বিশেষায়িত অংশ। আপনারা একটি ঐতিহ্যবাহী ও বিশেষ রেজিমেন্টের গর্বিত সদস্য। দায়িত্ববোধ, পেশাগত উৎকর্ষ, দেশপ্রেম ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে আপনাদের প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের সুনাম দেশের গন্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে দিতে হবে। আপনাদের একাগ্রতা, শৃঙ্খলাবোধ এবং সর্বোপরি কর্তব্যের প্রতি সচেতনতা ও দক্ষতায় আমি মুগ্ধ। আপনারা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে দিন-রাত নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকেন। বৈরি আবহাওয়া বা পরিস্থিতি কোনও কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে আপনাদের গভীর দেশপ্রেম, কর্তব্যবোধ, উন্নত শৃঙ্খলা ও একনিষ্ঠতা আমাকে গর্বিত করেছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে আধুনিকায়ন, সম্প্রসারণ এবং প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে ফোর্সেস গোল-২০৩০ এর আলোকে তিনটি নতুন ডিভিশনসহ বিভিন্ন ফরমেশনের অধীনে ব্রিগেড, স্পেশাল ওয়ার্কস অরগানাইজেশন এবং ছোট বড় ৫৮টি ইউনিট প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। সম্প্রতি মাওয়া-জাজিরাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ রাসেল সেনানিবাস। এছাড়াও মিঠামইন, রাজবাড়ী এবং ত্রিশালে নতুন সেনানিবাস স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টেও অত্যাধুনিক অস্ত্র এবং বিবিধ সরঞ্জামের অর্ন্তভুক্তি ঘটেছে। যা এই রেজিমেন্টের অপারেশনাল এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবার উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, সমসাময়িক বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা আজ একটি বহুমাত্রিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নতুন নতুন তথ্য প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ এই বহুমাত্রিকতাকে আরও বেশি বিস্তৃত করেছে। তাই এ বিষয়ে আপনাদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে আরও শাণিত করার প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন অত্যাধুনিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণ। আমি জানি আপনারা প্রশিক্ষণকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। আপনাদের পেশাগত মান ও দক্ষতাকে আরও বিকশিত ও বিশ্বমানে পৌঁছাতে বিদ্যমান প্রশিক্ষণ কর্মসূচিকে প্রয়োজনে আরও জোরদার করতে হবে। কথায় আছে, ভবিষ্যত সাফল্য অর্জন করতে হলে অতীত সম্পর্কেও যথেষ্ট জ্ঞান রাখতে হবে। তাই একটি পেশাদার সেনাবাহিনীর অংশ হিসাবে সমসাময়িক বাস্তবতার পাশাপাশি অতীত ইতিহাস ও ঘটনাপ্রবাহ থেকেও আপনাদের অনেক কিছু শিখতে ও জানতে হবে। অতীত ও বর্তমানের সোপান বেয়েই আমাদের আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।
প্রতিষ্ঠাকাল থেকে অদ্যাবধি প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের সদস্যরা কর্তব্য পালনে আত্মত্যাগের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, আগামীতেও আপনারা কর্তব্যপরায়ণতা ও নিষ্ঠায় অটল থেকে এবং চেইন অব কমান্ডের প্রতি আস্থাশীল থেকে আপনাদের ওপর অর্পিত যেকোনও দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবেন। আপনারা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবেন, শৃঙ্খলা বজায় রাখবেন, আত্মোন্নয়নে মনোযোগী হবেন এবং সর্বোপরি সৈনিক হিসেবে নিজের শারীরিক যোগ্যতাকে সর্বদা অক্ষুণ্ণ রাখবেন। মনে রাখবেন, দেশ ও জাতি যে মহান দায়িত্ব আপনাদের ওপর অর্পণ করেছে, সেই দায়িত্ব পালনে যেকোনও আত্মত্যাগ জাতির ইতিহাসে আপনাদের চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, যথাযথ উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে শনিবার (৬ জুলাই) প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের (পিজিআর) ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী (প্রথম দিন) পালিত হয়। ১৯৭৫ সালের ৫ জুলাই স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনায় গঠিত হয় প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্ট। ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন সকালে পিজিআর সদর দফতরে পোঁছালে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিব এবং পিজিআর কমান্ডার।
পরে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন পিজিআরের কোয়ার্টার গার্ড পরিদর্শন শেষে পরিদর্শন বইয়ে সই করেন এবং এই রেজিমেন্টের অফিসার ও জেসিওদের সঙ্গে কুশলাদি বিনিময় করেন। এরপর তিনি শহিদ ক্যাপ্টেন হাফিজ হলে পিজিআরে কর্মরত সব অফিসার, জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার এবং অন্যান্য পদবির সদস্যদের উদ্দেশে দরবারে বক্তব্য রাখেন। তিনি পিজিআর সদস্যদের একাগ্রতা, নিষ্ঠা, শৃঙ্খলাবোধ ও পেশাগত দক্ষতার প্রশংসা করেন এবং সর্বদা নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থেকে অর্পিত দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য নির্দেশ দেন।