X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার ভিসা পেতে যা করে চক্রটি!

আব্দুল হামিদ
১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২:০০আপডেট : ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২:০০

রেজাউল ইসলাম ‘ডিফেন্স আইকন’ নামে একটি খাদ্যপণ্য সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের মালিক। লোকাল টেন্ডারের মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীতে চাল-ডালসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য সরবরাহ করে। টেন্ডার বাণিজ্যের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে প্রতারণার কৌশল রপ্ত করে রেজাউল। হয়ে ওঠেন আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য। তিনি ‘সারা এন্টারপ্রাইজ’ নামে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি ও পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তি কোম্পানিতে ভুয়া টেন্ডারে কাজ পাওয়ার কথা বলে, সে দেশের সংশ্লিষ্ট কোম্পানি থেকে ভিজিট ভিসার অফার লেটার নিয়ে আসেন। পরে সেই অফার লেটারের মাধ্যমে অবৈধভাবে মানবপাচার করে আসছিলেন বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ‘আমেরিকা সিগন্যাল করপোরেশন’ থেকে মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জামের ভুয়া ক্রয়াদেশ (টেন্ডার) পাওয়ার কথা বলে ই-মেইল করে চক্রটি। সেখানে (টেন্ডার পেপারে) ওই কোম্পানিকে বলা হয়, বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীতে বিভিন্ন প্রযুক্তি সরঞ্জামাদি আমদানি করতে ‘আমেরিকা সিগন্যাল করপোরেশন’ কোম্পানির টেন্ডার গ্রহণ করেছে। এখন বাংলাদেশ থেকে কোম্পানি ভিজিট করতে একটি প্রতিনিধি দল যেতে চায়। এর জন্য কোম্পানির অফার লেটার পাঠাতে বলে। পরে মার্কিন কোম্পানি বিষয়টি ঢাকা মার্কিন দূতাবাসে জানালে, তারা খোঁজ-খবর নেওয়ার একপর্যায়ে ভুয়া মনে হলে গুলশান থানায় বিষয়টি জানান। মার্কিন দূতাবাসের অভিযোগটি তদন্তে নামে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। তদন্তের একপর্যায়ে এই চক্রের সন্ধান পায় ডিবি।

গত ৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর রামপুরা এলাকা থেকে অবৈধভাবে বিদেশগামী ও প্রতারক চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগ। এর আগে আমেরিকার ভিসা পাইয়ে দেওয়ার জন্য পাসপোর্টে বিভিন্ন দেশের ভিসা এবং ইমিগ্রেশনের সিল লাগিয়ে পাসপোর্ট ভারী দেখিয়ে ঢাকা মার্কিন দূতাবাসে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভিসার জন্য আবেদন করা আরেকটি চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেফতার করে ডিবির একই বিভাগ।

গ্রেফতার আসামিদের দুই দিনের রিমান্ড শেষে বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) আদালতে তোলা হয়। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, রিমান্ডে আসামিদের কাছ থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। আর নতুন করে যাদের নাম আসছে, তাদেরও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এছাড়া এই চক্রের প্রধান রেজাউল ইসলাম এ পর্যন্ত আট থেকে দশ জনকে এভাবে ভুয়া ক্রয়াদেশ (টেন্ডার) দেখিয়ে অফার লেটারের মাধ্যমে ইতালি ও পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমেরিকান কোনও কোম্পানির সঙ্গে এ ধরনের প্রতারণা এটাই ছিল প্রথম।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম (উত্তর) বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন কোম্পানি থেকে ভুয়া ই-মেইল পাঠিয়ে ভিজিট ও ট্রেনিংয়ের কথা বলে ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিতেন তারা। পরে সেই অ্যাপয়েন্টমেন্টে যেতে আগ্রহী যাত্রীদের সঙ্গে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকায় চুক্তি করে তারা কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। প্রতারক রেজাউল ইসলাম ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কোম্পানি থেকে অফার লেটার নিয়ে এসে ৮-১০ জনকে পাঠিয়েছে। তবে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, আর কোন কোন দেশের সঙ্গে রেজাউল এ কাজ করেছেন। এই ভিসার অফার লেটার নিয়ে যেমন প্রতারণা করেছে, তেমন ব্যাংকের জাল সনদ ও কর কমিশনের ভুয়া স্টেটমেন্ট নিজে তৈরি করতেন রেজাউল।

এডিসি মোহাম্মদ জুনায়েদ আলম সরকার বলেন, মার্কিন ভিসা পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমেরিকান কোম্পানির সঙ্গে প্রতারণামূলক কাজের মূলহোতা রেজাউল ইসলাম। ২০১১-১২ সালে নিজ কোম্পানি ডিফেন্স আইকন সেনাবাহিনীতে লোকাল টেন্ডারের কাজ করতো। সরকারি কাজের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদফতর বা ডিজিডিপি’র ক্রয় পদ্ধতি সম্পর্কে বিশেষভাবে পারদর্শী হয়ে ওঠে। পরবর্তী সময়ে এই পারদর্শিতা কাজে লাগিয়ে ২০১৪-১৫ সাল থেকে এ ধরনের প্রতারণা করে বিদেশে মানবপাচার করে আসছে সে। এই প্রতারক বিশ্বের বিভিন্ন নামিদামি কোম্পানির সঙ্গে আগেও এ ধরনের বহু প্রতারণা করেছে। গ্রেফতারকৃতরা হলেন—রেজাউল ইসলাম, সাইফুল ইসলাম, আজিজুর রহমান, খায়রুল কবির, সাদেকুর রহমান, শাহরিয়ার হোসেন বিক্রম ও মুহাম্মদ আবু বক্কর। গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ  থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত জাল সিল, সিল প্যাড, পাসপোর্ট, ভুয়া আইডি কার্ড, বিপুল পরিমাণ জাল কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়।

তিনি বলেন, চক্রটিকে গ্রেফতারের পরে জানা যায় সারা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সবুজ আলম আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশন কোম্পানিকে ভুয়া প্রতিরক্ষা ক্রয় মহাপরিদফতরের (ডিজিডিপির) ক্রয়াদেশ উপস্থাপনের মাধ্যমে বিভ্রান্ত করেছেন। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস ডিজিডিপি ক্রয়াদেশ যাচাই-বাছাই করে জানতে পারে, নথিতে উল্লিখিত সিলগুলো জাল, নথিতে সইকারী ব্যক্তি (মেজর বসির আহমেদ) পাঁচ বছর আগে ডিজিডিপিতে পদায়িত ছিলেন এবং টেন্ডারের নথিটিও জাল।

মামলার এজাহারে যা বলা হয়েছে
সারা এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি জাল ডিজিডিপি চিঠি তৈরি করে এবং স্বেচ্ছায় জেনে-শুনে মার্কিন কোম্পানি আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলে প্রতারণা করে। সারা এন্টারপ্রাইজ দাবি করে, তারা ১.২ মিলিয়নের অধিক মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় চুক্তির সঙ্গে জড়িত একটি কোম্পানি। তারা প্রতারণামূলকভাবে মার্কিন কোম্পানিকে ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য সারা এন্টারপ্রাইজের ছয় জন ব্যক্তির ভিসা অনুমোদনের গ্যারান্টি দেওয়ারও অনুরোধ করে। মূলত ওই ছয় ব্যক্তির প্রশিক্ষণ গ্রহণের কোনও উদ্দেশ্য ছিল না। তারা প্রতারণামূলক কাজটি ভিসা অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে এবং যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে অভিবাসনের জন্য মার্কিন ভিসা পেতে ব্যবহার করেছিলেন। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস বাদী হয়ে গুলশান থানায় গত ৮ ফেব্রুয়ারি একটি মামলা করেন।

এতে বলা হয়, প্রথমে আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশনের কাছে নিজেদের বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘লাউড আউটডোর ওয়ার্নিং ফিক্সড পোর্ট সাইরেনস’ সাপ্লাইয়ার বলে পরিচয় দেয়। সারা এন্টারপ্রাইজ পরিচয়ে তারা ১.২ মিলিয়ন ডলারের সামরিক ভুয়া ক্রয় চুক্তি দেখিয়ে মার্কিন কোম্পানিকে ই-মেইল করে। পরবর্তী সময়ে আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশন আসামিদের এবং ঢাকায় আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে অফার লেটার পাঠায়। প্রতারণা করে আমেরিকান সিগন্যাল করপোরেশনের পাঠানো অফার লেটার ও সারা এন্টারপ্রাইজ পরিচয়ে ১.২ মিলিয়ন ডলারের সামরিক ভুয়া ক্রয় চুক্তি দেখিয়ে ঢাকায় আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে ভিসার জন্য আবেদন করে। মূলত সারা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী রেজাউল ইসলাম নিজেকে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর পরিচয় দেন। তিনি মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে অবৈধ পথে আমেরিকা যাওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করে বাকি আসামিদের। ভিসার জন্য তারা পরস্পর সহযোগিতায় জাল সিল ও নকল কাগজপত্র তৈরি করে।

গত ৪ ফেব্রুয়ারি সকাল ১১টায় ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে ছয় জন তাদের ভিসা সাক্ষাৎকারের জন্য উপস্থিত হয়। সাক্ষাৎকারের সময় তারা স্বীকার করে, তাদের ডিজিডিপি কাগজপত্র জাল এবং তারা প্রশিক্ষণের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছে না। তারা অবৈধভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতে যাচ্ছিল। চক্রটি অবৈধভাবে অভিবাসনের জন্য মিথ্যা অজুহাতে মার্কিন ভিসা পাওয়ার জন্য জালিয়াতি ও প্রতারণা করেছে।

/এমএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
অডিও ফাঁস, নারীর কাছে ডিবি পুলিশ সদস্যের ‘হেরোইন বিক্রি’
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
মধুমতি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দুদকের
সর্বশেষ খবর
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা