প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক, কারও সঙ্গে দ্বন্দ্বে না জড়ানোসহ বেশকিছু অবস্থান স্পষ্ট করে বিদেশ নীতি নির্ধারণের পথে বাংলাদেশ। এদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বীকৃতি দেওয়ায় বাংলাদেশ আরেক ধাপ এগিয়ে যায়। দেশের স্থানীয় গেরিলা বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কাদেরিয়া বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সামনে অস্ত্র সমর্পণ করে আবারও প্রয়োজনে মাতৃভূমিকে বাঁচাতে এগিয়ে আসার প্রত্যয় জানায়।
১৯৭২ সালের এই দিনে বাংলাদেশ অবজারভারে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশ নীতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে দেখতে চান তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব নীতির আলোকে সুইজারল্যান্ডের মতো একটা নিরপেক্ষ অবস্থান তৈরি করতে পারে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যদি আমাদের নীতি মেনে চলতে পারি এবং অন্যদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে না জড়াই, তাহলে স্বস্তির আবহ তৈরি হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাদেশের অভীষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য অর্জন করতে আমরা কোনও দ্বন্দ্বে জড়াতে চাই না। চীনের সঙ্গে আমাদের দেশের বা জনগণের কোনও শত্রুতা নেই, প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সুসম্পর্ক নিশ্চিত করতে চাই।
সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃতি
সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। বাসসের খবর বলছে— ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সোভিয়েতই প্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেওয়া এক বার্তায় জানায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে প্রস্তুত। এর আগে ক্রেমলিনের বার্তা নিয়ে সোভিয়েত কনসাল জেনারেল পোপভ ছুটে যান টাঙ্গাইলে। বঙ্গবন্ধু সেখানে জনসভায় অংশ নিতে সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিলেন। তবে কী বার্তা নিয়ে কনসাল জেনারেল উপস্থিত হয়েছেন, সেসময় সেটা জানাতে অস্বীকৃতি জানান তিনি ।
দেশ পুনর্গঠনের ডাক
বাংলাদেশকে সুখী সমৃদ্ধশালী সমাজ হিসেবে গড়ে তুলতে জনগণকে আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু। টাঙ্গাইলে একজনসভায় তিনি এসব কথা বলেন। ২৪ জানুয়ারি শহরের পার্ক ময়দানে জনসভার আয়োজন করে টাঙ্গাইল জেলা মুক্তিবাহিনী। ঢাকার বাইরে প্রথম হওয়া এই জনসভায় লাখো মানুষের ঢল নামে। সেখানে জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের সব ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন সময় পুনর্গঠনের। সবাইকে একযোগে দেশ ও জাতির পুনর্গঠনে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি। বঙ্গবন্ধু তার বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তার ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ জানান।
শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, তিনি নিশ্চিত ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সব মুক্তিবাহিনী আত্মসমর্পণ করবেন। অস্ত্র জমা দেওয়ার দিন পিছিয়ে ৩১ জানুয়ারি করার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যাতে করে মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা সুবিধা অসুবিধা বিবেচনা করে অস্ত্র জমা দিতে পারে, সেজন্য এটা করা হয়েছে। এদের ভবিষ্যত কী হবে প্রশ্নে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, তারা পুলিশ ও ন্যাশনাল মিলিশিয়াতে যোগ দেবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি ঠিকই, কিন্তু দেশ এখনও বিপন্ন। আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। জনসভা থেকে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের যেকোনও ধরনের দুর্নীতি থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দেন। তিনি কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসে, তাহলে কোনও কথা শোনা হবে না। টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকী তার বক্তৃতায় বলেন, বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্ত্র সমর্পণ করতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ বোধ করছি, দেশকে মুক্ত করতে যার ডাকে একদিন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম।
বঙ্গবন্ধুকে কথা দিলো কাদের বাহিনী
বঙ্গবন্ধুকে আশ্বস্ত করে কাদের বাহিনী বলে, দেশকে মুক্ত করতে যার ডাকে সাড়া দিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম, কোনও বিপন্ন সময়ে যদি আবারও কখনও অস্ত্র তুলে নিতে হয় তাহলে পিছপা হবো না। পুরো টাঙ্গাইলবাসী ও আশেপাশের এলাকার মানুষ তাদের নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য উপস্থিত হয়। এদিন সাভারে ফেরার পথে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা দেওয়ার কথা। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বাংলাদেশ যত দিন থাকবে জাতি তাদের স্মরণ করবে।
গণঅভ্যুত্থান দিবস পালিত
গণঅভ্যুত্থান দিবস উপলক্ষে এই দিনে ব্যাপক কর্মসূচি পালন করা হয়। পত্রিকাগুলো বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। তিন বছর আগে ১৯৬৯ সালের এই দিনে সারাবাংলাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলার দামাল ছেলেরা। রাস্তায় মিছিল নিয়ে নেমে আসে পোস্টার- ফেস্টুন আর মিছিল। এই দিনেই বাংলাদেশের অক্ষত ছাত্র জনতা দৃপ্ত কণ্ঠে সোচ্চার হয়েছিল আইয়ুব খান ও মোনেম সাহির বিরুদ্ধে। চাপা আগুনের শিখার মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল বাংলার দিকে দিকে। সেদিন সেই ১১ দফার মিছিলে প্রথম রক্ত দিয়েছিল তরুণ ছাত্র আসাদুজ্জামান, রক্ত দিয়েছিল সেই জানুয়ারির কাঁপানো দিনগুলোতে মতিউরের মতো একটি চঞ্চল ছেলে, প্রাণ দিয়েছিল আরও বহু সংগ্রামী কর্মী— রুস্তম আলী, শ্রমিক জানু মিয়া, নাখালপাড়ায় আনোয়ারা বেগম, ডাক্তার শামসুদ্দোহা ও আরও অনেকে।
হাইকোর্টে বাংলা প্রচলন
হাইকোর্টের যুক্তি তর্কের ভাষা বাংলা হবে মর্মে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতদিন অফিসিয়াল ভাষা হিসেবে ইংরেজি ব্যবহৃত হতো। এর আগে রাষ্ট্রীয়ভাবে সব প্রতিষ্ঠানের ভাষা বাংলা ব্যবহারের পাশাপাশি গেজেটও বাংলায় প্রকাশের সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। ভাষা হিসেবে ইংরেজির ব্যবহার শিথিল হয়, যখন প্রধান বিচারপতি হাইকোর্ট খোলার সময় বলেন যে, উচ্চ আদালতের ভাষা হবে বাংলা। সেসময় বারের সভাপতি ও অ্যাটর্নি এম এইচ খন্দকার আদালতের সামনে বিষয়টি উত্থাপন করেন। প্রধান বিচারপতি গ্রহণ করেন এবং যুক্তিতর্ক বাংলায় উপস্থাপন করা যাবে মর্মে জানান।