X
রবিবার, ১১ মে ২০২৫
২৮ বৈশাখ ১৪৩২

ডায়েরি থেকে রেশমাকে উদ্ধারের অভিযান

এস এম নূরুজ্জামান
২৪ এপ্রিল ২০১৭, ০৯:২৮আপডেট : ২৪ এপ্রিল ২০১৭, ০৯:৪৭

উদ্ধারের পর রেশমা (ছবি- সংগৃহীত) সেদিন ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজ শেষ হয়েছে। দর্শনার্থী ও গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। চারপাশে কেবল নিরাপত্তাকর্মীদের নজরদারি আর ধ্বংসস্তুপের ওপর উদ্ধারকর্মীদের তৎপরতা। প্রতিদিনের মতো ওইদিন আশপাশে আর তেমন কোনও লোকজনের ভিড় ছিল না। ধ্বংসস্তুপের ওপরে ছাদ সরানোর কাজে ব্যস্ত ছিল ভারী যন্ত্র ভেকু ও হ্যামার ড্রিলমেশিন। হ্যামার ড্রিলমেশিনের সহায়তায় ছাদ ফুটো করা হচ্ছিল। যাতে ধ্বংসস্তূপ থেকে ছাদের কাটা অংশ সহজেই ভেঙে সরানো যায়।

ঘড়ির কাঁটা তখন বিকাল ৩টার ঘরে। প্রচণ্ড ভ্যাপসা গরমে অস্বস্তি লাগছিল। হাঁটতে হাঁটতে সড়কের পাশে সেনা টেন্টের কাছে গেলাম। সেখানে বসে উদ্ধার অভিযান তদারক করছিলেন মেজর মোয়াজ্জেম। আগে থেকেই গুঞ্জন চলছিল, আর কোনও জীবিত কিংবা মৃত উদ্ধারের সম্ভাবনা নেই। তাই যে কোনও সময় বড় অভিযানের মাধ্যমে উদ্ধারকাজের সমাপ্তি ঘটবে।

এমন গুঞ্জনের বিষয়ে মেজর মোয়াজ্জেমের কাছে জানতে চাইলাম, ধ্বংসস্তূপে আর কোনও মৃতদেহ আছে কিনা। কিংবা এখনও তারা জীবিত উদ্ধারের আশা করেন কিনা। আমার প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহূর্ত অপলক তাকিয়ে থাকলেন মেজর মোয়াজ্জেম। এরপর বললেন, ‘আচ্ছা আপনি একটু ঘুরে দেখে আসুন তো। তারপর আপনিই সিদ্ধান্ত নেন ওখানে কোন জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা আছে কিনা।’

মেজরের কথা শুনে একটু খটকা লাগলো। আবার মনে মনে খুশিই হয়েছি। কারণ ঘুরে দেখার সুযোগ তো পেলাম! সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি। আমার লক্ষ্য ছিল পাশের ভবনের নিচতলা দিয়ে রানা প্লাজার গ্রাউন্ড ফ্লোরের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা।

মেজরের সবুজ সংকেত পেয়েই ঢুকতে চাইলাম পাশের ভবনে। কিন্তু সেনা সদস্যরা আটকে দিলেন। মেজরের কথা বলার পর তারা যেতে দিলেন ঠিকই, কিন্তু রানা প্লাজার গ্রাউন্ড ফ্লোরের কাছে ভিড়তে দিলেন না সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীরা। এবার মেজরের কথা বলেও কাজ হলো না। তারা সাফ বলে দিলেন, ‘স্যারকে সঙ্গে নিয়ে আসেন।’

রানা প্লাজায় আহতদের উদ্ধার (ছবি- সংগৃহীত) বাধ্য হয়ে মেজর মোয়াজ্জেমের কাছে গেলাম আবার। তাকে বললাম, আমি তো কিছুই দেখতে পেলাম না। তারা তো ভেতরে যেতে দিলেন না। এবার তিনি বললেন, ‘আপনি প্রেসের আরও কয়েকজনকে ডেকে নিয়ে আসেন, আমি নিজেই ঘুরিয়ে দেখাবো।’ এরপর বাইরে বেরিয়েই সড়কে দেখা হলো সমকালের সহকর্মী শাহাদাত হোসেন পরশ ও সাভার প্রতিনিধি গোবিন্দ আচার্য এবং একুশে টেলিভিশনের একজন সংবাদকর্মীর সঙ্গে। তাদের সঙ্গে বিষয়টি ভাগাভাগি করলাম। সবাই মিলে গেলাম মেজরের কাছে।

চার জনকে একসঙ্গে নিয়ে মেজর মোয়াজ্জেম ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে হাঁটতে লাগলেন। ওপর থেকে গ্রাউন্ড ফ্লোর পর্যন্ত যেখানে চারকোনা গর্ত কাটা হয়েছিল, সেটার কিনারে গিয়ে থামলেন। গর্তের নিচের দিকে তাকিয়ে মেজর মোয়াজ্জেম বলছিলেন, ‘দেখেন পানির স্তর কত উপরে উঠে এসেছে। ভবনের বেজমেন্টে পানি ঢুকেছে। পানি উপচে দোতলা পর্যন্ত ছুঁই ছুঁই করছে। এ অবস্থায় কীভাবে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করবো আপনারাই বিচার করুন।’

অর্থাৎ আর কোনও জীবনের অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নই আসে না। মেজর মোয়াজ্জেম সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষণ নির্বিঘ্ন করতে হ্যামার ড্রিলমেশিন ও ভেকু চালানো বন্ধ করতে বলেন। মেশিনের শব্দ থেমে গেলে হঠাৎ চারকোনা গর্তের ফাঁক গলে কাঠির মতো কিছু একটা নড়ে ওঠে। ফায়ার সার্ভিসের এক উদ্ধারকর্মী চিৎকার দিয়ে বলেন, ‘জীবিত মানুষের মতো কাউকে দেখা যাচ্ছে!’

এরপর মেজর আমাদের হাত ধরে টেনে গর্তে নামিয়ে বলেন, ‘দেখেন, দেখেন!’ উদ্ধারকর্মীরা নড়েচড়ে ওঠা স্থানটি আরও পরিষ্কার করতে লাগলেন। ছিদ্রটি বড় হতে থাকলে ভেতরে দুটি কালচে চোখের ওপর নজর পড়লো। সেই চোখ জোড়া শুধু পিট পিট করছিল। এরপর আমার শরীর নিথর হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পরেই লোকজনের হুড়োহুড়িতে সম্বিত ফিরে পেয়ে গর্ত থেকে উঠে দাঁড়াই। ততক্ষণে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে চারপাশ। হঠাৎ গণমাধ্যমকর্মীদের স্রোত তৈরি হয় সেখানে। ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। এরপরই শুরু হয় শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান।

রানা প্লাজা ধসের শুরু থেকে টানা ১৭ দিনে যতো লাশ গুনেছি, যতো আহতজনের আর্তনাদের কণ্ঠ শুনেছি, সেই কষ্ট আর বেদনার যেমন অনুভূতি, তার চেয়ে আরও নির্মম অনুভূতি সক্রিয় হয়ে ওঠে আটকে পড়া শাহীনার উদ্ধার অভিযানের কথা মনে পড়ে। যে শাহীনাকে জীবিত উদ্ধারের অপেক্ষায় ছিলেন দেশের কোটি কোটি মানুষ। শেষ পর্যন্ত টানা ১০০ ঘণ্টা লড়াই করে মৃত্যুর মিছিলে যুক্ত হন তিনি। উদ্ধারকর্মী থেকে শুরু করে সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায় নেন শাহীনা।

শেষ পর্যন্ত কি রেশমা নামের এই মেয়েটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হবে? নাকি শাহীনার মতো পরিণতি হবে তার? এমন প্রশ্ন ভাবতে ভাবতে কখন যে অজান্তে দুই হাত তুলে মোনাজাত শুরু করেছি, কখন যে তার জন্য প্রার্থনায় চোখ ভিজে উঠেছে বুঝতে পারিনি। টের পাওয়ার নিজেই লজ্জিত হলাম! ভাবছিলাম— আরে, আমার চোখে পানি কেন? আমি তো এখানে রিপোর্ট করতে এসেছি। তারপর ধীরে ধীরে আবার কাগজ-কলম বের করে নোট লেখা শুরু করেছি।

আরও পড়ুন-
রানা প্লাজা ধসের ৪ বছর: আজও শঙ্কা কাটেনি আহত শ্রমিকদের

রানা প্লাজা ধস: পঙ্গুত্বের কারণে ভেঙেছে অনেকের সংসারও

রানা প্লাজার তিন মামলা: বিচার বিলম্বিত যে কারণে

শত বাধা আর কষ্টেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারা

/জেএইচ/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার আগে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে বললেন জেলেনস্কি
রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনার আগে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে বললেন জেলেনস্কি
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
বেসরকারি ব্যাংক সরকারি মালিকানায় নেওয়া যাবে, অধ্যাদেশ জারি
আমের এই আচার বানিয়ে ফেলা যায় তেল ছাড়াই
আমের এই আচার বানিয়ে ফেলা যায় তেল ছাড়াই
২০২২ সালের খসড়া চুক্তিকে কেন্দ্র করে শান্তি আলোচনা চায় রাশিয়া
২০২২ সালের খসড়া চুক্তিকে কেন্দ্র করে শান্তি আলোচনা চায় রাশিয়া
সর্বাধিক পঠিত
আরও কমলো স্বর্ণের দাম
আরও কমলো স্বর্ণের দাম
ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা
ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান উপদেষ্টার বার্তা
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
ব্যাংকে টাকা আসছে নাকি বের হয়ে যাচ্ছে
ব্যাংকে টাকা আসছে নাকি বের হয়ে যাচ্ছে
বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ
বিচারের আগ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ