করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় এমন হাসপাতালগুলোতে অনেক শয্যা খালি পড়ে থাকায় সরকার হাসপাতালের সংখ্যা কমানোর চিন্তা করছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছেন, এজন্য হাসপাতালের তালিকা করা হচ্ছে। এর আলোকে প্রথমে রাজধানী ঢাকা, পরে পুরো দেশে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হবে। তবে কিছু হাসপাতাল করোনা রোগের চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত থাকবে। আর এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন অন্য কথা। তাদের মতে কোভিড হাসপাতাল কমানোর সিদ্ধান্ত ভুল বার্তা দেবে। এতে সাাধারণ মানুষ আবার আগের মতো অসচেতন হবে, তারা মনে করবে দেশ থেকে করোনা বিদায় নিয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ১৫ আগস্ট দুপুর ১২টা পর্যন্ত তথ্যানুযায়ী, রাজধানী ঢাকার কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয় এমন হাসপাতালের সাত হাজার ৬২টি শয্যার মধ্যে রোগী ভর্তি আছেন দুই হাজার ২১৮ জন, আর শয্যা খালি রয়েছে চার হাজার ৮৪৪টি। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) রয়েছে ৩০৫টি, রোগী ভর্তি আছেন ২০৪ জন। আর শয্যা খালি রয়েছে ১০১টি। আর সারাদেশে কোভিড রোগীদের জন্য মোট শয্যা রয়েছে ১৫ হাজার ২৮০টি, রোগী ভর্তি আছেন চার হাজার ৩৬৪ জন। অন্যদিকে শয্যা খালি রয়েছে ১০ হাজার ৯১৬টি। এছাড়া সারাদেশে আইসিইউ সিট রয়েছে ৫৪৩টি, রোগী ভর্তি আছেন ৩২৫ জন। আর শয্যা খালি রয়েছে ২১৮টি।
এদিকে ১৫ আগস্ট শোক দিবসের এক অনুষ্ঠানে ‘বেশি দিন লাগবে না, বাংলাদেশ থেকে করোনা চলে যাবে বলে’ মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। সেখানে তিনি বলেন, আমরা খুবই আনন্দিত যে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কোভিড আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। মৃত্যুর হারও কমেছে, সুস্থতা বেড়ে গেছে। বেশিদিন লাগবে না বাংলাদেশ থেকে কোভিড চলে যাবে, ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে কিনা জানি না।
আমরা অনেক ভালো অবস্থানে আছি মন্তব্য করে জাহিদ মালেক বলেন, করোনায় মৃত্যুর হার জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম, আমাদের সুস্থতার হার অনেক ভালো, ৬০ শতাংশের বেশি। সংক্রমণের হার কমে আসছে। তিনি জানান, হাসপাতালের ৭০ শতাংশ বেড খালি।
এর আগে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেছিলেন, কিছু কোভিড হাসপাতাল কমিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করছি আমরা। কারণ হাসপাতালগুলোতে অনেক সিট খালি থাকছে। আবার যেসব হাসপাতালে কোভিড এবং নন কোভিড রোগীদের চিকিৎসা হয় সেসব হাসপাতালে সাধারণ রোগীরা আসতে চাইছে না, তারা চিকিৎসা নিতে পারছে না। তাই পর্যায়ক্রমে কোভিড ও নন-কোভিড এই দুই ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে এমন হাসপাতাল থেকেও কোভিড ইউনিট তুলে নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া জানান, এ হাসপাতালে আগামী সপ্তাহ থেকে আর কোভিড রোগী ভর্তি নেওয়া হবে না। আগের মতো অন্যান্য রোগের চিকিৎসা হবে এখানে।
প্রসঙ্গত, কোভিড চিকিৎসা তুলে নেওয়ার প্রাথমিক তালিকাতে রয়েছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা জাতীয় প্লাস্টিক ও বার্ন ইনস্টিটিউট, শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা মহানগর হাসপাতাল, পুলিশ হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, মিরপুরের লালকুঠি মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র এবং হলিফ্যামিলি রেডক্রিসেন্ট হাসপাতাল।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন বিপরীত কথা। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, হাসপাতাল বন্ধের বিষয়ে কোনও পরামর্শ নেওয়া হয়নি। পরামর্শক কমিটি হাসপাতাল বন্ধের বিষয়ে কোনও পরামর্শও দেয়নি। অন্যদিকে সরকার বলছে, কোভিড হাসপাতালের সিট খালি রয়েছে, সেগুলোকে নন কোভিড হাসপাতালে রূপান্তরিত করা হবে। এতে ধারণা হবে, আমাদের বোধহয় সব ‘মিটে’ গেছে’। এতে করে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলাসহ যেসব স্বাস্থ্যবিধিতে সাধারণ মানুষ অভ্যস্ত হয়েছিল, সেগুলোতে ঢিলেমি আসবে।
তিনি সাবধান করে বলেন, আমেরিকা, ইতালি, যুক্তরাজ্যে রোগী কমে যাওয়ার পর তাদের প্রস্তুতিতে, প্রতিরোধ কার্যক্রমে কিছুটা শিথিলতা এনেছিল। এ কারণে সেখানে সেকেন্ড ওয়েভ এসেছে। আর আমাদের দেশে যদি সেরকম হয়, তাহলে কিন্তু আমরা অসুবিধায় পড়ে যাবো।
কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল কমানোর সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস। তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে করোনা রোগী আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুসংখ্যাসহ সব সূচক ঊর্ধ্বগতি। করোনা আক্রান্তের পর তার কন্টাক্ট ট্রেসিং সবচেয়ে জরুরি, অথচ দেশে সেটা হচ্ছে না। আর সেটা না হলে সংক্রমণ হচ্ছেই। আর সেখানে যদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হবে, তাহলে সেটা কতটুকু যৌক্তিক সেটা আবার ভেবে দেখা প্রয়োজন। এতটা রিলাকটেন্ড হওয়ার কোনও সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না।
তিনি আরও বলেন, কোভিড নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের বুলেটিন বন্ধ হয়ে গেছে। এখন যদি হাসপাতাল কমিয়ে আনা হয়, তাহলে মানুষের কাছে ভুল বার্তা যাবে যে, দেশে করোনা নাই। সেটা কতটা ভয়ঙ্কর হবে, কেমন করে হাসপাতাল কমিয়ে আনার মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে সেটাও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে বুঝে নেওয়া দরকার।
এ বিষয়ে অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, প্রথমত বুলেটিন বন্ধ করাটা ছিল অত্যন্ত বাজে সিদ্ধান্ত, এরসঙ্গে এখন যোগ হচ্ছে হাসপাতাল কমানোর সিদ্ধান্ত। যখন বসুন্ধরা হাসপাতাল করা হলো, তখনও আমরা বলেছি হঠাৎ করে এমন হাসপাতাল করার দরকার নেই। অন্য হাসপাতালগুলো ঠিকভাবে চালিয়ে কার্যকর রাখা দরকার। কিন্তু হঠাৎ করেই মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয়, বসুন্ধরা হাসপাতাল করার এবং সেখানে সত্যিকার অর্থে তিন থেকে চার হাজার শয্যা কতটুকু কাজে লেগেছে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। খুব ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত, তথ্য উপাত্ত পরিস্থিতি এসবের ওপরে যদি সিদ্ধান্ত না নেই, তাহলে এসব ভুল হবে।
অধ্যাপক বে-নজির আরও বলেন, হাসপাতাল বন্ধ করার বিষয় নয়। বর্তমান পরিস্থিতি কী, সামনে কী পরিস্থিতি হতে পারে সেভাবে আমাদের কোভিডের জন্য ব্যবস্থাপনা এমনভাবে রাখা দরকার। যাতে প্রয়োজনে সংকুচিত এবং চাহিদা অনুযায়ী প্রসারিত করা যায়।
তবে কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মিক্সড রোগী যেসব হাসপাতালে রয়েছে সেগুলো কমিয়ে দেওয়ার কথা শুনছি। তবে গ্লোবালি সংক্রমণ আবার বাড়ছে, সংক্রমণের মধ্যে মৃদু সংক্রমণ বেশি। জটিল রোগীর হার পাঁচ শতাংশ থেকে কমে এসেছে। তাই সব হাসপাতালে সিট ফাঁকা রেখে অন্য রোগীদের চিকিৎসা বঞ্চিত রাখার কোনও মানে হয় না।
উল্লেখ্য, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হলে চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালকে কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। পরে যোগ হয় কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল। ধীরে ধীরে আরও সরকারি হাসপাতালকে কোভিডের জন্য ডেডিকেটেড করা হয়। এরপর গত ২৪ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দিতে নির্দেশ দেয়। মন্ত্রণালয়ের ওই নির্দেশনাতে বলা হয়, দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিকে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হলো।