X
রবিবার, ০৫ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

ইউনাইটেডের আগুন নেভাতে এসেছিলেন কেবল ক্লিনার ইয়াসিন

নুরুজ্জামান লাবু ও রাফসান জানি
১৩ জুন ২০২০, ০১:৫৪আপডেট : ১৩ জুন ২০২০, ০২:৪১

ইউনাইটেড হাসপাতালের আগুন রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন একজন নার্স ও একজন ক্লিনার। আর আইসোলেশন ইউনিটে ভর্তি ছিলেন পাঁচ রোগী। এসির স্পার্ক থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে তা নেভানোর জন্য ক্লিনার ইয়াসিন আরাফাত ছাড়া আর কেউ এগিয়ে আসেননি।ইয়াসিন কোনও ফায়ার এক্সিটিংগুইশার না পেয়ে পানির মগ ও ফ্লোর মোছার মপ দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। ফায়ার সার্ভিস আসার আগ পর্যন্ত আর কেউ আগুন নেভাতে এগিয়ে আসেনি।

২৭ মে রাত ৯টা ৪৩ মিনিটে আগুন সূত্রপাতের পর সাড়ে ১০টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে ফায়ার সার্ভিস। ক্লিনার ইয়াসিন আরাফাত ও নার্স ধোঁয়ায় সবকিছু আচ্ছন্ন হয়ে গেলে আইসোলেশন ইউনিট থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বের হতে পারেননি ভর্তি থাকা পাঁচ রোগী। ফায়ার সার্ভিস তাদের মরদেহ উদ্ধার করে। ইতোমধ্যে অনুমান ৯টা ৪৬ মিনিটে ওই রুম প্রচণ্ড ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় এবং ধোঁয়া আইসোলেশন ইউনিটের মধ্যে প্রবেশ করে যেখানে হতভাগ্য ওই পাঁচ রোগী চিকিৎসাধীন ছিলেন। ধোঁয়ার তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ক্লিনার ইয়াসিন আরাফাত ও অপর দুজন নার্স সেখান থেকে বেরিয়ে যান। সে সময় সেখানে কোনও ডাক্তার বা অন্য কেউ উপস্থিত হয়ে ইয়াসিনকে আগুন নেভানোর ক্ষেত্রে সহায়তা করেনি।

এ ঘটনার তদন্তে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা, দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতিকে দায়ী করেছে গুলশান পুলিশ। আগুন নেভাতে ক্লিনার ইয়াসিন আরাফাত ছাড়া আর কারও এগিয়ে না আসা এবং রোগীদের আইসোলেশন ইউনিট থেকে বের করতে আনতে কোনও চেষ্টা না করার চিত্র উঠে এসেছে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে। বৃহস্পতিবার (১১ জুন) ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের কাছে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ডিএমপির গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর গুলশান জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনারকে (এডিসি) সভাপতি এবং সহকারী কমিশনার (গুলশান) ও গুলশান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির রিপোর্ট ডিএমপি কমিশনারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।’

কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইউনাইটেড হাসপাতালের মূল ভবনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে পাঁচটি বেড বসিয়ে কোভিড-১৯ আইসোলেশন ইউনিটটি তৈরি করা হয়। সেখানে ডাক্তার-নার্স-পেসেন্ট কেয়ার ও চেঞ্জরুম এবং কেভিড-১৯ স্যাম্পল কালেকশনের জন্য নতুন একটি অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা হয়। নতুন তৈরি করা আইসোলেশন স্থাপনাটিতে কোনও প্রকার ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা না রেখে অবকাঠামো ফ্লেমাবল মেটারিয়ালস (দাহ্য পদার্থ) দ্বারা ইন্টেরিয়র ডেকুরেশন, কাঠজাত, রাবারজাত, প্লাস্টিকজাত, দ্রব্যাদি ও সিনথেটিক পদার্থ দ্বারা স্থাপন করা হয়েছিল। আইসোলেশন ইউনিটটিতে কোনও ফায়ার ডিটেকশন, ফায়ার অ্যালার্ম, স্মথ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, ইমার্জেন্সি সাইনেজ ও লাইটিং ব্যবস্থা ছিল না।’

আগুনের সূত্রপাত ও ক্লিনার ইয়াসিনের চেষ্টা

গত ২৭ মে রাত ৯টা ৪৩ মিনিটে ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটের পাশে চিকিৎসক ও নার্সদের রুমে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে তদন্ত প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, আইসোলেশন ইউনিটের পাশেই ডাক্তার-নার্সদের জন্য নির্ধারিত রুমে সিলিং মাউনটেন্ড ক্যাপসুল এসিতে স্পার্ক করে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। এসি থেকে আগুনের ফুলকি নিচের ফাঁকা বেডে পড়তে থাকে। ক্লিনার ইয়াসিন আরাফাত ফ্লোর মোছার একটি মপ দিয়ে আগুনের ফুলকিগুলো নেভানোর চেষ্টা করেন। তখন সেখানে দায়িত্বরত একজন নার্স টেলিফোনে আগুনের সংবাদ দেন। ক্লিনার ইয়াসিন কোনও ফায়ার এক্সিটিংগুইশার না পেয়ে পানির মগ ও মপ দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণের প্রাণপণ চেষ্টা করেন।

ধোঁয়ার তীব্রতা বাড়ার পর বেরিয়ে আসেন ক্লিনার ইয়াসিন ও নার্স। কিন্তু বের হতে পারেননি ভর্তি থাকা রোগীরা। এমনকি রোগীদের আগুন থেকে বের করে আনার জন্য তখন দায়িত্ব থাকা চিকিৎসক, নার্স বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কেউ কোনও চেষ্টা করেননি বলে জানান গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী। যা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

তদন্তে সাতটি বিষয় তুলে ধরেছে গুলশান পুলিশ। সেগুলো হলো: করোনা আইসোলেশন সেন্টারটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের নির্দেশে তৈরি করা হলেও রাজউকের অনুমোদন বা বিল্ডিং কোডের যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী নির্মাণ করা হয়নি; করোনা আইসোলেশন সেন্টারসহ হাসপাতাল ভবনে ব্যবহারের উপযোগী অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ছিল না; কেবলমাত্র ক্লিনার ইয়াসিন আরাফাত ব্যতীত ঘটনার সময় অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কোনও ব্যক্তি অগ্নিনির্বাপণে কোনও ভূমিকা রাখেননি; অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ইলেকট্রিক ক্যাবল, ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রাংশ, স্যানিটাইজার বা অন্যান্য উচ্চমাত্রার দাহ্য পদার্থ দিয়ে অস্থায়ী আইসোলেশন সেন্টারটি স্থাপন করা হলেও ন্যূনতম সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি। এখানে পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশার রাখার বাধ্যবাধকতা থাকার পরেও কোনও ফায়ার এক্সিটিংগুইশার রাখা হয়নি। এক্ষেত্রে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা পরিলক্ষিত হয়; ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটটি নির্মাণের ক্ষেত্রে বিধি অনুযায়ী ফায়ার অ্যাপ্রুভাল ছিল না; হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য ২৪ ঘণ্টা ফায়ার সেফটি অফিসার ও কার্যকরী অগ্নিনির্বাপণকারী দল ঘটনার সময় উপস্থিত ছিল না; উল্লিখিত ঘটনায় ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা, দায়িত্বহীনতা ও গাফিলতি পরিলক্ষিত হয়।

তদন্ত কমিটির মতামতে বলা হয়েছে, সেখানে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দ্বারা অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা করা ছিল না এবং অগ্নিকাণ্ডের শিকার আইসোলেশন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীদের কোনও ধরনের উদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ চরম গাফিলতি, অবহেলা, উদাসীনতা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। ডাক্তার/নার্স এবং সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটির উপস্থিত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা করোনা আক্রান্তের ভয়ে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন না করে চিকিৎসারত রোগীদের প্রতি অবিচার করেছেন।

মতামতে আরও বলা হয়েছে, ‘ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ করোনা আইসোলেশন ইউনিট অগ্নিপ্রতিরোধ যোগ্য নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি করেননি, ইউনিটে অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা সংযোজন এবং চিকিৎসারত রোগীদের অগ্নিকাণ্ড হতে রক্ষার ক্ষেত্রে চরম দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। সর্বোপরি ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ ধরণের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ জন রোগীর মৃত্যুর দায় এড়াতে পারেন না।’

ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটের আগুনে পাঁচ নিহতের ঘটনায় অবহেলাজনিত মৃত্যু অভিযোগ এনে একটি মামলা হয়েছে গুলশান থানায়। নিহত ভেরন অ্যান্থনি পলের মেয়ের স্বামী রোনাল্ড নিকি গোমেজ বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। এ মামলায় এখনও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে জানিয়েছেন গুলশান বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) সুদীপ কুমার চক্রবর্তী।

আগুনে নিহতরা হলেন- মোহাম্মদ মাহবুব (৫০), মনির হোসেন (৭৫), ভেরন অ্যান্থনি পল (৭৪), খোদেজা বেগম (৭০) ও রিয়াজ উল আলম (৫০)।

উল্লেখ্য, গত ২৭ মে রাতে ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আগুন লাগে। সেখানে ভর্তি থাকা ওই পাঁচ জন রোগী আগুনে পুড়ে মারা যান। পাঁচ জনের মধ্যে তিন জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন। বাকি দু'জনের পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল।

 

আরও পড়ুন...
ইউনাইটেড হাসপাতালের করোনা ইউনিটে আগুন, ৫ রোগীর মৃত্যু

ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি

ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুনের ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা

ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ড: মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশ

‘ইউনাইটেড হাসপাতালের ফায়ার এক্সটিংগুইশারগুলো ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ’

ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে মামলা

‘জরুরি ব্যবস্থায় তৈরি ইউনাইটেডের বিশেষ করোনা ইউনিট নিয়ে প্রশ্ন’

 

 

/এমএএ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় হামাস যোদ্ধাসহ ৫ ফিলিস্তিনি নিহত
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি হামলায় হামাস যোদ্ধাসহ ৫ ফিলিস্তিনি নিহত
তারেক রহমানের এপিএসসহ ৭ জনের অভিযোগ গঠন শুনানি অব্যাহত
তারেক রহমানের এপিএসসহ ৭ জনের অভিযোগ গঠন শুনানি অব্যাহত
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
কোরিওগ্রাফার ইভানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৩ মে
কোরিওগ্রাফার ইভানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ২৩ মে
সর্বাধিক পঠিত
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
মাঠ প্রশাসনে বিতর্কিত কর্মকর্তাদের লাগাম টানবে সরকার
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
মিল্টন সমাদ্দারের তিন মামলার বাদীরই মুখে কুলুপ
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি
স্বর্ণের ভরিতে বাড়লো ১ হাজার টাকার বেশি