X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১
জলবায়ু প্রকল্প

৮০০ কোটি টাকার প্রকল্পে ৩০ কোটি নিলো পরামর্শকরাই!

শাহেদ শফিক
২১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৫:০০আপডেট : ২১ ডিসেম্বর ২০২০, ১৯:৪১

জলবায়ুজনিত ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ অন্যতম। ঝুঁকি কমাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলা হলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না কোনোটির। জলবায়ু তহবিলের প্রকল্পগুলোতেওচলছে অর্থের তছরুপ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অদক্ষতা, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের নানা দিক ও এ খাতের অনিয়ম নিয়ে শাহেদ শফিকের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে ষষ্ঠ পর্ব—

প্রকল্পের টাকায় বানানো ফুটওভার ব্রিজের গাছ মরে গেছে

২০০৯ সালে ঢাকার বায়ুদূষণ কমাতে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের আওতায় দাতা সংস্থাগুলোর চাহিদা অনুযায়ী বিদেশি পরামর্শক নিয়োগের পাশাপাশি যানবাহন ক্রয়,ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন, সৌর প্যানেল স্থাপন, ভবন নির্মাণ, বায়ু মাপার যন্ত্রপাতিসহ সবকিছুই করা হয়েছে দাতা সংস্থার পরামর্শে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে না হতেই এসব অকেজো হয়ে পড়ে। অথচ জলবায়ু বা পরিবেশের উন্নয়নের জন্য এসব যন্ত্রপাতি বা উপকরণ কোনও ভূমিকা রাখছে না বলে দাবি জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের।

 

৮০০ কোটি টাকার কেইস প্রকল্পটিতে অর্থায়ন করে বিশ্বব্যাংক। বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেয় সংস্থাটি। শর্তানুযায়ী ২৯ জন পরামর্শক নিয়োগ দিতে হয়। যাদের পেছনে প্রকল্পের ৩০ কোটি ২৬ লাখ টাকা ব্যয় করতে হয়েছে। এই শর্তকে অযৌক্তিক মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বিদেশি তহবিলে বাংলাদেশের পরিবেশ বা জলবায়ুর উন্নয়নে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় তাতে দাতা সংস্থাগুলোর শর্ত পূরণ করেই প্রকল্প অনুমোদন করাতে হয়। শর্তগুলোর মধ্যে থাকে দাতাদের পছন্দের পরামর্শক নিয়োগ, যান-যন্ত্রপাতি ক্রয় ও পরামর্শকদের আকাশচুম্বী ফি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এ অবস্থায় জলবায়ুর উন্নয়নে বৃক্ষরোপণ কিংবা যানবাহনের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণসহ বাস্তবমুখী নানা পদক্ষেপ নেওয়া যেত। কিন্তু সে দিকেও কর্ণপাত নেই। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পরিবেশের উন্নয়নে বাস্তবিক প্রকল্প গ্রহণ করলে সেখানে দাতা সংস্থাগুলো তহবিল দিতে চায় না। এ ধরনের প্রকল্পে তারা যদি অর্থায়ন করে তখন তাদের নির্দেশনায় প্রকল্প গ্রহণ করতে হয়।

প্রকল্পের টাকায় বানানো ফুটওভার ব্রিজের গাছ মরে গেছে বিভিন্ন প্রকল্পে দাতা সংস্থাগুলোর এমন শর্তে ক্ষুব্ধ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সংসদীয় কমিটি। কমিটির সভাপতি সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জলবায়ু প্রকল্পে যারা আমাদের দাতা সংস্থা তাদের কিছু নির্দেশনা ও চাহিদা থাকে। যেগুলো খুব অদ্ভুত মনে হয়। তাদের নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি প্রকল্পের জন্য একজন পরামর্শক নিয়োগ করতে হয়। এই পরামর্শকের কাজ হচ্ছে শুধু টেন্ডার ডক্যুমেন্ট তৈরি করে দেওয়া। টেন্ডারে কী থাকবে না থাকবে সেগুলো তিনি চূড়ান্ত করে দেন। এই টেন্ডার আইটেম যদি আমরা শুধু শিডিউল পরিবর্তন করে অন্য ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারি তাহলে সেটা আমাদের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু, শুধু এ কারণে প্রতিটি প্রকল্পের জন্য যদি একবার করে একজনকে নিয়োগ দিতে হয় তাহলে সেটা অর্থের অপচয়।

দাতা সংস্থার এমন অদ্ভুত শর্ত থেকে মুক্তি পেতে ও পরিবেশ দূষণ রোধে এরইমধ্যে ‘ক্লিন এয়ার অ্যাক্ট’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে সরকার। খুব দ্রুত আইনটি বিল আকারে সংসদে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, পরিবেশের উন্নয়নে আমরা একটা আইনের প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছি। দ্রুত সময়ের মধ্যে সংসদে একটা বিল আনা হবে। যদি আইনি কাঠামোতে এগুলো নিয়ে আসতে না পারি তাহলে ব্যবস্থাগুলো কীভাবে নেবো?

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের অনেক প্রকল্প, যেগুলোতে দাতা সংস্থা অর্থ দিয়ে থাকে, সেখানে আমাদের নিজস্ব চিন্তা নেই বলেই দাতা সংস্থা তাদের চিন্তা চাপিয়ে দেয়। আমরা তো শুধু অর্থের দিকে তাকিয়ে থাকি। বলতে থাকি সেখান থেকে এত এত টাকা পাওয়া যাবে। তবে আসলেই সেই অর্থটার সর্বোচ্চ ব্যবহার আমি নিশ্চিত করছি কিনা সেটি আমরা আর দেখি না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন প্রকল্পে দাতা সংস্থার অর্থায়নে তাদের নিজস্ব হিসাব-নিকাশ রয়েছে। কোনও অবস্থাতেই তারা বিনা লাভ বা শর্তহীনভাবে অর্থ বরাদ্দ দিচ্ছে না। বিদেশি যেসব সংস্থা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে ঋণদান করেছিল তাদের ছিল এক ধরনের সুযোগ, রাজনৈতিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের এজেন্ডা, আবার বিশ্ব পরিসরে নিজেদের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধিরও হিসাব রয়েছে। বিষয়গুলো প্রকল্পগ্রহীতাদের মাথায় রাখতে হবে।

প্রকল্পের টাকায় বানানো যাত্রী ছাউনি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর জলবায়ু অর্থায়নে সুশাসন সেলের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার জাকির হোসেন খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জাতিসংঘের সবুজ জলবায়ু তহবিলের (জিসিএফ) যে উদ্দেশ্য সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। উন্নত বিশ্বের কার্বন নিঃসরণের ফলে স্বল্পোন্নত দেশের পরিবেশের যে ক্ষতি হয় তাতে তাদের ক্ষতিপূরণই দেওয়ার কথা। ঋণ কেন? আজ জলবায়ু তহবিলের টাকা ঋণের মধ্যে চলে যাচ্ছে। জলবায়ুর ফাঁদে পড়েছে ক্ষতিগ্রস্তরা। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। কারণ, যাদের কারণে ক্ষতি হয়েছে তাদেরই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, জলবায়ু প্রকল্পে দাতা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে যেসব অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয় সেগুলোর মাধ্যমে মূলত উন্নত বিশ্বের টেকনোলজি বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। কোন প্রকল্পে কী ব্যবহার করতে হবে সেটা তারা ঠিক করে দেয়। কিন্তু প্রকল্পটি আমাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা বা পরিবেশের জন্য কতটা উপযোগী সেটা বিবেচনা করা হয় না। কোনও দেশই প্যারিস চুক্তির উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করছে না।

প্রকল্পের টাকায় বানানো ফুটওভার ব্রিজ কেইস প্রকল্প প্রসঙ্গে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, কেইস প্রকল্পে ২৯ জন কনসালট্যান্ট। এর কোনও প্রয়োজন নেই। এরমধ্যে দুজন তাদের কাজই শেষ করেননি। তারা ১০ শতাংশ কাজ করে চলে গেছেন। এখানে একটা চক্র আছে। তাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রকল্পের বড় একটা অর্থ এই কনসালট্যান্সির মাধ্যমে নিয়ে নেওয়া। এসব ১০ বছর ধরে চলেছে। এখান থেকে আমরা শিখতে চাই, যাতে একই ভুল আর না করি। এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

জানতে চাইলে পরিবেশ, পানি ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ম ইনামুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বিদেশি সাহায্য ছাড়া সরকার জলবায়ু নিয়ে কোনও গবেষণা বা প্রকল্প গ্রহণ করে না। দাতা সংস্থার অর্থায়নে জলবায়ুর প্রকল্পগুলো গ্রহণ করা হয়। তারা যখন অর্থায়ন করে তখন তাদেরই কনসালটেন্ট নিয়োগ হয়। তারাই বলে দেয় আমাদের এই প্রকল্পের এই স্টাডির এই আউটপুট আসতে হবে। ফলে বাস্তব জিনিসটা আসে না। এটা ওয়ানওয়ে ট্রাফিকের মতো।উল্টো দিকে কী হচ্ছে তা নিয়ে সরকার কোনও চিন্তা করে না।

 

তিনি আরও বলেন, আমাদের সরকার ওয়ার্ল্ড কমিউনিটিকে সঙ্গে নিয়ে চলে। জলবায়ু নিয়ে যদি সরকারের একটা শক্ত ধারণা বা অভিজ্ঞতা থাকতো তাহলে যে কোনও বিষয়ে প্রতিবাদ করা যেত। জলবায়ু নিয়ে যা হচ্ছে পুরোটাই একটা ভাঁওতা। এ খাতের অর্থ জলে এবং বায়ুতেই চলে যাচ্ছে।

বিষয়টি সম্পর্কে জানার জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রশ্নগুলো লিখিত আকারে পাঠাতে বলেন। গত ১০ নভেম্বর তার কাছে প্রশ্নগুলো পাঠানো হয়। প্রশ্নগুলোর মধ্যে ছিল- ‘জলবায়ুর যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে তাতে দেখা গেছে, দাতা সংস্থার সুবিধার্থে তাদের পরামর্শে কনসালটেন্ট নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রকল্পে অনেক উপকরণ যুক্ত করা হয়। যা যথার্থ নয় বলে মনে করে সংসদীয় কমিটি। এক্ষেত্রে নতুন প্রকল্প গ্রহণে বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে কিনা?’ এখনও প্রশ্নটির উত্তর পাওয়া যায়নি। প্রকল্পের টাকায় বানানো ফুটওভার ব্রিজের গাছ মরে গেছে

আরও পড়ুন:
জলবায়ুর টাকায় ফুট ওভারব্রিজ, ট্রাফিক বাতি!



বায়ুদূষণ কমাতে ৮০০ কোটি টাকা: বেতন-ভাতা, যন্ত্রপাতি আর বিদেশ ভ্রমণেই ফুরালো!

জলবায়ুর টাকা পুরোটাই গেছে জলে, ২৯৬ জনের বিদেশ সফর

৮ হাজার একর বন উজাড়, ক্ষতি সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা!

গাছ কেটে জলবায়ু প্রকল্প 

/এফএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে সকার স্কুলের বাছাইয়ে ৩ বাংলাদেশি কিশোর
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
দীর্ঘ অপেক্ষার পর ঢাকায় স্বস্তির বৃষ্টি, কমলো তাপমাত্রা
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
রোমাঞ্চকর ম্যাচে ১ রানের নাটকীয় জয় হায়দরাবাদের 
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
সর্বাধিক পঠিত
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পদ্মা নদীতে চুবানো নিয়ে যা বললেন ড. ইউনূস
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
আরও কমলো সোনার দাম
আরও কমলো সোনার দাম
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক হচ্ছে
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা
লাউ খেলে মিলবে এই ৮ উপকারিতা