রঙ সাদা নাকি কালো- এই বিবেচনা দিয়ে নারীর গুণ নির্ধারণ হয় আমাদের সমাজে। বলা হয়, আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি। আর সাদাতেই সব দর্শন উপযোগিতা আটকে গেছে। কিন্তু বর্ণবাদ কি শুধুই সাদা-কালো? সমাজ গবেষকরা বলছেন, কেবল রঙ না, এটি প্রবল আর প্রান্তিকতার বিষয়। আধিপত্য আর ক্ষমতার বিষয়। গণমাধ্যম বিশ্লেষকরা বলছেন, কীভাবে সব পর্যায়ে বহুজাতিক কোম্পানি নাছরবান্দা। সবাইকে সে সাদা হওয়ার উপায় বাতলে দিয়েছে। কালোকে সে অগৌরবের, অসাফল্যের প্রতীক করে তুলেছে। উপনিবেশিক শক্তি দেশ ছেড়ে গেলেও মন ছেড়ে যাবার উপায় রাখেনি। ফলে সাদা বা কালো রঙ না, রঙের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অর্থ বর্ণবাদ লালন করে। নারী কেবল ফরসা হলেই হবে না, নারীকে ‘নিঁখুত’ও হতে হবে। ইতিহাস আমাদের বলছে, নারীর নিখুঁত হওয়ার মাপকাঠি সব সময়ে একই রকম নয়। এটা নির্ভর করে নির্দিষ্ট অঞ্চল, ট্রেন্ড, শ্রেণি ও সময়ের ওপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষক ড. কাবেরি গায়েন ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের চারটি প্রধান দৈনিকে প্রকাশিত ৪৪৬টি পাত্র চাই, পাত্রী চাই বিজ্ঞাপন বিশ্লেষণ করে দেখেছেন, সমাজে কালো মেয়েরা ভয়ানকভাবে অবজ্ঞার শিকার। বিয়ের জন্য ফর্সা মেয়েই পরম কাঙ্ক্ষিত। বিষয়টির আরও গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে এই গবেষক জেনেছেন, ফর্সা না হওয়ায় শহরে-গ্রামে অসংখ্য নারী গঞ্জনা, নির্যাতন সহ্য করে বাঁচে কিংবা আত্মঘাতী হয়। দৈনিক সংবাদপত্রের শ্রেণিবদ্ধ বিজ্ঞাপন নিয়ে গবেষণা কর্ম সম্পাদনের ১৫ বছর পরেও সমাজে খুব উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়নি বলেই মনে করেন তিনি।
কাবেরী গায়েন বলেন, ‘সমাজে কালো মেয়েদের অস্তিত্বেই বিশ্বাস নেই। কালোকে সে অগৌরবের, অসাফল্যের প্রতীক করে তুলেছে। মেধা, বুদ্ধি, সাহস সাফল্য সবকিছুকে নামিয়ে নারীর সাফল্যের সুখের ঠিকানা নির্মাণ করে দিয়েছে ফর্সা রঙে। এ পৃথিবী তাই কালো মেয়ের চাহিদা তো দূরে থাক, মেয়ে মানেই ফর্সা হতে হবে। ইউরোপ কেন্দ্রিক সৌন্দর্যের ধারণায় বাধা পড়েছে মনস্তত্ত্ব। আসলে এটি দাসত্বের হীনমন্যতা বোধ। ব্রিটিশ থেকে শুরু করে যারাই এই দেশ জয় করেছে, তাদের গায়ের রং ফর্সা ছিল। রাজার রঙের প্রতি সমীহ, যাকে শক্তপোক্ত করেছে বিশ্ব পুঁজির সৌন্দর্যবাজার, সেও ইউরোপ কেন্দ্রিক।
পশ্চিমা দেশে গায়ের রঙে বর্ণ চেনা গেলেও, বর্ণবাদ স্রেফ গায়ের রঙ ভিত্তিক না উল্লেখ করে নৃবিজ্ঞানী নাসরিন খন্দকার বলেন, শ্বেতাঙ্গ মানুষের দাস বাণিজ্য আর উপনিবেশিক ইতিহাস থেকে উঠে আসা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের বিপরীতে সব জাতি, সব বর্ণ এবং সব ধর্মের মানুষ বর্ণবাদের স্বীকার। বর্ণবাদ তাই যতটা সাদা-কালো বলে মনে হয়, ততোটা সাদা কালোর বিষয় নয়। এটি প্রবল আর প্রান্তিকতার বিষয়, আধিপত্য আর ক্ষমতার বিষয়। উপনিবেশ শাসক চলে গেছে, কিন্তু রেখে গেছে তাদের বর্ণবাদ আমাদের মধ্যে, ফর্সা গায়ের রঙয়ের প্রতি আমাদের পক্ষপাতিত্বে। বর্ণবাদের শেকড় থাকে ওপরের প্রতি ঘৃণা আর নিজের অহমে। ক্ষমতার হাত ধরে আজকে আমাদের দেশজ বর্ণবাদের স্বীকার আদিবাসী আর ধর্মীয় সংখ্যালঘু।
ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই বর্ণবাদ ঢুকে আছে। আমাদের মননেও বর্ণবাদ বাসা বেধে আছে দশকের পর দশক ধরে। সে কারণে সাদা চামড়ার ব্রিটিশদের আমরা সাহেব বলি। আমরা এই চিন্তা থেকে বের হতে পারিনি কারণ বের হতে হলে যে সব উদ্যোগ রাষ্ট্র বা নাগরিক সমাজের নেওয়ার কথা তা নেওয়া সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্র যেমন পুঁজিবাদকে প্রাধান্য দেয় তেমনি পুঁজি সব সময় সাদাকে প্রাধান্য দেয়। আর আমরা নাগরিক সমাজ মুখে যতই বলি না কেন অন্তরে সাদার পুজারি।’
গণমাধ্যমও বর্ণবাদকে জিইয়ে রাখে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের শৈশব থেকেই শেখানো হয়েছে সাদা মানে ভালো, কালো মানে খারাপ। তার কাউন্টার শিক্ষাটা আমরা দিতে ব্যর্থ হচ্ছি।’
আজ বিশ্ব বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস। ১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২১ মার্চকে বিশ্ব বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস হিসেবেঘোষণা করে। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের মিছিলে বর্ণবাদী সরকারের পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়ে ৬৯ জনকে হত্যা করে। এ কারণে বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস হিসেবে এ দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়।
গায়ের রঙ নিয়ে অতিশয় ভাবনা, বিশেষ করে মেয়েদের তথাপি যেই সংস্কৃতিতে চামড়ার রঙের বিভাজন করা হয় পাঁচ ছয় ধাপে, যথা কুচকুচে কালো, কালো, শ্যামলা, উজ্জ্বল শ্যামলা, ফর্সা, ধবধবে ফর্সা সেই সংস্কৃতিকে বর্ণবাদ আখ্যায়িত করা কী ভুল হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে নারী অধিকার নেত্রী শিরিন হক বলেন, ‘গায়ের রঙ এক ধরনের বর্ণবাদ। যদিও তা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের বিদ্বেষের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। ঐতিহাসিকভাবে যা কিনা কেবল কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের প্রতি বৈষম্য ও নানান অন্যায় আচরণের মধ্যে সীমিত থাকে নাই, প্রায়শই সহিংস রূপ নিয়েছে।’