X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

উপকূলে খাবার পানির সংকট দূর হবে কবে?

সাদ্দিফ অভি, সাতক্ষীরা থেকে ফিরে
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০৫আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০৫

সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা ফাতেমা পান করার পানি সংগ্রহ করেন পুকুর থেকে। পুকুরের পানি কতটা নিরাপদ তার জানা নেই, তবে চাহিদা মেটাতে আর বিকল্প নেই। ভোরে অনেকেই কলসি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পানির খোঁজে। কারণ সেটাই পান করবে সবাই, সেটাই ব্যবহার হবে রান্নায়। দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলের মানুষ এ পানি ব্যবহার করে আসছেন।

সাতক্ষীরাসহ উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির সংকট দীর্ঘদিনের। ভৌগোলিক  কারণে বিশেষ করে সমুদ্রপৃষ্ঠের কাছে থাকায় জেলার শ্যামনগর ও আশাশুনি উপজেলায় পানির সংকট অন্য উপজেলার চেয়ে বেশি। এসব এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বড় এসব এলাকার জনগোষ্ঠীকে খাবার পানির জোগানে একেক ঋতুতে একেক উৎসের ওপর নির্ভর করতে হয়।

বৃষ্টির সময় রিজার্ভ ট্যাংকে পানি ধরে রাখা যায়। যা দিয়ে তিন-চার মাসও চলে যায়। বাকি সময় কখনও পুকুর ফিল্টার (পিএসএফ) বা সরাসরি পুকুরের পানি অথবা ব্যক্তি উদ্যোগে স্থাপিত লবণ বিমুক্তকরণ প্ল্যান্ট থেকে এখানকার মানুষের খাবার পানি পায়।

গরমের সময় প্রাকৃতিক উৎস বেশিরভাগই অচল থাকে। ফলে মানুষকে এই সময় পানি কিনে খেতে হয়। এই পানির দাম প্রতি লিটার এক টাকা। 

২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার আঘাতে প্রচুর ক্ষতি হয় এই জেলার মানুষের। তারপর থেকেই পানির ভয়াবহ সংকট শুরু। এসময় সাতক্ষীরা পৌরসভা, শ্যামনগর ও আশাশুনিতে কয়েকটি এনজিও এগিয়ে আসে নিরাপদ পানি সরবরাহে। সংশ্লিষ্টদের মতে, প্রয়োজনের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত, নদীর নাব্যতা হ্রাস ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া প্রভাব পড়ছে টিউবওয়েলের ওপরও। টিউবওয়েল থেকেও মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি পাচ্ছে। আর লবণাক্ততার কারণে এ সব উৎসের পানি ব্যবহারও দুরূহ হয়ে উঠেছে।

উপকূলে খাবার পানির সংকট দূর হবে কবে? সংকট দূর করতে ২০১৫ সাল থেকে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে চাহিদা মেটানোর কাজ করছে ওয়াটারএইড। তাদের সহযোগিতায় সেটা বাস্তবায়ন করছে স্থানীয় এনজিও রূপান্তর। এখন পর্যন্ত এসব এলাকার ৪১টি স্কুলে এবং ১৭টি কমিউনিটি ক্লিনিকে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বৃষ্টির পানি ফিল্টার হয়ে চেম্বারে যাচ্ছে আর সেটি পান করছে স্কুলের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ।

মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের ত্রিপানি বিদ্যাপিঠের শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন পানি খাচ্ছিল স্কুলের পেছনের দিঘি থেকে। তাতে নানারকম শারীরিক সমস্যার পাশপাশি স্কুলে আসার প্রবণতাও কমে যেত। ২০১৮ সালে এই স্কুলে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষার্থীরা জানালো, তারা দিঘি থেকে সরাসরি পানি খেতো। পরে পানির স্থাপনা হওয়ার পর তারা এখান থেকেই পানি খায়।

স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো আবুল কালাম মল্লিক জানান, আগে অধিকাংশ শিশুই পানি নিয়ে আসতো বাড়ি থেকে। অনেক সময় দেখা গেছে পানির অভাবে হয়তো তারা ছুটি চাইতো। দুই-একদিন স্কুলেও আসতো না। এলাকায় এ সমস্যা দীর্ঘদিনের। বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করায় কিছুটা সুবিধা হয়েছে। পানির কারণে আর শিক্ষার্থী ঝরছে না।

এই স্কুলে যে পানির চেম্বার করা করা হয়েছে সেটার ধারণক্ষমতা ২০ হাজার লিটার। রূপান্তরের কর্মকর্তারা জানান, এই সিস্টেমে একটি ডিসপেনসার পয়েন্ট আছে। এখান থেকে শিশুরা পানি নেয়। বৃষ্টি যখন হয় তখন পানিটা প্রথমে একটি লাইনে এসে পড়বে। পাইপের একটি পয়েন্টে ফিল্টার স্থাপন করা হয়েছে। এই ফিল্টার হওয়ার পর পানিটা ট্যাংকে চলে যাবে। তাছাড়া পাইপের সঙ্গে যুক্ত আছে ফাস্ট ফ্লাশিং সিস্টেম। বৃষ্টি যখন হয় তখন প্রথম বৃষ্টির পানিতে ময়লা থাকে। প্রথম ২৫-৩০ মিনিট এই ফাস্ট ফ্ল্যাশের মাধ্যমে ফেলে দিতে হয়। এই সময় পর সেটি বন্ধ করে দিলে পানি সরাসরি চেম্বারে চলে যাবে।

তিনি আরও জানান, আমরা হিসাব করি যে স্কুলে শিশুর সংখ্যা কত এবং তাদের জন্য ৯ মাসে কী পরিমাণ পানির প্রয়োজন। তার ওপর নির্ভর করে আমরা ধারণক্ষমতা নির্ধারণ করি।

উপকূলে খাবার পানির সংকট দূর হবে কবে? খাবার পানির মান সম্পর্কে ওয়াটার এইডের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার রিভেন চাকমা জানান, আমরা একটা মেকানিজমের মাধ্যমে পানিকে ফিল্টার করছি। ফিল্টার হওয়ার পর সেটি কতটুকু নিরাপদ সেটা নিশ্চিত করতে আমরা কয়েকটি প্যারামিটার পরীক্ষা করি। এগুলো হচ্ছে—ফিকাল কলিফরম, পিএইচ মাত্রা। ল্যাবরেটরি টেস্টের পর শতভাগ নিরাপদ হলে আমরা ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেই। ৯ মাস এই পানি যেহেতু থাকে আমরা ছয় মাস পর পর একটা মনিটরিং টেস্ট করি। আমাদের এক একটি প্রকল্পের মেয়াদ ১০ বছর।

ওয়াটারএইডের অ্যাডভোকেসি এবং কমিউনিকেশন ম্যানেজার ফয়সাল আব্বাস জানান, সাতক্ষীরার এসব অঞ্চলের মানুষ অনেক কষ্ট করে পানি সংগ্রহ করে। আমাদের যেসব প্রকল্প এখানে বাস্তবায়িত হচ্ছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে কাজ করছে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা। আমরা জানি যে এসব এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানাকারনে যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করে। আমাদের প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে নিরাপদে কীভাবে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করা যায় তার একটি উদাহরণ। এখানে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ফিল্টারিং সিস্টেম এবং লবণাক্ততার কারণে অবকাঠামোগুলো টেকসই না হওয়া। আমরা যদি কমিউনিটিকে নিয়ে অবকাঠামোগত জায়গায় কাজ করতে পারি তাহলে সেটি আরও দীর্ঘমেয়াদি হবে। পানি এবং স্বাস্থ্যগত বিষয়ে যদি মানুষ জানতে পারে তাহলে জীবনযাপন আরও সুন্দর করে করতে পারবে।

সাতক্ষীরা জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আ. বাছেদ জানান, সাতক্ষীরা জেলায় পানির লবণাক্ততা অনেক বড় একটা সমস্যা। এই জেলায় অনেক মূল্যবান রিসোর্স আছে। প্রতিবছর ঝড় সাইক্লোনের সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ শ্যামনগর, আশাশুনি উপজেলা। দুর্যোগের প্রভাব সরাসরি এসব এলাকার মানুষের ওপর পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক বড় প্রভাব পড়েছে এই জেলায়। সরকার দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে কাজ করছে। আমি মনে করি সাতক্ষীরা জেলায় একটি মাস্টার প্ল্যান দরকার। এখানে লবণাক্ততা দূর করার জন্য বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে ব্যবস্থাপনায় আমাদের সব দফতর সংস্থা মিলে একটি সমন্বিত মাস্টার প্ল্যান করার প্রয়োজন আছে। উপকূলে খাবার পানির সংকট দূর হবে কবে?

/এফএ/   
সম্পর্কিত
স্বামীকে ভিডিও কলে রেখে প্রাণ দিলেন পার্লারের মালিক
সাজেকে রিসোর্ট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পানির সংকট, অপেক্ষা বৃষ্টির
পানির সংকট নিরসনে কাজ করবে ওয়াসার ১০ মনিটরিং টিম
সর্বশেষ খবর
বিলেতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন নতুন আসা বাংলাদেশিরা: কমিউনিটিতে প্রতিক্রিয়া
বিলেতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন নতুন আসা বাংলাদেশিরা: কমিউনিটিতে প্রতিক্রিয়া
হিটলারের চেয়েও ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে নেতানিয়াহু: কাদের
হিটলারের চেয়েও ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে নেতানিয়াহু: কাদের
আগের দামে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই
ভোজ্যতেলের মূল্য নিয়ে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীআগের দামে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই
কোরআন পোড়ানোর অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
কোরআন পোড়ানোর অভিযোগে যুবক গ্রেফতার
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
বাজারে ক্রেতা নেই: তবু ব্রয়লারের কেজি ২৩৫, গরু ৮০০
বাজারে ক্রেতা নেই: তবু ব্রয়লারের কেজি ২৩৫, গরু ৮০০