X
রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
১৪ বৈশাখ ১৪৩২

রামপুরা খাল নিয়ে যে পরিকল্পনা ছিল মেয়র আনিসুল হকের

শাহেদ শফিক
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২২:৩০আপডেট : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৩:৩০





বিদ্যমান খাল

রাজধানীর রামপুরা ব্রিজ থেকে ত্রিমোহনী নড়াই খালকে (রামপুরা) প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। পুরো প্রকল্পটি অনেকটা হাতিরঝিলের আদলেই করার পরিকল্পনা ছিল তার। জীবদ্দশায় তিনি এই খালটি নিয়ে প্রাথমিক পরিকল্পনাও করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি প্রস্তাবনাও জমা দেওয়া হয়েছিল। তবে তার মৃত্যুতে পরিকল্পনাটি ভেস্তে যায়। কয়েকজন নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রয়াত মেয়রের ঘনিষ্ঠ একাধিক ব্যক্তি বিষয়টি বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন।


জানা গেছে, এই খালকে কেন্দ্র করে নেওয়া পরিকল্পনায় চারটি বিষয় প্রধান্য দেওয়া হয়েছিল। সেগুলো হলো— খালের প্রবাহ সচল রাখা, দূষণমুক্ত রাখা, নৌযান চলাচল উপযোগী করা এবং আফতাবনগর ও বনশ্রীর মধ্যে যোগাযোগ নিশ্চিত করা। কিছু ছবি সংগ্রহ করে খালের ওপর আফতাবনগর ও বনশ্রীর সঙ্গে যোগাযোগ নিশ্চিত করতে কয়েকটি ব্রিজ তৈরির প্রাথমিক নকশাও করা হয়েছিল।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ওই খালটি নিয়ে আনিসুল হকের মহাপরিকল্পনা ছিল। তিনি চেয়েছিলেন, খালটিকে হাতিরঝিলের সঙ্গে যুক্ত করে একটা আধুনিক ও নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যের আধারে পরিণত করতে। তার এই পরিকল্পনার সঙ্গে আমিও যুক্ত ছিলাম। অনেক দূর অগ্রসরও হই। কিন্তু তার অনুপস্থিতিতে বিষয়টি ভেস্তে যায়।’
আনিসুল হকের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, পুরো বিষয়টি আনিসুল হক প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছিলেন। প্রধনমন্ত্রী তখন ইতিবাচক সাড়াও দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে ঢাকা ওয়াসার ‘দাসের কান্দি’ স্যুয়ারেজ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা জানিয়েছেন। তবে দ্রুত প্রাথমিক কাজগুলো প্রস্তুত করার তাগিদ দিয়েছেন। জরিপ করে ডিপিপি তৈরির আগেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এর পরে চলে যান না ফেরার দেশে।

খালের ওপর ব্রিজের নকশা

আনিসুল হকের মৃত্যুর পর তার সেই প্রকল্পটি নিয়ে আর কেউ কাজ করছে না। প্রয়াত মেয়রের সেই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে আফতাবনগর ও বনশ্রী এলাকার বাসিন্দারা হাতিরঝিলের মতো একটি দৃষ্টিনন্দন প্রকল্প পেতেন। তার স্বপ্ন ছিল প্রাকৃতিক জলাধার, পরিবেশবান্ধব বিনোদনকেন্দ্র, ক্যাম্পিং, সাঁতার, হাঁটার পথ তৈরি ও পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে নাগরিকদের মেলবন্ধন ঘটানো।
ইকবাল হাবিব বলেন, “আনিসুল হক কতগুলো স্বপ্ন তৈরি করে গেছেন। প্রকল্পটি ছিল তার স্বপ্নের একটি অংশ। হাতিরঝিলের চলমান অংশটিই হতো এই নড়াই খাল। খালটির দুই পাড়ে ওয়াকওয়ে তৈরি করে খালের পানি ও পাড়ের গাছপালার সঙ্গে পথচারীদের একটা মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছিলেন। এর সঙ্গে একটা সিস্টেম করে হাতিরঝিলের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হতো। এই প্রকল্পটির বাইরে আরও চারটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন আনিসুল হক। এর মধ্যে রয়েছে কল্যাণপুর ওয়াটার পন্ড প্রকল্প, বোটানিক্যাল গার্ডেনের উত্তরে উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পের দক্ষিণে ‘জল নিসর্গ’ প্রকল্প ও গোড়ান-চাটবাড়ি এলাকায় আরেকটি জলাধার নির্মাণ প্রকল্প। এগুলো ছিল তার ‘ওয়াটার বেস’ প্রকল্প। সেগুলো আর হয়নি। এই কাজগুলো নিয়ে কাউকে এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন এগুলো নিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন।’
ধানমন্ডি ২৭ নম্বর, রাপা প্লাজা, ধানমন্ডি-৮/এ স্টাফ কোয়ার্টার মোড়, কাঁঠালবাগান, গ্যাস্ট্রোলিভার গলি, কলাবাগান ডলফিন গলি, গ্রিনরোড— এসব এলাকার পানি হাতিরঝিল হয়ে নড়াই খাল দিয়ে বালু নদীতে যায়। অন্যদিকে মাদারটেক ও মেরাদিয়ার পানিও নড়াই খাল দিয়ে বালু নদীতে যায়। আনিসুল হকের পরিকল্পনায় বাস্তবায়িত হলে পুরো এলাকায় জলাবদ্ধতা দূরসহ পানি নিষ্কাশনে গতি আসবে।
স্থানীয়রা জানান, আশির দশকের শুরুর দিকেও এই খাল হয়ে বর্তমান হাতিরঝিল দিয়ে কাওরানবাজার পর্যন্ত নৌপথ চালু ছিল। তখন এ খাল দিয়ে হাতিরঝিল হয়ে নৌপথে শাক-সবজিসহ অন্যান্য মালামাল কাওরানবাজারে যেতো। কাওরানবাজারে বিজিএমইএ ভবনের পাশে মাছের পাইকারি বাজারটিতে একসময় শীতলক্ষ্যা ও তুরাগ নদীর মাছের ল্যান্ডিং পোর্ট ছিল। বর্তমানে হাতিরঝিল প্রকল্পের পানি পাম্পের মাধ্যমে এ খালের পানি নিষ্কাশন করা হয়। তাছাড়া ঝিলের অতিরিক্ত পানিও রামপুরা ব্রিজ হয়ে এই খালে পড়ে। সে সময়ের ছোট নদীর আকৃতির খালটি দিন দিন ভরাট হচ্ছে।
খালের এখনকার চিত্র

এদিকে ড্রেনেজ মাস্টার প্ল্যান, ঢাকা মহানগরী উন্নয়ন পরিকল্পনা (ডিএমডিপি) স্ট্রাকচার প্ল্যান ও ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) অনুযায়ী নড়াইল খালের পর ত্রিমোহনী খালের শেষ বালু নদী সংলগ্ন এলাকায় একহাজার ১০৮ একর ওয়াটার রিটেনশান পন্ড (জলাধার) এলাকা রয়েছে। নড়াই খালের পানিগুলো ত্রিমোহনী খাল হয়ে এই জলাধারে গিয়ে জমা হয়। বালু নদীতে যখন ভাটা থাকে তখন এই পানিগুলো প্রবাহিত হয়ে নদীতে চলে যায়। এজন্য এই খালটিকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন মেয়র আনিসুল হক।
এছাড়া গোবিন্দপুর খাল, বাওথার খাল, বোয়ালিয়া খাল, সুতিভোলা খাল, শাহজাদপুর খাল, বেগুনবাড়ি খাল, মেরাদিয়া খাল, জিরানি খাল, মান্ডা খাল এবং এসব খালের শাখা-প্রশাখা দিয়ে প্রবাহিত পানি এই ওয়াটার রিটেনশান পন্ড হয়ে বালু নদীতে গিয়ে পড়ে।
জানা গেছে, ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে নব্বই দশকের দিকে বিশেষজ্ঞ কমিটি দিয়ে একটি জরিপ করে মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর একটি প্রস্তাবনাও বাস্তবায়ন হয়নি। ওই প্রস্তাবনায় বলা হয়, ঢাকা শহর থেকে পানি নির্গমনের যে পাঁচটি আউটলেট রয়েছে সেগুলোর মুখে বড় বড় জলাধার প্রয়োজন। শহরের পানিগুলো খাল বা ড্রেন দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ওই জলাধারগুলোতে আবদ্ধ হবে। সেখান থেকে দুই পদ্ধতিতে পানি অপসারণ করা যেতে পারে নদীতে। প্রথমত, নদীতে পানি কম হলে তখন স্বাভাবিক গতিতে পানি চলে যাবে। আর নদীতে পানি বেশি বা জোয়ার থাকলে পাম্পিং পদ্ধতিতে পানি অপসারণ করা হবে। তবে তা আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

খালের ওপর সম্ভাব্য ব্রিজের নকশা

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সহসভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নব্বই দশকের দিকে যে মাস্টার প্ল্যান তৈরি হয়েছে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। সবশেষ ২০১৫ সালের দিকেও আরেকটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করা হয়। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা তা প্রকাশ করছে না।’
এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন,‘দিন দিন চারপাশের খালি জায়গাগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে নিচু এলাকা ভরাট করে নগরায়ণ প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে তাতে করে এইসব এলাকায় চিহ্নিত ওয়াটার রিটেনশান এলাকা ভরাট হয়ে যাবে। পরে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য আর জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এখনই যদি ওই মাস্টার প্ল্যান বাস্তবায়ন করা না হয় তাহলে ভবিষ্যতে আর জলাধার তৈরির জন্য জমি পাওয়া যাবে না। আর জলাধার সচল রাখার পূর্ব শর্ত হচ্ছে এর সঙ্গে সংযুক্ত খালগুলোকে প্রবাহমান রাখা। তাই যত দ্রুত সম্ভব ঢাকার প্রতিটি খাল উদ্ধার করে আধুনিকায়নের প্রকল্প গ্রহণ করা।’
আনিসুল হকের এই পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র মো. জামাল মোস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেয়র আনিসুল হকের যেসব স্বপ্ন ছিল তার মধ্যে কয়েকটি বাস্তবায়ন করার জন্য ঢাকা দক্ষিণের (ডিএসসিসি) মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর রামপুরা খাল নিয়ে যে পরিকল্পনা আছে সেটি নিয়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবো। আসলে আমরা চাইলে এটি বাস্তবায়ন করতে পারবো না। কারণ, খালগুলোর মালিক ঢাকা ওয়াসা ও জেলা প্রশাসক।’

ছবি: ইকবাল হাবিব

/এইচআই/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
হয়লুন্দের ৯৬তম মিনিটের গোলে হার এড়ালো ম্যানইউ
হয়লুন্দের ৯৬তম মিনিটের গোলে হার এড়ালো ম্যানইউ
পুলিশের কাজে বাধা, তাৎক্ষণিক আদালত বসিয়ে চালক-যাত্রীকে কারাদণ্ড
পুলিশের কাজে বাধা, তাৎক্ষণিক আদালত বসিয়ে চালক-যাত্রীকে কারাদণ্ড
পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় নীল স্যুট পরে আলোচনায় ট্রাম্প
পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় নীল স্যুট পরে আলোচনায় ট্রাম্প
সিরিজ বাঁচানোর মিশনে চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি বাংলাদেশ
সিরিজ বাঁচানোর মিশনে চট্টগ্রামে জিম্বাবুয়ের মুখোমুখি বাংলাদেশ
সর্বাধিক পঠিত
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নূরজাহানের পদত্যাগ দাবি
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নূরজাহানের পদত্যাগ দাবি
আবার চালু হচ্ছে পরিত্যক্ত ৭ বিমানবন্দর, সবার আগে বগুড়া
আবার চালু হচ্ছে পরিত্যক্ত ৭ বিমানবন্দর, সবার আগে বগুড়া
বড় দুই বাজারে রফতানিতে চমক: চীনের ঘাটতি পূরণ করছে বাংলাদেশ
বড় দুই বাজারে রফতানিতে চমক: চীনের ঘাটতি পূরণ করছে বাংলাদেশ
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
হাইকোর্টে প্রতিবেদন: নিয়ম মেনেই হয়েছিল আদানির বিদ্যুৎ চুক্তি
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার
রাখাইনে মানবিক সহায়তায় শর্তসাপেক্ষে করিডোর দিতে রাজি সরকার