X
রবিবার, ২২ জুন ২০২৫
৭ আষাঢ় ১৪৩২
নতুন বাজেট পাস হচ্ছে আজ          

কালো টাকা নয়, থাকছে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ নামে 

শফিকুল ইসলাম
২২ জুন ২০২৫, ০০:০১আপডেট : ২২ জুন ২০২৫, ০০:০১

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন মহলের ব্যাপক সমালোচনার প্রেক্ষিতে সরকার ‘কালো টাকা’ নামে নয়, ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ নামে অবৈধ টাকা সাদা করার সুযোগ রাখছে। এছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি, বিপর্যস্ত আর্থিক খাত সংস্কার ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের মতো চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে রবিবার (২২ জুন)  পাস হচ্ছে ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’ শিরোনামে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট। উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন ও  রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির পর এই বাজেট ১ জুলাই থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য কার্যকর হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়,  রবিবার বেলা ১০টায় তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে অনুষ্ঠেয় উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে অনুমোদন করা হবে নতুন বাজেট। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈঠকে সভাপত্বি করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন। দেশে বর্তমানে জাতীয় সংসদ কার্যকর না থাকায় এই প্রক্রিয়ায় বাজেট অনুমোদন করা হচ্ছে।

মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, এ বছর সংসদ কার্যকর না থাকায় সরকার সাধারণ নাগরিকদের কাছ থেকে বাজেটের বিষয়ে মতামত গ্রহণ করে। ১৯ জুন পর্যন্ত অনলাইনে এই মতামত গ্রহণ করা হয়। যার সমন্বিত প্রতিবেদন রবিবারের বৈঠকে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে।

এর আগে গত ২ জুন বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’ শীর্ষক অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। নতুন বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা— যা চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৬) মূল বাজেটের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। এটি বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে সংকোচনমূলক বাজেট।

সূত্র জানিয়েছে, এ বছর বাজেটে আবাসন খাতে থাকছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। তবে তা ‘কালো টাকা’ নামে নয়— অপ্রদর্শিত অর্থ নামে। বাজেট ঘোষণার পর ব্যাপক সামলোচনার প্রেক্ষিতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি নগদ অর্থ, বন্ড বা সিকিউরিটিজ, আমানত, আর্থিক স্কিম ও যন্ত্রপাতিসহ সম্পদের ওপর ১৫ শতাংশ কর দিয়ে অবৈধ আয়কে বৈধ করার বিধান বাতিল করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। তবে ফ্ল্যাট ও জমি কেনার ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার বিধান বাতিল করেনি কর প্রশাসন। তাই এক্ষেত্রে কোনও  প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে নাগরিকদের অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে পরপর দুই বছর আয়ের উৎস নিয়ে  প্রশ্নের মুখোমুখি না হয়ে করদাতাদের অপ্রদর্শিত সম্পদ বৈধ করার সুযোগ দিয়েছে এনবিআর। ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করদাতারা নির্দিষ্ট পরিমাণ কর দিলে সম্পত্তির আকার ও অবস্থানের ওপর নির্ভর করে নির্দিষ্ট পরিমাণ কর পরিশোধ করলে অর্থের উৎস বিবেচনা করবে কর্তৃপক্ষ বলেও বিধান রাখা হয়েছে।

এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৫ হাজার ৫২২ কোটি কালো টাকা সাদা করা হয়েছে। সেখানে এনবিআর মোট ৪ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা কর পেয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ২০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা সাদা করা হয়েছে। ওই অর্থ বছরে এনবিআর কর পেয়েছে ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর আগে, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার জরিমানা পরিশোধের শর্তে কালো টাকা বৈধ করার সুযোগ দেয়। ওই বছর ৯ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা সাদা করা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সুদ পরিশোধে এক লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। নতুন অর্থবছরে বেতন, ভাতা ও ভর্তুকির মতো খরচ চলতি অর্থবছরের মতোই অপরিবর্তিত রয়েছে। বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশের নিচে রাখা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ঋণের সুদ পরিশোধ করতে খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায় কম হওয়ায় বাজেটের আকার ছোট করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।

সূত্রমতে, বাজেটে সব পণ্যে ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বসানোর সিদ্ধান্ত থাকছে। বর্তমানে অসমভাবে ভ্যাট বসানো রয়েছে। কর ছাড় কমিয়ে নতুন কর ব্যবস্থা ও প্রশাসনিক উন্নতির মাধ্যমে অতিরিক্ত ৩০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে রাজস্ব বোর্ড। আগামী অর্থবছরের জন্য বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট প্রাপ্তি প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৯ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিয়ন্ত্রিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ১৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। এছাড়া এনবিআর-বহির্ভূত কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ১৯ হাজার কোটি টাকা এবং কর ব্যতীত প্রাপ্তির (এনটিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে বৈদেশিক অনুদানের প্রত্যাশা করা হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা।

আগামী বছরের জন্য সরকার প্রস্তাবিত নতুন বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি পূরণে নতুন বাজেটে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে মোট ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং বৈদেশিক উৎস থেকে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে ঘাটতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। এটি ছিল জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

প্রস্তাবিত বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এটি বলবৎ থাকছে। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ।  আগামী অর্থবছর শেষে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায় সরকার। চলতি অর্থবছরেও একই লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, বিদ্যমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির পরিপ্রেক্ষিতে নীতিগতভাবে সরকার বিদ্যুতের মূল্য আপাতত না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন মহল। বর্তমানে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির পরিমাণ জিডিপির প্রায় ১ শতাংশ, যা অনেক বেশি। এটি ক্রমে কমাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ১০ শতাংশ কমানোর পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এটি করতে পারলে ১১ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যাবে। বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি পর্যালোচনা করা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।

নতুন বাজেট সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, অল্প কয়েক মাসে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে স্থিতিশীল করার কাজটি প্রায় সম্পন্ন করা সম্ভব হলেও পরিপূর্ণ সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছুতে আমাদের এখনও অনেকটা পথ পেরোতে হবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি হ্রাস পাওয়ার প্রবণতা দেখা গেলেও তা এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাষ্ট্র আরোপিত অতিরিক্ত শুল্কের নেতিবাচক প্রভাবও দেশের অর্থনীতির ওপর পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া, সম্প্রতি যে বাজারভিত্তিক মুদ্রা বিনিময় হার চালু করা হয়েছে, তার কোনও নেতিবাচক প্রভাব আপাতত বাজারের ওপর পড়ার সম্ভাবনা না থাকলেও— এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হচ্ছে। এ সবঝুঁকি মোকাবিলা করে দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বৈষম্যহীন ও টেকসই ভিত্তি নিশ্চিত করা এখন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, বলেন ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। 

‘আপাতত প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির বদলে অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে আমরা অধিকতর মনোযোগ দিচ্ছি’, বলে জানান অর্থ উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান। আগামীর সেই বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত জীবন এবং সব স্তরে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান হবে আমাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য পূরণে আমি আপনাদের সবার সহযোগিতা চাই। ইনশাআল্লাহ্, আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের সব মুক্তিকামী মানুষের জন্য এক অনুকরণীয় আলোকবর্তিকা।’

/এপিএইচ/
সম্পর্কিত
থ্রি জিরো তত্ত্বকে বাস্তবায়ন করতে গণঅভ্যুত্থান হয়নি: ফরহাদ মজহার
হতাশার বাজেট, প্রত্যাশা বাস্তবায়ন হয়নি: ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
আগামী দুই শনিবার খোলা থাকবে এনবিআরের সব দফতর
সর্বশেষ খবর
ডি ক্রুইফ বলছেন, ‘আমি আলোচনা সম্পর্কে জানি’
ডি ক্রুইফ বলছেন, ‘আমি আলোচনা সম্পর্কে জানি’
অটোস্ট্যান্ড দখল নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের বিরোধে বৃদ্ধকে কুপিয়ে হত্যা
অটোস্ট্যান্ড দখল নিয়ে বিএনপির দুই পক্ষের বিরোধে বৃদ্ধকে কুপিয়ে হত্যা
হাজারীবাগে ভয়াবহ আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৪ ইউনিট
হাজারীবাগে ভয়াবহ আগুন, নিয়ন্ত্রণে ৪ ইউনিট
১০ বছর পর আলোচনায় ডি ক্রুইফ ও রেনে কোস্টার
১০ বছর পর আলোচনায় ডি ক্রুইফ ও রেনে কোস্টার
সর্বাধিক পঠিত
ট্রাম্পের সমালোচনার পর ইরান নিয়ে সুর পাল্টালেন তুলসি গ্যাবার্ড
ট্রাম্পের সমালোচনার পর ইরান নিয়ে সুর পাল্টালেন তুলসি গ্যাবার্ড
ট্রাম্পের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন মোদি, জানালেন কারণ
ট্রাম্পের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন মোদি, জানালেন কারণ
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র, মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট মানছেন না ট্রাম্প
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র, মার্কিন গোয়েন্দা রিপোর্ট মানছেন না ট্রাম্প
‘জুলাই যোদ্ধাকে’ মারধরের অভিযোগে এসআই বরখাস্ত
‘জুলাই যোদ্ধাকে’ মারধরের অভিযোগে এসআই বরখাস্ত
থানায় থাকা ট্রাঙ্কের তালা খুলে বের করা হয় এইচএসসির প্রশ্নপত্র
থানায় থাকা ট্রাঙ্কের তালা খুলে বের করা হয় এইচএসসির প্রশ্নপত্র