কেবল তথ্যপ্রযুক্তি আইনে নয়, অন্য কোনও আইনেও ৫৭ ধারার মতো কোনও ধারা সংযুক্ত হওয়া উচিত না। মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়ার পর যদি মুখে কথাই বলতে না দেন, তাহলে তো মনুষ্যত্বকেই অস্বীকার করা হবে। ‘সাইবার অপরাধ ও আইন’ শীর্ষক বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকিতে বক্তারা এসব কথা বলেন। তারা মনে করছেন, আইনের এই ধারাটি থাকা উচিত নয়। কারণ এটি মানুষের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছে।
বাংলা ট্রিবিউন কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকিতে বক্তারা বলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটির জন্য আইন থাকা যেমন জরুরি, তেমনই মানুষের বাকস্বাধীনতাও নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গিয়ে বাকস্বাধীনতাকে স্থবির করে দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই।
মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় বৈঠকিতে অংশ নেন আইসিটি বিভাগের যুগ্ম সচিব আবুল মনসুর মোহাম্মদ সার্ফ উদ্দীন, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ফাহিম মাশরুর, আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম, সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) সহকারী অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন ও বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ।
আইসিটি বিভাগের যুগ্ম সচিব আবুল মনসুর মোহাম্মদ সার্ফ উদ্দীন তার আলোচনায় বলেন, ৫৭ ধারার মতো ধারা থাকা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। তবে এর অপব্যবহার যেন না হয়, সেদিকেও নজর দিতে হবে। নতুন ডিজিটাল আইন বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ডিজিটাল সিগনেচার হলো ডিজিটাল আইডেনটিটি। সেটাকে কিভাবে নিরাপত্তা দেওয়া যায়, সেই কথা ভেবেই সংশ্লিষ্ট অপরাধের দণ্ড নির্ধারিত হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘৫৭ ধারা থাকবে কি থাকবে না, সেটি সরকারের নীতিনির্ধারণের বিষয়। তবে আমরা বলছি, যেন ব্যপ্তিটা মাথায় রেখে আইনটি করা হয়।’
সব বিষয়কে আইন দিয়ে নয়, কিছু বিষয়কে সামাজিক সচেতনতা নিয়ে সামাল দিতে হয় বলে বৈঠকিতে মন্তব্য করেন তথ্যপ্রযুক্তিবিদ ফাহিম মাশরুর। তিনি বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তিতে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এই খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়কেই আমাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছিল না। এ কারণেই আইনটি করা হয়েছিল আমাদের বলা হয়েছে। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতায় কিছু বিষয় আইন দিয়ে না, সামাজিক সচেতনতা দিয়ে সামাল দিতে হবে।’
ফাহিম মাশরুর বলেন, ‘মানতেই হবে সাইবার অপরাধ এমন জায়গায় চলে যাচ্ছে যে এগুলোকে থামানোর জন্য উদ্যোগ দরকার। কিন্তু তাই বলে ৫৭ ধারার মতো ধারা থাকা উচিত না। ভুলে গেলে চলবে না, ট্রলিং সবখানেই হয়, সবাই প্রতিক্রিয়া দেখায় না। এ বিষয়টিকে সামাজিক সচেতনতা দিয়ে সামাল দিতে হবে। এসবকে নিয়ে মেতে থাকলে সাইবার অপরাধ সামলানোর মূল যে উদ্যোগ, সেটাই বাধাগ্রস্ত হয়।’
আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বৈঠকিতে বলেন, ‘সংবিধান বলছে, কোনও আইন একই অবস্থায় দু’জনকে দু’ধরনের শাস্তি দিলে সেটি অবৈধ। সেক্ষেত্রে এই আইনও বাতিল হয়ে যায়। কারণ তথ্যপ্রযুক্তি আইনে একই অপরাধ করে ডিজিটাল মাধ্যম শাস্তি পেলেও প্রিন্ট মাধ্যম শাস্তি পাবে না। এরই মধ্যে ভারতে এমন আইন বাতিল করা হয়েছে। আমাদের এখানেও রিট আবেদন হয়েছে। সেটির শুনানি মুলতবি আছে।’
ব্যারিস্টার তানজীব বলেন, ‘এখন এই ধারাটি বাতিল করলে এর পরিবর্তে কী আসবে, তা নিয়ে আমরা দ্বিধায় পড়ে গেছি। পশ্চিমের দেশগুলোতে প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে নতুন যে আইন আনা হয়েছে, সেগুলো থেকে আমরা শিখতে পারি। ভারত এ ধারা বদল করে অনেকগুলো ধারা অন্তর্ভুক্ত করেছে। সেগুলোও দেখা যেতে পারে।’
এই আইনজীবী আরও বলেন, ‘আমাদের অনুভূতি মাপার প্যারামিটার নেই। ফলে ছোট ছোট যে বিষয়গুলো আইনে আছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা না থাকলে অপপ্রয়োগ ঘটবেই।’
বৈঠকে সাংবাদিক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘সমাজ ও রাষ্ট্রকে উদার হতে হবে। সরকার আসবে যাবে, আইন থেকে যাবে।’ আমরা সবসময় দেরিতে প্রতিক্রিয়া দেখাই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘২০১৩ সাল থেকে ৫৭ ধারার বিভিন্ন ধরনের অপপ্রয়োগ হয়ে আসছে। কিন্তু যতক্ষণ সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা না হয়েছে, ততদিন আমরা সরব হইনি। এখনও এটাকে মৃদু প্রতিবাদই বলা যাবে। এবারও আমরা ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে প্রতিক্রিয়া সঠিকভাবে দেখাতে পারিনি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটির সহকারী অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, ‘মানুষ ৫৭ ধারা নিয়ে শঙ্কা বোধ করেন। এই আইন দিয়ে মানুষের অপরাধপ্রবণতা আটকে রাখা সম্ভব না।’ তিনি মনে করেন, মানুষ বরাবরই অপরাধপ্রবণ। তার জন্য বিভিন্ন ধরনের আইনের প্রয়োজন ও ব্যবহারও আছে। তবে ডিজিটাল অপরাধের জন্য নতুন করে এ ধরনের আইন বাকস্বাধীনতা হরণকারী।
বাংলা ট্রিবিউনের হেড অব নিউজ হারুন উর রশীদ বৈঠকিতে বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মামলায় সাংবাদিকদের হয়রানির খবর সামনে আসে, কিন্তু সাধারণ মানুষের হয়রানি সামনে আসে না। এ পর্যন্ত সাইবার অপরাধে তিনশরও বেশি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা ১৯। এর অর্থ দাঁড়ায়— সাধারণ মানুষের ভোগান্তি সামনে আসছে না।’ এই আইনে একই অপরাধে দুই রকমের শাস্তির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘একই রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হলে কিছু হয় না, অনলাইনের কারণে তাকে ভোগান্তিতে পড়তে হয়।’
সঞ্চালক মুন্নী সাহা বলেন, ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইনের এই ধারা আমাদের বাকস্বাধীনতাকে আঘাত করছে। এই ধারাকে যখন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দমন-পীড়নের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে, তখন যত ভালো উদ্যোগই হোক সেটা কাজে আসবে না।’ এই ধারাটি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান তিনি।
আরও পড়ুন-
সাইবার অপরাধ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন বৈঠকি শুরু
‘৫৭ ধারায় সাধারণ মানুষের হয়রানি সামনে আসে না’
‘অপরাধ প্রবণতা নতুন না, আলাদা আইন অপ্রয়োজনীয়’
‘৫৭ ধারা থাকবে কি থাকবে না, সেটি সরকারের নীতিনির্ধারণের বিষয়’
‘কিছু বিষয় আইন দিয়ে না, সামাজিক সচেতনতা দিয়ে সামাল দিতে হবে’
‘ডিজিটাল যোগাযোগকে আইনগত ভিত্তি দেবে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’
/টিআর/